স্বাস্থ্য

‘আমাগো ঘরই নাই, মশারি টাঙামু কই’

# মালিবাগ বস্তিতে ৫২ ঘরের একটিতেও নেই মশারি# বস্তির ঘরে ঘরে জ্বর, ভরসা নিম-পেঁপেপাতার রস# মধ্যবিত্তের চেয়ে ভালো আছে ওরা দাবি কাউন্সিলরের# উচ্ছেদ চায় ডিএসসিসি, পুনর্বাসন দাবি এনজিওগুলোর

Advertisement

রহিমন নেসার বয়স ৬৫ ছুঁই ছুঁই। দুই ছেলে রিকশা চালান। বিয়ে করে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন তারা। রাজধানীর মালিবাগে রাস্তার পাশে বস্তিতে ঠাঁই হয়েছে রহিমনের। সঙ্গে থাকেন বিধবা মেয়ে। মা-মেয়ে দুজনের থাকার ঘরে বিছানা বলতে দুই হাত প্রস্থের বাঁশের তৈরি খাটিয়া। ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে মশারি-কয়েল ছাড়াই দিন-রাত কাটে রহিমন নেসার।

রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে মালিবাগ বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, তিন নম্বর ঘরের সামনে বসে আছেন রহিমন। জানান, বস্তিতে মশা বেড়েছে। জ্বর-জারিও বেড়েছে সবার। তিনিও এক সপ্তাহ ভুগেছেন জ্বরে। মশারি ছাড়া থাকেন কীভাবে— এমন প্রশ্নে রহিমন বলেন, ‘আমাগো ঘরই নাই, মশারি টাঙামু কই?’

রহিমনের পেছনে ঘরের দরজা। ওপরে বাঁশ-কাঠের ছাউনিতে পুরোনো টিনের চালা। চারপাশ ঘেরা পলিথিন মুড়িয়ে। দরজাটাও বাঁশের। উঁকি দিতেই দেখা গেলো- ঘরে ওড়াওড়ি করছে মশা। পুরোনো-নোংরা জিনিসপত্রে ঠাঁসা পুরো ঘর। বামপাশে এক কোণায় বাঁশের তৈরি খাটিয়া। বড়জোর তিন ফুট প্রস্থ, দৈর্ঘ্য (লম্বা) হবে সাড়ে চার-পাঁচ ফুট। মা-মেয়ে মিলে বানিয়েছেন এ খাটিয়া। পাঁচ বছর ধরে তাতে দিনশেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর এলিয়ে ‘শান্তির ঘুমে’ যান ৬৫ বছরের এ নারী।

Advertisement

আরও পড়ুন>> জ্বর হওয়ার কতদিনের মধ্যে কোন টেস্ট করলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে?

সন্তানদের কথা জিজ্ঞেস করতেই রহিমন নেসার কণ্ঠে আক্ষেপের সুর। তবুও সন্তানদের সুখী জীবনের দোয়া মুখে। তিনি বলেন, ‘আমাগো দেখার কেউ নাই। পোলা দুইডা বিয়া-শাদি কইরা আলাদা থাকে। সুখে আছে, থাকুক ওরা। আমার জীবন বস্তিতেই কাটামু।’

কেউ মশারি বা সাহায্য-সহযোগিতা দেয় না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দ্যাশের বাড়ি ময়মনসিংহ। ঢ্যাকায় আইছি ১৪-১৫ বছর। আগে অন্যখানে আছিলাম। পাঁচ বছর ধইরা এ বস্তিতে। কেউ কোনোদিন এক পয়সার সহযোগিতা দিতেও তো আইলো না।’

মানুষের বাসায় মাঝে মধ্যে কাজ করে সংসার চলে রহিমনের। বয়স হয়েছে, প্রতিদিন কাজে যেতেও পারেন না। মেয়ে রুবিনাও মেসে রান্নার কাজ করেন। দুজনের আয়ে কোনোমতে খাওয়া চলে জানিয়ে রহিমন বলেন, ‘মশারির কথা কইতেছেন বাজান, কেউ তো দেয়ও না। দিলেও টাঙামু কোথায়? ঘরে তো জায়গাও নাই।’ তবে ছোট সাইজের একটা মশারি কেউ দিলে খুব উপকৃত হবেন বলে জানান রহিমন।

Advertisement

শুধু রহিমন নন, এ বস্তির ৫২টি ঘরের কেউই মশারি ব্যবহার করেন না। যাদের আয়-রোজগার ভালো তারা রোজ কয়েল কিনে জ্বালিয়ে মশা থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন। সিটি করপোরেশন থেকে মাঝে-মধ্যে বস্তি এলাকায় ওষুধ ছিঁটানো হলেও তাতে মশা মরে না। খোঁজ-খবর রাখেন না ওয়ার্ড কাউন্সিলরও।

ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। দেশে দৈনিক প্রাণহানি ঘটছে ১৫-২০ জনের। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ ঘটে। মশা থেকে বাঁচতে পারলে ডেঙ্গু এড়ানো সম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে মশারি ব্যবহারে গুরুত্ব দিচ্ছেন চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞরা। অথচ এ বস্তির তিনশ মানুষের অধিকাংশের মশারি কেনার সামর্থ্য নেই। দু-একজনের সামর্থ্য থাকলেও ব্যবহারে আগ্রহ নেই।

মন্ত্রী-মেয়ররা কত কী কয়!গত ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে দেশের ছিন্নমূল মানুষকে মশারি দেওয়ার দাবি তোলেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তার কথার জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা শহরে মশারি কিনতে পারেন না, এমন মানুষ আছে বলে আমার জানা নেই।’

আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু আক্রান্ত ভাইয়ের টেস্ট রিপোর্ট পেতে ছোট্ট হুমাইরার ‘যুদ্ধ’

মন্ত্রীর এমন বক্তব্য শুনেছেন কি না, জানতে চাইলে মালিবাগ বস্তির দুই নম্বর ঘরের বাসিন্দা সালমা বেগম বলেন, ‘মন্ত্রী-মেয়ররা কত কী যে কয়, ওগো কথায় কান দিলে আমাগো পেটে ভাত যাইবো না। কাজে না গেলে পেটে ভাত জোটে না। পরনে মেক্সিটা (পোশাক) কিনেছি দুই বছর হলো। কাপড়টা পচে গেছে, নতুন একটা যে কিনবো, টাকা গোছাতে পারি না। কে এখন ৪০০-৫০০ টাকা দিয়ে মশারি কিনবে?’

তার কথায় সায় দেন পাশেই তরকারি কাটতে বসা খোদেজা। তিনি বলেন, ‘দ্যাশের বাড়ি জামালপুর। আমরা তো এ দ্যাশেরই মানুষ। ঢাকায় থাকি। এখানকার মেয়রও দেখে না, কিছু দেয় না আমাগো। জামালপুরে গ্রামের বাড়ির চেয়ারম্যান-মেম্বাররা তো চিনতেই পারেন না।’

বস্তির ঘরে ঘরে জ্বর, ভরসা নিম-পেঁপেপাতার রস

সিরাজগঞ্জ থেকে ১২ বছর আগে স্বামী ও এক সন্তান নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান মাজেদা। মহাখালী এলাকায় টিনের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন তারা। ঢাকায় এসে আরও এক সন্তান জন্ম দেন তিনি। রিকশাচালক স্বামী হঠাৎ দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মাজেদাকে ঘর থেকে বের করে দেন স্বামী। অসহায় মাজেদা বড় মেয়ে ও কোলের ছেলেকে নিয়ে ২০১৭ সালে ঘর করেন মালিবাগ বস্তিতে। দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত বছর এখানেই থাকছেন তিনি।

বড় মেয়ে সুরাইয়া জ্বর থেকে সেরে উঠেছে তিন-চারদিন আগে। এখন জ্বরে পড়েছে ছোট ছেলে সুরুজ। চিকিৎসক দেখানোর টাকা নেই। ফার্মেসি থেকে নাপা বড়ি এনে খাইয়েছেন। জ্বর কমছে না। বস্তির মুরুব্বিদের পরামর্শে ছেলেকে এখন নিমপাতা ও পেঁপে পাতা বেঁটে রস করে খাওয়াচ্ছেন মাজেদা।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বড় চাচি (পাশের ঘরের রহিমন নেসা) কইলো- নিমের পাতা বাইট্যা এক চামচ করে খাওয়াতে। খুব তিতা, পোলাডা খাইতেও চায় না। তয় পেঁপে পাতার রসটা খাইতেছে। শরীলডাও এখন একটু ভালো।’

মাজেদার ছেলে সুরুজের মতো বস্তির আরও অনেকে নিম ও পেঁপে পাতার রস খেয়ে জ্বর থেকে সেরে উঠছেন বলে জানান বস্তির বাসিন্দারা। তাদেরই একজন সিদ্দিকুর। স্ত্রীকে নিয়ে ছয় বছর থাকছেন বস্তিতে। এমন জ্বরে কখনো পড়েননি বলে জানান ভ্যানচালক সিদ্দিক।

আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে দেশে রোগী হতো ২০-৩০ লাখ: তাজুল

ঘরের সামনে ভ্যানের ওপর শুয়ে তিনি বলেন, ‘গায়ে খুব ব্যথা। তিনদিনে একবারও জ্বর পড়েনি। নিমপাতা-পেঁপেপাতার রস, জ্বরের ওষুধ সবই খাচ্ছি, জ্বর তো কমে না। ডাক্তার দেখাতে যাবো, হাতে পয়সা নেই। চারদিন হলো ভ্যান চালাই না।’

পাশেই ফুটপাতে চুলা বসিয়ে ভাত রান্না করছিলেন সিদ্দিকের স্ত্রী রুনা। ভাতের মাড় এনে স্বামীকে দিতে দিতে বলেন, ‘ওষুধ খাইয়া কাজ হইবো না। মায়ে (সিদ্দিকের শাশুড়ি) কইছে- দিনে-রাতে তিনবার নিমপাতার রস খাইতে হইবো। তুমি তো তিতা কইয়া ফালাইয়া দিতেছো।’

মধ্যবিত্তদের চেয়েও ভালো আছে ওরাবস্তির বাসিন্দাদের দুঃখ-দুর্দশা অনেক। শেষ নেই অভিযোগেরও। তবে ভিন্ন কথা বলছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মাহবুবুল আলম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বস্তির বাসিন্দাদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি- তারা অনেক সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। কয়েকটা এনজিও তাদের সহায়তা করে। আমিও তাদের সহায়তা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। তাদের আয় আসলে মধ্যবিত্তদের চেয়েও ভালো।’

তাহলে কী সচেতনতার অভাব তাদের- এমন প্রশ্নে কাউন্সিলর বলেন, ‘না, সেটাও না। আপনি বস্তির ওদের জিজ্ঞেস করেন- সিটি করপোরেশন, এনজিওগুলো তাদের সচেতন করতে বহু কাজ করেছে। তাদের সব মুখস্ত। তবে তারা সেসব মেনে চলে না।’

কাউন্সিলর মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমার ওয়ার্ড ডেঙ্গুমুক্ত করতে টানা ২৮ দিন আমি নিজে পিকআপে চড়ে ঘুরেছি। দিনভর সচেতনতার জন্য মাইকিং চলে। এমন কোনো বাসিন্দা ওয়ার্ডে নেই যে এগুলো শোনেনি। তারপরও মানুষ সচেতন না হলে তো কিছু করার নেই। আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি।’

পুনর্বাসনের দাবি এনজিওগুলোর

রাস্তার পাশে ঝুপড়ি ঘরে থাকা ৫২টি পরিবারকে ভালো জায়গায় পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে আসছে কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। সিটি করপোরেশন শুধু উচ্ছেদ করে ক্ষ্যান্ত হতে চায়, পুনর্বাসন করতে চায় না বলেও অভিযোগ তাদের।

মালিবাগ বস্তিতে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুরভীর ভাইস-চেয়ারম্যান শাহিনা খান জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওদের দুঃখ-দুর্দশা আছে। আবার অসচেতনতাও আছে। আমরা দীর্ঘদিন ওদের নিয়ে কাজ করছি। সাধ্যমতো সহায়তার চেষ্টাও করছি। আমরা বলেছি- তাদের ওখান থেকে উচ্ছেদ করা হলে যেন যথাযথ উপায়ে পুনর্বাসন করা হয়। এজন্য সিটি করপোরেশন তাদের উচ্ছেদ করতেও পারেনি।’

উচ্ছেদ প্রসঙ্গে কাউন্সিলর মাহবুবুল আলম বলেন, ‘রাস্তার পাশে তারা ধীরে ধীরে ঘর গড়ে তুলেছে। নিয়ম অনুযায়ী সেখানে তাদের থাকার কথা নয়। দু-একবার ম্যাজিস্ট্রেট এসেও ফিরে গেছেন। কারণ এনজিওগুলো তখন তাদের পক্ষে অবস্থান নেয়। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।’

তবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারলে তাদের সেখান থেকে সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও জানান কাউন্সিলর মাহবুবুল।

এএএইচ/এএসএ/জেআইএম