মতামত

ক্ষমতায় থাকলে এক সুর বাইরে গেলে ভিন্ন সুর

ব্যবহার ও অপব্যবহার শব্দ দুটি বাংলা অভিধানে পাওয়া যায়। উভয় শব্দ যথাযথ প্রয়োগ না করলে হিতে বিপরীত হয়। তেমনই করুণ অবস্থায় নিমজ্জিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল–বিএনপি। দলটি ক্ষমতায় আসলেই অপব্যবহার করেছে ক্ষমতার। ফলে নানা সময়ে পড়েছে জনমুখী বিরোধিতায়, জনরোষে। জনবিচ্ছিন্ন এই দলটি একারণে আজ ধুঁকে ধুঁকে চলছে। সহজ করে বললে কার্যত জনবিচ্ছিন্ন এখন বিএনপি। এর অন্যতম কারণ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষাঘাতগ্রস্ত নেতৃত্ব।

Advertisement

সেনা ছাউনিতে জন্ম নেওয়া জাতীয়তাবাদী নামধারী দল বিএনপি। দলটির বৈচিত্র্যময় চরিত্রের জন্য আজ লুপ্তপ্রায়। দল ও দলীয় প্রধানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও বক্তৃতার কারণে দলটি নিমজ্জিত। জনগণ তাদের আস্থায় নিতে পারে না। কারণ জনগণের চেয়ে তারা বিদেশীদের কাছে ও দৌড়–ঝাঁপ করে বেশি। তাদের ভাষ্যে মনে হয়, জনগণ নয় বিদেশী কোনো দৈবশক্তি ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে।

বর্তমানে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারেক রহমান। যিনি দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি একজন পলাতক দণ্ডপ্রাপ্ত হত্যাচেষ্টার আসমি। একজন অপরাধীর কাছ থেকে জনগণ কি আশা করবে? তিনি লন্ডনে বসে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন কিংবা আয়মান আল জাওয়াহিরির মতো ভিডিয়ো বার্তায় দলকে নেতৃত্ব দিবেন? একজন নেতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। তিনি যদি বাংলার জনগণকে ভালোবাসতেন তাহলে লন্ডনে বসে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতেন না। দেশে এসে মামলাসমূহ আইনি লড়াই করতেন। কিন্তু সেই সৎ সাহস তার নেই। কারণ কি অপকর্ম করেছেন তা তিনি জানেন।

এসব ভেবে তিনি হয়তো ভিডিয়ো বার্তার মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করে আবারও ক্ষমতায় আসার পথ খুঁজছেন। তাই যদি না হতো, তাহলে তিনি প্রশাসন, পুলিশ ও সশস্ত্রবাহিনীকে কটাক্ষ করে কথা বলতেন না। আর বিদেশীদের দিয়ে চিঠি আর নিন্দা জানানোর জন্য লবিস্ট নিয়োগ করতেন না। তারেক রহমান ক্ষমতায় আসার জন্য যে পরিমাণ অর্থ বিদেশী লবিস্টদের পেছনে খরচ করছেন, সেই অর্থ বাংলাদেশের জনগণের জন্য খরচ করলে অন্ততপক্ষে বিএনপি নামক দলটি অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতো।

Advertisement

এদেশে পরাক্রমশালী মুসলিম লীগ বিলীন হয়েছে। আরও কিছু দল আছে যারা নামসর্বস্ব হয়ে টিকে আছে। সেসব দলও এদেশে বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছে। এসবের বাইরে একমাত্র আওয়ামী লীগই ব্যতিক্রম। কারণ এই দলটি সরাসরি রাজপথ থেকে বেড়ে উঠেছে। এ দলের ইতিহাস অনেক পুরোনো এবং শিকড় অনেক গভীরে গ্রোথিত। দলটি বার বার মার খেয়েছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে স্বমহিমায়। কারণ দলটির রয়েছে অসামান্য কিছু অবদান। দলটি ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ অধিকাংশ অর্জনে নেতৃত্বে দিয়েছেন।

মোদ্দাকথা হলো- জাতীয়তাবাদী নামধারী বিএনপি কিছুদিন পরপর বিদেশী কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হন। তাদের দ্বারা বিবৃতি দেওয়ার চেষ্টা করেন। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় তারা বিদেশীদের নিকট ধরনা দিয়ে সার্বভৌমত্বকে অপমান করেন। অথচ বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার বক্তৃতা ঘেঁটে দেখলে দেখা যায় চিত্রটা সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৯৯৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠার লিড নিউজে তিনটি শোল্ডারে তথ্য উপস্থাপন করা হয় । যার একটি শোল্ডারে প্রতীয়মান হয়- জীবন দিয়ে হলেও সংবিধান, গণতন্ত্র রক্ষা করব। আবার এই প্রতিবেদনের শিরোনাম দেখা যায়- খোলা মন নিয়ে আলোচনায় বসুন: বিরোধী দলের প্রতি প্রধানমন্ত্রী।

এই খবরের বাকি অংশ আট পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কলামে উপ-শিরোনামে লেখা হয় স্বাধনীতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করব- বেগম জিয়া বলেন, দেশের মানুষ তাদের মাতৃভূমি এবং গণতন্ত্রকে ভালবাসে। তিনি আশা প্রকাশ করেন আগামী নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষার পক্ষেই তাদের রায় দেবে-যারা তাদের শাসনামলে দেশকে বিকিয়ে দিয়েছিল তাদের পক্ষে নয়। স্বাধীনতার পরপরই যারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিদেশী প্রভুদের হাতে তুলে দিয়েছিল তারাই এখন ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে বলে বেগম জিয়া উল্লেখ করেন।

এটাই হলো জাতীয়তাবাদী নামধারী বিএনপির প্রকৃত চরিত্র। তারা হলো ঠুটো জগন্নাথ। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দলটি জনগণের নিকটে না গিয়ে বিদেশীদের নিকট ধরনা দেন। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে নিজেদের আত্মসম্মান ভুলে গিয়ে অন্যের সামনে নিজেদের ছোট করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনা। অথচ তাদের অতীতের দিকে নজর দেওয়ার ফুরসৎ নেই।

Advertisement

ক্ষমতায় যাওয়ার অন্ধ বাসনায় দলটি দেশের পবিত্র সংবিধানের বলবৎ আইনও মানতে চায় না। দলটি যখন ক্ষমতায় থাকে তখন সংবিধানের আলোকে নির্বাচন করতে চায়। আর ক্ষমতার বাইরে থাকলে সংবিধানের তোয়াক্কা না করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করে।

বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি ও তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের কিছু বক্তব্য পর্যবেক্ষণে উঠে আসে: ১৯৯৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনের শোল্ডারে প্রতীয়মান হয়- ‘সংবিধানের বাইরে এক পা’ও যাব না।’ বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর জনসভায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।

বিএনপি তরল পদার্থের ন্যায়, যে পাত্রে রাখা হয় সে পাত্রে আকার ধারণ করে। ক্ষমতায় থাকলে এক সুর ,আর ক্ষমতার বাইরে গেলে ভিন্ন সুর। বিএনপি নামক দলটির নীতি-আদর্শ ও নেতা নির্বাচন পুনর্গঠন জরুরি। অন্যথায় জাতীয়তাবাদী নামধারী বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হবে।

আবার এই প্রতিবেদনেরই শিরোনামে দেখা যায়-আন্দোলনে দেশের ক্ষতি করতে দেয়া যায় না। খবরটি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রথম প্রষ্ঠায় চার কলাম শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এতে লেখা হয়: প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পুনরায় নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, সংবিধানবিরোধী এ দাবি মানা সম্ভব নয়। এদেশের মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না, তা করতে দেয়া হবে না।

প্রতিবেদনের আরো কিছু অংশ হলো- শুক্রবার গুলিস্তান গণতন্ত্র স্কয়ারে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় তিনি বলেন, ‘‘আমি আগেও বলেছি নির্বাচনের ৩০ দিন আগে আমি ও আমার সরকার পদত্যাগ করব। এ সময় সরকার কিভাবে চলবে তা আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে তা অবশ্যই সংবিধানের মধ্যে থাকতে হবে।সংবিধানের বাইরে এক আমরা এক পা’ও যাব না।’

ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে বিএনপি সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাহানা তুলছে। যে পদ্ধতিতে ইতোমধ্যে চারটি সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবং টেকসই কোন পদ্ধতি না হওয়ার কারণে সংসদে বাতিল করে নতুন পদ্ধতিতে বিগত দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন তারা আবার আধুনিকতার বাইরে গিয়ে পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণায় উন্মত্ত। আসলে মোটাদাগে বলতে গেলে এসব হলো বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার বাহানা। তাই সেটা জনগণের ভোটে না হোক, অন্তত বিদেশী কোন প্রভু দ্বারা হলেও তাদের চলবে।

আরও একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হলো-১৯৯৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠার লিড নিউজ খোলা মন নিয়ে আলোচনায় বসুনঃ বিরোধী দলের প্রতি প্রধানমন্ত্রী। এই খবরের বাকি অংশ আট পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কলামে উপ- শিরোনামে লেখা হয়: তাদের রাজনীতি ষড়যন্ত্রের- তিনি (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া) বলেন, প্রথম দফায় বিএনপি স্বল্পদিন ক্ষমতায় থাকাকালীন উন্নয়নের যে ধারার সৃষ্টি করেছিল, অগ্রগতির যে ধারা শুরু হয়েছিল তা রোধ করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়। কিন্তু যতদিন জিয়া বেঁচে ছিলেন ততদিন তাদের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি।

জিয়াকে হত্যার পর স্বৈরাচারের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে সেদিন যারা ক্ষমতাচ্যুত করেছিল তারাই আজ আবার নতুন করে স্বৈরাচারের সঙ্গে সঙ্গে আঁতাত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।’ তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় তারা সবসময় নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। জনগণের রায়কে ভয় পায়।

জাতীয়তাবাদী নামধারী বিএনপির কথা ও কাজের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। যে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলার স্থপতিকে হত্যার মাস্টার মাইন্ড। সেই দল যখন অন্যদের বলে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে। তখন সেটা পরিহাস ছাড়া অন্যকিছু মনে হয়না। যে দলের প্রতিষ্ঠাতা উর্দি পরে ক্ষমতা দখলের পর দল গঠন করে সেই দল যখন অন্যদের স্বৈরাচার বলে তখন বাংলার জনগণের হতচকিত হয়ে যায়।

যে দলের প্রতিষ্ঠাতার পুত্র– তারেক রহমানও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটায় তারা কিভাবে বলে অন্যরা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে। বিএনপি যদি জনগণের রায় বিশ্বাস করে তাহলে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার চিন্তা না করে সংবিধানের আলোকে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসার বন্দোবস্ত করুক। অন্যথায় বাংলার পলি মাটির এই নরম মানুষ একবার বিগড়ে গেলে পালানোর পথ পাবে না ষড়যন্ত্রকারী দল বিএনপি ও তাদের নেতৃত্ব।

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতাকারী ও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল বিএনপি। এখন আবার তারাই মীমাংসিত বিষয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সোচ্চার । দলটির চরিত্র বাংলা প্রবাদ - সাপ ও ব্যাঙের গালে চুমু খাওয়ার মতো। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে তারা যেকোন সময় যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পিছপা হয় না।

তাই সেটা অগণতান্ত্রিক হোক আর বিবেকের কাঠগড়ার বিরুদ্ধে হোক। তেমন একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হল- ১৯৯৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় দুই কলাম শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগণতান্ত্রিক দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। আর শিরোনামের শোল্ডারের লেখা ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর জনসভায় খালেদা জিয়া।

বিএনপি তরল পদার্থের ন্যায়, যে পাত্রে রাখা হয় সে পাত্রে আকার ধারণ করে। ক্ষমতায় থাকলে এক সুর ,আর ক্ষমতার বাইরে গেলে ভিন্ন সুর। বিএনপি নামক দলটির নীতি-আদর্শ ও নেতা নির্বাচন পুনর্গঠন জরুরি। অন্যথায় জাতীয়তাবাদী নামধারী বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হবে।

লেখক: প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) ।

এইচআর/জেআইএম