রাজ্জাক সাহেবের সামনে মশা আসা মানেই মশার করুণ মৃত্যু। যতই কাজ থাকুক না কেন, তিনি মশা মেরে তারপর অন্য কাজে হাত দেবেন; সেটি হোক বাসায় অথবা অফিসে। এটি রাজ্জাক সাহেবের রুটিনে পরিণত হয়েছে। যারা তাকে চেনেন; তারা সবাই জানেন।
Advertisement
একমাত্র মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে অস্থিতিশীল ছোট সংসার। এক সময় সুখের সীমানা ছিল না। রাজ্জাক সাহেব অল্পতেই তুষ্ট থাকেন। তবে কার ভাগ্যে কখন কী হয়, তা বলা মুশকিল বটে!
রাজ্জাক সাহেব ভূমি অফিসের ক্লার্ক ছিলেন। সম্প্রতি অফিসার মর্যাদার পদে উন্নতি লাভ করেছেন। অভিজ্ঞ আর চতুর হিসেবে খ্যাতি তাকে জনপ্রিয়তাও পাইয়ে দিয়েছে। কারণ তিনি যেমন মিশুক, তেমনই সৌহার্দপূর্ণ।
রাজ্জাক সাহেবের ছেলে যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিল; তখন ডাক্তার সাহেব ভালো সেবা দিয়েছেন। যা একজন অচেনা ডাক্তারের চেয়ে বেশি। এই ডাক্তার সাহেবকে জমি নিয়ে অনেক বড় জটিলতা থেকে মুক্ত হতে রাজ্জাক সাহেব সহায়তা করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এই চিকিৎসকের পরামর্শ আর নেওয়া হয়নি।
Advertisement
অফিসে আরেকজন রাজ্জাক আছেন। সঙ্গত কারণে বা কথ্য ভাষায় রাজ্জাক সাহেবকে অনেকেই ‘মশা রাজ্জাক’ নামে চেনেন। তাতে অবশ্য কারো কিছু আসে-যায় না।
আরও দশ বছরের বেশি সময় চাকরি করতে পারবেন বলে রাজ্জাক সাহেব গ্রামে বাড়ি নির্মাণ করেননি। তবে গ্রামে বেশ কিছু জমি-জমা কিনেছেন। জমি কিনতে গিয়ে নিকট আত্মীয়-স্বজনের রোষের শিকার হয়েছেন। চাকরির কারণে এমনিতেই গ্রামে অনেকের চক্ষশূল! তবে এতে কার কী আসে-যায়? জীবন কারো জন্য থেমে থাকেনি।
ঢাকায় রাজ্জাক সাহেবের কোনো ফ্ল্যাট নেই, তিনি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। একটি এজমালি জায়গা আছে হেমায়েতপুরে। সেখানে সবাই মিলে অল্পদিনের মধ্যে বাড়ি নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এক সময় বাড়ির কাজে হাত দেওয়ার জন্য রাজ্জাক সাহেবের মতো উদ্যমী কেউ ছিল না। তবে সময়ের কোপে রাজ্জাক সাহেব এখন নিষ্প্রভ।
রাতুল ডাকছে, ‘বাবা, আমার একা ভালো লাগছে না। তুমি কবে আসবে?’ রাজ্জাক সাহেবের চোখ ছলছল করে উঠলো। কেউ টের পেল না। ইদানিং প্রায়ই তিনি এ স্বপ্ন দেখছেন। ছেলের স্কুলব্যাগ, কলম, পেন্সিল, ক্রিকেট ব্যাট, জুতাসহ সব এখনো তার ঘরেই আছে।
Advertisement
এক গ্রাম্য দ্বন্দ্বের জেরে রাজ্জাক সাহেবের ভাই নিহত হলে তার ভূমিকা তেমন কারো চোখে পড়েনি। তার ভাইরা বরাবর তাকেই দূষেছেন। তবে রাজ্জাক সাহেবের যুক্তি ভিন্ন। তিনি মনে করেন, দ্বন্দ্বের শুরু থেকেই তার ভাইদের দোষ অস্বীকার করা যায় না। বিধায় অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া অসমীচীন।
খুব সাবধানে ও ভয়ে ভয়ে মেয়েকে স্কুলে পাঠানো হয়। বিশেষত ছেলের জ্বর হলে তা ডেঙ্গুতে রূপ নেয়। মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর ইচ্ছা রাজ্জাক সাহেবের ছিল না। তবুও মেয়ে তার বান্ধবীদের সঙ্গে স্কুলে যেতে যায়।
রাজ্জাক সাহেবের সব চিন্তাধারার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে হঠাৎ শরীর কেমন যেন করে উঠলো! স্বাভাবিক শরীরে প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগার লক্ষণ। জ্বর ছাড়া কি এমন অনুভূত হয়? বিছানায় গিয়ে তিনি কাঁথা গায়ে দিয়ে অনেক কিছু ভাবতে লাগলেন। ভয় তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে বেশি সময় নেয়নি। এখন তার সম্বল একমাত্র মেয়ে। ছেলে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার পরে তার সম্পত্তির কিছু অংশ ওয়ারিশ হবে ভাই-ভাতিজারা। ভাইদের সঙ্গে রাজ্জাক সাহেবের সম্পর্ক বিশেষ ভালো নেই; খারাপ তা-ও বলা যাবে না। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সম্পত্তির দলিল ও অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানে না। আবার দুদকে রাজ্জাক সাহেবের নামে অভিযোগ আছে। অভিযোগ মূলত তার বসের নামেই করা হয়েছে। এতে রাজ্জাক সাহেবের নামও কোনোভাবে জড়িয়ে যায়। ভয়ে রাজ্জাক সাহেব জবুথবু!
স্ত্রীর ডাকে রাজ্জাক সাহেব সম্বিত ফিরে পেলেন। তিনি এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন, কথা বলতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। কখন কীভাবে তিনি হাসপাতালে এলেন তার মনে নেই। এখনো রাজ্জাক সাহেবের চোখে ঘুম। একদিন আগে তার জ্ঞান ফিরেছে। এখন শরীর আগের চেয়ে ভালো।
মেয়ের জ্বর হয়েছে শুনে রাজ্জাক সাহেবের ঘুম হারাম হয়ে গেল। মেয়েকে তিনি বারবার গাল-মন্দ করলেন। ‘তোদের বারবার বলা সত্ত্বেও ঠিকমতো মশারি খাটাস না। এখন বোঝ ঠ্যালা!’ আর কথা বের হচ্ছে না! একজন তো রাগ করে লম্বা পথ পাড়ি দিলো। রাজ্জাক সাহেবের চোখ দুটো ভিজে গেল। মেয়ে মৃদুকণ্ঠে বলে উঠলো, ‘বাবা, আগেই বলেছিলাম আমরা এই শহরে আর থাকব না। তুমি শুনলে না বাবা!’
রাজ্জাক সাহেব তার অসুস্থ ছেলেকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ছেলে তার কোলেই ছিল। কখন যে প্রাণ চলে গেল টেরই পাওয়া যায়নি! রাতুল অনেক দুর্বল ছিল। ডেঙ্গু জ্বরকে কেন্দ্র করে রাতুলকে বিভিন্ন হাসপাতাল বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট দিচ্ছিল। সর্বোচ্চ চিকিৎসা করানোর জন্য রাজ্জাক সাহেব রেডি ছিলেন। তবুও শেষ রক্ষা হলো না।
মানুষ মানুষকে খুন করলে আহাজারি করা যায়। কখনো পাল্টা আঘাত করা যায়, বিচারও চাওয়া যায়। কিন্তু মশার কামড়ে কেউ মারা গেলে কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়? মানুষ অসহায় বটে!
এসইউ/জেআইএম