মতামত

শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে বিবৃতি দেওয়ার কি কেউ নেই!

অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে শ্রমিকদের স্বার্থ ও অধিকারের কথা ভুলে গিয়ে বিশ্বের ১৬০ বিশিষ্ট ব্যক্তি সাজাপ্রাপ্ত আসামি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা স্থগিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বরাবর চিঠি বা বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের এই বিবৃতি নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের পরিপন্থি এবং পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো স্বাধীন দেশের স্বাধীন বিচারকার্যের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপের নামান্তর, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

Advertisement

এর চেয়েও অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে একটি স্বাধীন দেশের সংবিধানের আলোকে সাজাপ্রাপ্ত একজন আসামি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দেওয়ার মানুষ আছে কিন্তু শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে বিবৃতি দেওয়ার কেউই নেই! এই ১৬০ জন বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তির বিবৃতি আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের পরিপন্থি হওয়া সত্ত্বেও তার বিপক্ষে মানে শ্রমিকদের স্বার্থে বিবৃতি দেওয়ার মতো কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার্থে কী তাহলে কারও কোনো ধরনের মাথাব্যথা নেই?

যদি তাই হয় তাহলে ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির অধীনে শ্রমিকদের স্বার্থ উদ্ধার ও অধিকার আদায়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রতিষ্ঠা কেন গঠন করা হয়েছিল? এই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আন্তর্জাতিক শ্রম নীতিমালা ও কর্মসূচি প্রণয়ন, শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ, আন্তর্জাতিক শ্রমমান উন্নয়ন, শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকদের অধিকার আদায় ও শ্রমিক-মালিকে সম্পর্কের উন্নয়ন, শ্রমিকদের জীবনমান ও কর্ম পরিবেশ উন্নয়ন, শ্রমিকদের পূর্ণ কর্মসংস্থান, কাজের সময় ও মজুরি নির্ধারণ, আন্তর্জাতিক শ্রমনীতি বাস্তবায়নে সদস্য দেশসমূহকে সহায়তা করা ইত্যাদি কাজসমূহ সম্পাদনের লক্ষ্য নিয়ে পথচলা শুরু করেছিল।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ এই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্যপদ লাভ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের স্বার্থ উদ্ধারে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ভূমিকা একাবারেই নীরব। বাংলাদেশ এই সংস্থার সক্রিয় সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থা এগিয়ে আসা উচিত সত্ত্বেও তারা তা করেনি। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের শ্রম আইনের আওতায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা স্থগিত করতে ১৬০ জন বিশ্বে বিশিষ্ট ব্যক্তির এই বিবৃতি সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের পরিপন্থি। আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে বিরোধী এই বিবৃতির পরও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কোনো ভূমিকা এ ব্যাপারে লক্ষ করা যাচ্ছে না। অথচ এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার উচিত ছিল সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। তাদের এই নীরব ভূমিকা কী আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিরোধী কাজের ইঙ্গিত বহন করছে না? এ সংস্থা ভূমিকা কী তাহলে বিশেষ ব্যক্তি ও বিশেষ সময়ে বিশেষভাবে হয়ে থাকে?

Advertisement

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ছাড়াও বিশ্বের গণতন্ত্রমনা নেতারাও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে। গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে গলা ফাটানো মানুষগুলোও আজ নীরব। বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতও আজ এ ব্যাপারে নীরব। তাহলে তারা যে গণতন্ত্রের কথা বলে এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র? স্বাধীন দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং তার ফলে বাংলাদেশের শ্রমিকদের স্বার্থে আঘাত লাগছে জেনেও তারা আজ নীরব কেন?

শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী ১৬০ বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তির বিবৃতির ফলে শ্রমিকদের স্বার্থে আঘাত লাগা সত্ত্বেও তারা কেন কোনো ধরনের আওয়াজ তুলছে না? তাদের প্রত্যাশিত গণতন্ত্র কী তাহলে শ্রমিক অধিকারবহির্ভূত? শ্রমিকদের স্বার্থ ও অধিকারের কথা ভুলে গিয়ে একজন ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষার্থে বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। ফলে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে এবং শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার্থে কেউ কোনো ধরনের বিবৃতি দিচ্ছে না, যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিপরীত। বিশ্ব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এমন বিবৃতি গণতান্ত্রিক আদর্শবহির্ভূত। এক ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষার্থে তারা শ্রমিক শ্রেণির অধিকারের কথা ভুলে গেছেন, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।

সারাজীবন বাঙালি মেহনতি ও অসহায় মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গকারী বঙ্গবন্ধু এবং তার তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের অসহায় এবং মেহনতি মানুষের ভরসাস্থল। বিশ্বের সব নেতা ও প্রতিষ্ঠানের উচিত বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা থেকে শিক্ষা নেওয়া কীভাবে সব বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হয়েও অসহায় মানুষের অধিকার আদায় ও তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে কথা বলতে হয়। কীভাবে সব বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করে সত্যের জয়গান গাইতে হয়!

বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তি, নেতা বা প্রতিষ্ঠান সবাই চুপ থাকলেও বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের অধিকারের কথা ভুলে যাননি। তাদের অধিকার আদায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর এই সোনার বাংলায় কোনো অপরাধীর ঠাঁই হবে না সে যত বড়ই হোক না কেন। সব আন্তর্জাতিক যড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে ধূলিসাৎ দিয়ে শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকেই সব অপরাধীর বিচার অব্যাহত রাখার মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার আদায় করা হবে।

Advertisement

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী এবং জাদুকরী নেতৃত্বে মাত্র ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখো বাঙালির বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন দেশগুলোর পাশে ১৯৭১ সালে জায়গা করে নিয়েছে ছোট্ট এই বাংলাদেশ। স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যে ধারা শুরু করেছিলেন ৭১ এর ১৫ আগস্ট খুনিদের কালো থাবায় তাতে সাময়িক স্থবিরতা এলেও বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে তা পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা এই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে জনসাধারণের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকারসহ সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করেছে। বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তেমনি তিনি ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর’ জন্য ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহান স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বঙ্গবন্ধু চাকরিজীবীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনি চাকরি করেন আপনার মায়না দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়, আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন, ওরাই মালিক।’

শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের প্রতি কতটা দরদ ও মমত্ববোধ থাকলে একজন রাষ্ট্রনায়ক তার দেশের গরিব শ্রমজীবীদের দেশের মালিক বলে ঘোষণা দিতে পারেন! ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ‘ন্যাম’ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, একদিকে শোষক, অন্যদিকে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’

শুধু দেশেরই নয়, সারাবিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে হৃদয়ে শক্তপোক্ত স্থান দিয়েছিলেন বলেই বিশ্ব দরবারেও এমন মর্মভেদী বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি জানতেন, শোষিত নিপীড়িত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে সমাজে সাম্য আসবে না। মহান স্বাধীনতা লাভের পরই জাতির পিতা নব প্রণীত সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয় সুদৃঢ়করণ করেন। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সব প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’

১৫ (খ) অনুচ্ছেদে কর্ম ও মজুরির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ৩৪ অনুচ্ছেদে জবরদস্তি-শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কাজ পাওয়া এবং সঠিক সময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়া বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের অর্থনৈতিক অধিকার। বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত প্রচেষ্টায় দেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। এ তহবিল থেকে যে কোনো শ্রমিক কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনাজনিত কারণে স্থায়ীভাবে অক্ষম হলে অথবা মৃত্যুবরণ করলে, জরুরি চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ ও দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য এবং শ্রমিকদের সন্তানের উচ্চ শিক্ষার জন্যেও আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের সার্বিক কল্যাণে আর্থিক সহায়তা প্রদানে একটি কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করেছে এবং তার দ্বারা শ্রমিকদের সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। সব সেক্টরে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে। তাদের যুক্তিক অধিকার আদায়ে দেশের প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক সংঘ বা শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ গঠনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশ সংবিধানে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার্থে শ্রমিক আইন রয়েছে, যা দিয়ে শ্রমিক শ্রেণি সম্পর্কিত যে কোনো অসংগতিকে সমাধান করা হয়। শ্রম আদালতে বিচারাধীন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বর্তমান বিচারিক মামলার অভিযোগকারীরা তার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমের কর্মী। এখানে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। শ্রমিকরাই মামলা নিয়ে এসেছে এবং এই মামলা নিয়ে তারা কি করতে চায় সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার একান্তই তাদের।

দ্বিতীয় শ্রম মামলাটি- শ্রম আইন লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের জন্য শ্রম বিভাগ থেকে করা হয়। প্রফেসর ইউনূসের পক্ষ থেকে অভিযোগগুলো সঠিক নয় এমন কোনো প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়নি, যা দাবি করা হয়েছে তা হলো ‘ব্যতিক্রমবাদ’। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ফলে বাংলাদেশের শ্রম আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শ্রম আইন লঙ্ঘনের অপরাধে সাজা হয়েছে। এটা তো যেকোনো দেশের জন্য একদম স্বাভাবিক একটা বিষয়।

লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/ফারুক/এএসএম