দেশজুড়ে

খুঁটা ছেড়ে ঋণমুক্ত হওয়ার স্বপ্ন বুনছেন উপকূলের জেলেরা

বছরের পর বছর মহাজনের দাদন নিয়ে চলে জেলেদের সংসার, দাদন পরিশোধ করতে করতে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফেরেন তারা। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় মাছ শিকার করা ৯০ শতাংশ জেলের জীবনই এই চক্রে বাঁধা। প্রতি বছর বেড়েই চলেছে তাদের ঋণের বোঝা। এই বোঝা কমাতে জেলেরা এখন মাছ ধরার সেই পুরাতন পদ্ধতি ছেড়ে নতুন পদ্ধতিতে ঝুঁকছেন। এতে লাভবানও হচ্ছেন অনেকে।

Advertisement

জেলেদের এ পদ্ধতিকে স্বাগত জানিয়েছেন মৎস্য গবেষকরা। তারা বলছেন, এতে শুধু জেলেরাই লাভবান হচ্ছেন না রক্ষা পাচ্ছে সমুদ্রের প্রকৃতি ও পরিবেশ।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই যুগেরও বেশি সময় জেলেরা সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় ছোট নৌকা দিয়ে খুঁটা পদ্ধতিতে মাছ আহরণ করে আসছেন। প্রথম দিকে জেলেরা লাভবান হলেও গত ১০-১২ বছর যাবৎ জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সামুদ্রিক মাছের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং বছরে দু’বার সরকারি অবরোধের কারণে লাখ লাখ টাকা ঋণী হয়ে অনেক জেলে এলাকা ছেড়েছেন। তবে যারা এই পেশাকে আঁকড়ে রেখেছেন তারা এবার পদ্ধতি পরিবর্তন করে ঋণমুক্ত হওয়ার স্বপ্ন বুনছেন।

আরও পড়ুন: অপচিকিৎসার জালে বন্দি উপকূলের জেলেরা

Advertisement

একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত দশ বছরে উপকূলের প্রায় ৯৫ শতাংশ জেলে এই খুঁটা পদ্ধতিতে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। তবে বর্তমানে ৭০ শতাংশ জেলে মাছ ধরার ভাসমান পদ্ধতিতে গিয়ে শতভাগ লাভবান হচ্ছেন। অর্থের সংকটে যারা এখনো খুঁটা পদ্ধতিতে রয়েছেন তারাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন পদ্ধতি পরিবর্তনের।

খুঁটা পদ্ধতির চেয়ে ভাসমান পদ্ধতিতে তুলনামূলক খরচ কম, জেলেদের জীবনের নিরাপত্তা, মাছ ধরার সরঞ্জামাদি নষ্ট হওয়ার শঙ্কা কম, একবার তৈরি করা মালামাল দিয়ে দীর্ঘদিন মাছ ধরতে পারা, সময় সাশ্রয়, পাশাপাশি অন্য পেশায় সময় দিয়ে বাড়তি আয় করা ও কম জনবলে বেশি কাজ করতে পারায় নতুন পদ্ধতিতে ঝুঁকছেন জেলেরা।

খুঁটা পদ্ধতি

বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে জেলেরা সমুদ্রের মাঝে ৪-৫ ফুট লম্বা বাঁশের তৈরি খুঁটা বসিয়ে তার সঙ্গে ১৫০-২০০ হাত লম্বা ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ ধরার জাল আটকে রেখে আসেন। এরপর দৈনিক দুইবার জোয়ারের শেষের দিকে ছোট নৌকা দিয়ে রেখে আসা ওই জাল থেকে মাছ আনতে যান। কিন্তু জাল সমুদ্রে থেকে যাওয়ায় অনেক সময় ওই জালের ওপর দিয়ে বিভিন্ন বড় ট্রলার বা নৌযান চলাচলের কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে তারা। প্রতিদিন ওই জাল তুলতে যেতে হয় জেলেদের। এমনকি বৈরী আবহাওয়াতেও তাদের যেতে হয়। আর এতে জেলেদের জীবনের ঝুঁকি বাড়ে। বৈরী আবহাওয়ায় সমুদ্র উত্তাল থাকলে অতিরিক্ত জনবল প্রয়োজন হয়, যাতে আর্থিকভাবে সংকটে পড়েন তারা।

Advertisement

ভাসমান পদ্ধতি

খুঁটা পদ্ধতিতে ব্যবহার করা নৌকার থেকে সামান্য বড় একটি নৌকায় একটি মাত্র জাল তোলেন জেলেরা। ওই জালের দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৫-৭ হাজার হাত, প্রতিদিন একবার সমুদ্রে গিয়ে ১০-১২ ঘণ্টা অবস্থান করে ওই জাল দিয়ে মাছ ধরে নিয়ে আসেন তারা। ভাসমান পদ্ধতিতে জেলেদের সমুদ্রে জাল রেখে আসতে হয় না। প্রতিমাসে আমাবস্যা ও পূর্ণিমার ওপর নির্ভর করে ১৫-২০ দিন মাছ ধরার সুযোগ পান জেলেরা।

আরও পড়ুন:ডাকাত আতঙ্ক নিয়ে উপকূলে ফিরছেন জেলেরা

কুয়াকাটার ঝাউবন এলাকার জেলে আবুল কালাম জাগো নিউজকে বলেন, আমি গত ১৫ বছর জেলে পেশায় ৯ লাখ টাকা ঋণী হয়েছি। তারপরেও টিকে থাকতে এই পেশায় থেকে পদ্ধতি পরিবর্তন করে গত এক বছরে লাভবান হচ্ছি। তাই বর্তমানে আমরা বেশিরভাগ জেলে ভাসমান পদ্ধতি বেছে নিয়েছি। বর্তমানের অবস্থা বজায় থাকলে আমরা শিগগিরই এই ঋণ পরিশোধ করতে পারবো বলে আশা করছি।

জেলেদের সংগঠন ‘আশার আলো’র সভাপতি নিজাম শেখ জাগো নিউজকে বলেন, এই পদ্ধতিতে জেলেদের মালামাল নষ্ট কম হয়, সঙ্গে খুঁটা পদ্ধতিতে যে পরিমাণ ঋণী হচ্ছেন জেলেরা সেই সংখ্যাটাও কমছে। যার ফলে আমরা জেলেদের উৎসাহ ও সহযোগিতা করছি এই পদ্ধতিতে মাছ শিকার করতে।

সমুদ্রের সুনীল অর্থনীতি, উপকূলের পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-২ বাংলাদেশ প্রকল্পের সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি জাগো নিউজকে বলেন, মাঠ পর্যায়ে আমরা ২০১৮ সাল থেকে জেলেদের সচেতনতায় কাজ করছি, যার ফলে উপকূলের জেলেরা এখন অনেকটা পরিবেশ রক্ষা করে মাছ শিকার করছেন। জেলেদের এই ভাসমান পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হওয়াটা সুখবর বলবো, কারণ এর ফলে সমুদ্রের নাব্য রক্ষা, কচ্ছপ, ডলফিনসহ সমুদ্রের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখে এমন প্রাণীও হুমকি থেকে বেঁচে যাবে। এছাড়াও মাছ ধরার জন্য যে খুঁটাগুলো তীরবর্তী এলাকায় বসানো হয় ভাটার সময় এইসব স্থানে পর্যটকরা চলাচল করেন। যার ফলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও বাড়ে। আমরা কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে চেষ্টা করবো খুঁটামুক্ত বঙ্গোপসাগর রাখতে, তাহলে আমাদের সমুদ্র অনেকটা নিরাপদ থাকবে।

আরও পড়ুন: কুয়াকাটার ক্ষুদ্র জেলেদের জীবন যুদ্ধ চলছেই

কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জাগো নিউজকে বলেন, এই উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার জেলে রয়েছেন যার মধ্যে ১৮ হাজার ৩০৫ জন নিবন্ধিত। এদের মধ্যে কুয়াকাটা, গঙামতি, চাপলি, ধুলাস্বার, লেম্বুরবনের বেশিরভাগ জেলেই খুঁটা পদ্ধতিতে ঝুঁকেছিলেন। তাদের এই পদ্ধতি পরিবর্তনকে আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাই। খুঁটা পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সমুদ্রের মোহনা এলাকায় পলি জমা হয়ে নাব্য হারায়, যার ফলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ প্রজনন সমস্যায় পড়ে। এতে সামুদ্রিক মাছের সংখ্যা দিনদিন কমে যায়। তাই সরকার বর্তমানে জেলেদের চালসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়াচ্ছে। এরপরও যদি তাদের কোনো দাবি-দাওয়া থাকে আমরা পূরণের চেষ্টা করবো।

এফএ/জিকেএস