গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার মোক্তারপুর রাথুরা গ্রামের সিংহভাগ মানুষ গত দেড় যুগ ধরে বিলেতি ধনে পাতা চাষ করছেন। ধনে পাতাই এখন তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ। একদিকে তারা যেমন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, অন্যদিকে কর্মসংস্থানও হচ্ছে স্থানীয় মানুষের। পাশাপাশি এ উপজেলার উৎপাদিত পাতা রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে।
Advertisement
সরেজমিনে জানা যায়, নারী-পুরুষ দলবেঁধে জমি থেকে ধনে পাতা তুলছে। কেউ কেউ ফসলি জমি থেকে পাতা তুলে আনছেন। গাছের নিচে বসে কয়েকজন পাতা থেকে ময়লা ছাড়াচ্ছেন। কলা গাছের খোলসের অংশ দিয়ে বানানো রশি দিয়ে তা আঁটি বাঁধার কাজ করছেন। পাতার আঁটি বাঁশের খাঁচা ভরে রাখছেন। কেউ কেউ বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িপাল্লায় তা ওজন করছেন। কেউ আবার মাথায় কাপড় বেঁধে পাতার খাঁচা মাথায় নিয়ে ছুটছেন বাজারে। এ কাজে বেশি ভূমিকা রাখছেন নারী শ্রমিকরা।
রাথুরা গ্রামের কয়েকজন নারী শ্রমিক জানান, এক সময় তাদের সংসারে অনেক অভাব-অনটন ছিল। এখন তারা ধনে পাতার ক্ষেতে কাজ করে স্বচ্ছলতা এনেছেন। তা দিয়েই সংসার চালাচ্ছেন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত নারী শ্রমিকরা কাজ করেন। প্রতি ১ কেজি বেছে দিলে ৩ টাকা পাওয়া যায়। এতে তাদের সারাদিন প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার কাজ হয়।
আরও পড়ুন: ড্রাগন চাষে জীবন বদলেছে চম্পা বেগমের
Advertisement
মোক্তারপুর ইউনিয়নের নামা রাথুরা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব চাষি ধীরেন্দ্র মন্ডল বলেন, ‘আমি ১০ শতাংশ জমিতে বিলেতি ধনে চাষ করেছি। ১ লাখ টাকা খরচ করে প্রায় ৩ লাখ টাকার পাতা বিক্রি করেছি। জমিতে ধনে পাতার ভালো চাষ হওয়ায় কম খরচে বেশি লাভবান হয়েছি। জমিতে পাতা হলে পাতা উঠাই। আঁটি বেঁধে বিক্রি করি। এলাকার হাট-বাজারে কম চলে। ঢাকায় বেশি বিক্রি হয়। ঢাকা থেকে লোকজন এসে বসে থাকে। পাতার চাহিদা আছে।’
একই গ্রামের ষাটোর্ধ্ব নারী চাষি বিলাশ মনি বলেন, ‘আমি ১ বিঘা জমিতে বিলেতি ধনে পাতা চাষ করেছি। এ কাজে শুধু আমি নিজে না, আশপাশের মানুষদের সহযোগিতায় ধনে পাতা চাষ করেছি। তবে এক বিঘা জমিতে ভালো ফলন হলে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৩ লাখ টাকা আয় হয়।’ একই কথা বলেন উত্তর রাথুরা গ্রামের নিরমনি দাস।
চাষি পরিতোষ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘আমি ৩৫ শতাংশ জমিতে ধনে পাতা চাষ করেছি। গত ৮ বছর ধরে এ ফসল চাষ করছি। মেয়েরা ভালোভাবে লেখাপড়া করছে। জমিতে খরচ হয়েছে ২ লাখ টাকা। তিন ধাপে পাতা ওঠানো যাবে। বিক্রিও করা যাবে। প্রথম ধাপে বেশি বিক্রি হয়, দ্বিতীয় ধাপে একই রকম। তৃতীয় ধাপে কিছুটা কম উৎপাদন হয়। তিন ধাপে ৯ হাজার কেজি পাতা ওঠাতে পারবো বলে আশা করছি।’
আরও পড়ুন: রাস্তার পাশে ৪০০ পেঁপে গাছ লাগিয়ে আলতাফের বাজিমাৎ
Advertisement
রাথুরা গ্রামের হরিদাস বলেন, ‘গ্রামের শতাধিক পরিবারের সদস্যরা ধনে পাতা চাষ করছেন। একেক পরিবারের ৪-৫ জন করে কাজ করছেন। এতে অনেক মানুষের কর্মসস্থান হয়েছে। এ অঞ্চলে ২০০৭ সাল থেকে ধনে পাতার চাষাবাদ শুরু হয়েছে। প্রথম প্রথম পাতার বীজ সংগ্রহ করে এলাকায় চাষাবাদ হতো। এখন অনেকেই বীজ তৈরি করতে পারেন। দূর থেকে বীজ কিনে আনতে হয় না। মুষ্টি ও কেজি হিসেবে বাজারে বিক্রি হয়।’
সুমিত্রা বলেন, ‘ধনে পাতা খুব লাভজনক ফসল। বিশেষ করে এই গ্রামে নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বেকার নারী বা অসুস্থরাও এ কাজ করতে পারেন। আমি ১৪০-১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। ১৭ শতাংশ জমিতে চাষ করেছি। ৪ হাজার কেজি পাতা বিক্রি করবো। ১৫০ টাকা কেজিতে ৪ হাজার কেজির দাম পাবো প্রায় ৬ লাখ টাকা। এ ধনে পাতার ভর্তা, বড়া, চাটনি, তরকারি ও ছোট মাছের সঙ্গে খেতে খুব মজা। খাবার পরিবেশনেও ব্যবহার করেন অনেকে।’
এরশাদ মিয়া বলেন, ‘এ বছর আমার বীজ ছিল না। ৬ হাজার টাকায় বীজ কিনেছি। ১ বিঘা জমিতে ৬ কেজি বীজ লাগে। হাল চাষ করে জমি উপযোগী করতে হয়। ঘাস মারতে হয়। সার-গোবর দিতে হয়। মাটি দিয়ে ছোট ছোট আইল বানাতে হয়। আইলের ফাঁকে ঘর তৈরি করতে হয়। পরে মাটি দিয়ে টালি বানাই। পানি দিই। পানি শুকিয়ে বীজ দিই। ১৮ দিন হলে চারা গজালে নিড়ানির কাজ শুরু করি। আবারও সার-গোবর দিতে হয়। কীটনাশক খুব একটা লাগে না। ৬ মাস হলে পাতা ওঠানো শুরু করি।’
ধনে পাতার পাইকার শাহ আলম বাশার বলেন, ‘আমি ধনে পাতা কিনে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় বিভিন্ন আড়ৎ ও হোটেলে চড়া দামে বিক্রি করি।’
আরও পড়ুন: কাজী পেয়ারার চারা কখন রোপণ করবেন?
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আজিজুর রহমান রুবেল বলেন, ‘বর্তমানে ১৫-২০ হেক্টর জমিতে বিলেতি ধনে পাতা চাষ করে প্রায় ১ হাজার কৃষকের কর্ম নির্ভরতার স্থান হয়েছে। তবে এ কাজে নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বেশি হয়েছে এবং তাদের সংসারে আয় বেড়েছে।’
উপজেলা উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘কালীগঞ্জে বিলেতি ধনে পাতার চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২ বছরে দুই-চার বিঘা জমিতে চাষ হলেও এখন তা প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে ছড়িয়েছে। উপজেলাটি ঢাকার খুব লাগোয়া হওয়ায় কৃষকরা সরাসরি মার্কেটিং করে অনেক বেশি লাভবান হোন। বিঘাপ্রতি ২ লাখ টাকা খরচ হলে তা প্রায় ৫ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারছেন।’
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ ফারজানা তাসলিম বলেন, ‘বিলেতি ধনে পাতা লাভজনক ফসল। এটি নিজেই একটি মেডিসিনাল প্লেন হিসেবে ব্যহৃত হয়। এতে রোগবালাই কম হয়। তাছাড়া যেসব এলাকায় বিলেতি ধনে চাষ হয়, ওইসব এলাকায় সুন্দর একটি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কালীগঞ্জের বিলেতি ধনে পাতা বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।’
আব্দুর রহমান আরমান/এসইউ/জিকেএস