২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসা সেবাগ্রহণকারী নারীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩২২ জন সেবাগ্রহণকারী নারীর মধ্যে ১৭৭ জনের আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল। এর মধ্যে ৯৮ জন কখনো না কখনো আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এবং ৫ জন চিকিৎসা নেওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনের পরিসমাপ্তি টেনেছে।
Advertisement
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ২০২১ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসা সেবাগ্রহণকারী নারীদের তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। সংস্থাটি জানায়, ১৭৭ জন নারী আত্মহত্যাপ্রবণ রোগীর মধ্যে ১২২ জনই মাদকাসক্ত ছিল। তাদের মধ্যে ১৬৩ জনের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে এবং ৭৪ জন আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির কমপক্ষে একটি মানসিক রোগ ছিল।
বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর শ্যামলীতে প্রতিষ্ঠানটির স্বাস্থ্য সেক্টরের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনের বিষয় ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা, মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তি এবং আত্মহত্যার উচ্চ ঝুঁকি।’
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস মজুমদার বলেন, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ১৯৯০ সালে মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ‘আহছানিয়া মাদক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করে। ২০০৪ সালে এই কর্মসূচির নাম পরিবর্তন করে অ্যাডিকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড কেয়ার (আমিক) নামকরণ হয়। মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার এই উদ্যেগকে আরও ভালো করার লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ১২ এপ্রিল নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র যাত্রা শুরু করে।
Advertisement
গবেষণায় দেখা গেছে, নারী মাদকাসক্তরা পুরুষ মাদকাসক্তদের তুলনায় মানসিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে তারা আত্মহত্যার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকে। ঝুঁকিপ্রবণ জনগোষ্ঠি হিসেবে মাদকগ্রহণকারীরা আত্নহত্যা প্রবণতার উচ্চঝুঁকির মধ্যে আছে। এর কারণ নিয়ন্ত্রণ বর্হিভূত মাদকগ্রহণ সংশ্লিষ্ট সংকট, বিষণ্নতা, অতিমাত্রায় মাদক গ্রহণের কারণে সিদ্ধান্তহীনতা বা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারা, চিকিৎসার পরেও মাদকমুক্ত থাকতে ব্যর্থ হওয়া, পরিবারের অসহযোগিতা ও সন্দেহ, এবং মাদকাসক্তির কারণে অন্যান্য মানসিক সমস্যা।
আরও পড়ুন> ৮ মাসে ৩৬১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, নারীদের সংখ্যা বেশি
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাধারণ জনগণের তুলনায় অ্যালকোহল ব্যবহারকারীরা ১০ গুণ বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকির মাঝে এবং যারা শিরায় নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে তারা ১৪ গুণ বেশি আত্নহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
এছাড়া বর্তমানে দেশের মাদক ব্যবহারের ধরন পরিবর্তন হয়েছে এবং ইয়াবার সহজলভ্যতার কারণে এর ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইয়াবা উত্তেজক মাদক হিসেবে পরিচিত যা স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণিরা বেশি ব্যবহার করছে।
Advertisement
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ইয়াবা ব্যবহারে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা রোগ দেখা দেয়। এই বিষণ্নতার কারণেও ইয়াবা আসক্তদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি থাকে। আত্মহত্যা প্রবণতার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক রোগের যোগাযোগ নিবিড়। বর্তমান বিশ্বে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্বায়নের কারণে উন্নয়ন ও অবক্ষয় সমান্তরালে চলছে আর এর ফলশ্রুতিতে মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গবেষণার তথ্য বলছে, ৯০ শতাংশ আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির কমপক্ষে একটি মানসিক রোগ থাকে সেগুলোর মধ্যে সব থেকে বেশি দেখা গেছে ডিপ্রেশন। অনেক ক্ষেত্রেই মাদকাসক্ত ব্যক্তির মাঝে কিছু মানসিক সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। আবার মাদকাসক্তি ছাড়াও মানসিক রোগের লক্ষণসমূহ প্রকাশ পায়। এ ধরনের রোগ এবং মানসিক অস্থিরতা আত্মহতার একটি বড় কারণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ৭ লাখেরও বেশি মানুষ প্রতিবছর আত্মহত্যা করে মারা যাচ্ছে। ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হলো আত্মহত্যা। বিশ্বের মোট আত্মহত্যার ৬০ শতাংশ হয় এশিয়াতে। বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে, ২ ভাবে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে, আবেগপ্রবণ হয়ে এবং পরিকল্পনা করে।
সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আত্মহত্যা একটি জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে জাতীয় পর্যায়ে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় যে, আত্মহত্যার গড় হারে ২০১১ সালে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের ৩৮তম দেশ। কিন্তু মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এই দেশ উঠে এসেছে ১০ নম্বর স্থানে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে আত্মহত্যা মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬ জন, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সেটা দ্গুবিণের বেশি ৩৯ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৩২ জন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। কোভিড-১৯ এর সময় ১৪ হাজার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এবং ২০২২ সালে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণগুলো হচ্ছে, শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন, শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতা, পারিবারিক কলহ এবং সম্পর্কের বিচ্ছেদ, মাদকের অপব্যবহার, অর্থনৈতিক সমস্যা, পড়াশোনার চাপ, বেকারত্ব, পারিবারিক আত্মহত্যার ইতিহাস ইত্যাদি।
আত্নহত্যার ঝুঁকির লক্ষণগুলো হচ্ছে, মৌখিক হুমকি, ঘন ঘন মৃত্যু সংক্রান্ত ইচ্ছার কথা বলা, যখন দেখছেন আপনার সন্তান বা কাছের মানুষটি হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে, তার চেহারা, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে উদাসীন বা ওজন খুব দ্রুত বাড়ছে বা কমছে, ফেইসবুক বা সোশাল মিডিয়াতে মৃত্যু নিয়ে বেশি পোস্ট বা ঘটনা দিচ্ছে, শরীরে অপ্রত্যাশিত আঘাতের চিহ্ন ইত্যাদি।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদের সভাপতিত্বে মূল আলোচক হিসেবে আলোচনা করেন কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্রের মনোচিকিৎসক বিশেষজ্ঞ ডা. রাহেনুল ইসলাম। এছাড়াও প্রশ্নোত্তর ও আলোচনা করেন প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র সাইক্লোজিস্ট রাখী গাঙ্গুলী ও কেন্দ্র ব্যবস্থাপক ফারজানা ফেরদৌস।
টিটি/এসএনআর/জেআইএম