অর্থনীতি

খর্ব হবে দুদকের ক্ষমতা, দায়মুক্তির সুযোগ পাবেন অপরাধীরা

নতুন আয়কর আইনে আরও কঠিন হয়েছে করদাতার আয়কর নথির তথ্য পাওয়া। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণের দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। বরাবরই আয়কর দাতার তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দিতে গড়িমসি করার অভিযোগ রয়েছে এনবিআরের বিরুদ্ধে। এখন তথ্য পেতে যেতে হবে আদালত পর্যন্ত। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন দুদক।

Advertisement

দুদক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিযুক্তদের আয়-ব্যয় নথি পেতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও অন্য পদক্ষেপ নিতে দেরি হচ্ছে। নতুন আয়কর আইনে আয়কর নথি পেতে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে দুর্নীতির অপরাধ অনুসন্ধান ও বিচার প্রক্রিয়া আরও ধীরগতির হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: বিদেশে স্থায়ী হতেও লাগবে কর সনদ, তল্লাশি-জব্দে অসীম ক্ষমতা

বলা হচ্ছে, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্টদের আয়কর নথি, সম্পদের হিসাবসহ সব তথ্য-উপাত্ত তলব করে যাচাই-বাছাই করার ক্ষমতা রয়েছে দুদকের। সংস্থাটির আইনেও তা স্পষ্ট। চলতি বছর পাস হওয়া নতুন আয়কর আইন-২০২৩-এ অভিযুক্ত ব্যক্তির আয়কর রিটার্ন তলবের ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

Advertisement

এ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে গত ৯ আগস্ট এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে বৈঠক করেন দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনবিআর ভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে নতুন আয়কর আইনের ফলে দুদকের জটিলতার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। তবে বৈঠক থেকে এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক পরিচালক জাগো নিউজকে বলেন, তারা (এনবিআর) তাদের আইন নিয়েই আছে। সেখান থেকে সরবে না। আদালতের মাধ্যমে নথি আদান-প্রদান হলে দুপক্ষেরই জটিলতা বাড়বে।

সংসদে পাস হওয়া আয়কর আইন-২০২৩-এর ৩০৯-এর (২) উপধারায় বলা আছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছু থাকুক না কেন, এ ধারার বিধান সাপেক্ষে সব বিবরণ বা তথ্য গোপনীয় থাকবে এবং সেটি প্রকাশ করা যাবে না। সাক্ষ্য আইন-১৯৭২, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ বা অন্য কোনো আইনে যা কিছু থাকুক না কেন সংশ্লিষ্ট রিটার্ন বা রেকর্ড প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী কর্তৃক উপস্থাপনের নির্দেশ প্রদান বা সাক্ষ্য প্রমাণ তলব করিতে পারিবে না।’

আরও পড়ুন: সহজ হচ্ছে কোম্পানি রিটার্ন দাখিল, বিদেশে সম্পদ থাকলেই জরিমানা

Advertisement

একই আইনের ৩০৯ ধারার ৩ (আ) উপধারায় উল্লেখ আছে, ‘তবে দণ্ডবিধি-১৮৬০ ও দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর অধীনে শর্ত থাকে যে, যে ক্ষেত্রে তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনীয় কোনো কাগজাদি বা কোনো বিবৃতি, রিটার্ন হিসাব, দলিলাদি, সাক্ষ্য, হলফনামা বা জমাকৃত বিষয়াদি প্রকাশ বা প্রদানের বিষয়ে আমলি আদালত আদেশ করিবে কেবল সেসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বা কোনো বিবৃতি, রিটার্ন হিসাব, দলিলাদি, সাক্ষ্য, হলফনামা বা জমাকৃত বিষয়াদি প্রকাশ বা প্রদান করা যাইবে।’

অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২০ ধারা অনুযায়ী, অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষমতা পেয়ে দুদকের কর্মকর্তারা অনুসন্ধানের সময় এ আইনের ১৯ ধারার বিধান অনুযায়ী চাহিদাপত্র বা রিকুইজিশন দিয়ে আয়কর সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেন। এছাড়া দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (সিআরপিসি), ১৮৯৮-এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী তদন্তকালে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র জব্দ করে আদালতে উপস্থাপন করা হয়।

দুদক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন আয়কর আইন-২০২৩-এর ৩০৯ ধারা সংযুক্ত হওয়ার কারণে দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত হবে। কর্মকর্তারা আগের মত আয়কর সংক্রান্ত তথ্য সহজে সংগ্রহ করতে পারবেন না। তদন্তের প্রয়োজনে আয়কর সংশ্লিষ্ট রেকর্ড বা নথিপত্র পেতে প্রতিটি অভিযোগের ক্ষেত্রে পৃথকভাবে আমলি আদালতে আবেদন করে রেকর্ড বা নথিপত্র সংগ্রহের জন্য অনুমতি নিতে হবে। এতে সময়ক্ষেপণ, অর্থ অপচয়সহ নানা জটিলতার সৃষ্টি হবে। তারা বলছেন, নতুন আইনের ফলে দুদকের ক্ষমতা খর্ব হবে এবং অপরাধীরা দায়মুক্তির সুযোগ পাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, আগেও সরাসরি আয়কর নথি নেওয়ার সুযোগ ছিল না দুদকের। তবে দুদক কর্মকর্তারা সেটা আনঅফিসিয়ালি নিতেন। এখন সেটা অফিসিয়ালি নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছ। এটি নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। কী সিদ্ধান্ত হয় সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন: শূন্য রিটার্নেও ন্যূনতম কর না দিলে মিলবে না ৩৮ সেবা

এ প্রসঙ্গে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, নতুন আইনের ফলে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। আগে আমরা সরাসরি প্রয়োজনীয় তথ্য পেতাম। এখন তা সংগ্রহ করতে আদালতের অনুমতি লাগবে। এতে দুদকের হয়রানি যেমন বাড়বে, আদালতে মামলার সংখ্যাও বাড়বে।

নতুন আইনটির বিষয়ে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত এমন কোনো অভিযোগ পাইনি যে অনুসন্ধান করতে গিয়ে কর্মকর্তারা বাধা পেয়েছেন। যদি কর্মকর্তারা বাধার কথা জানান তাহলে সেটা কমিশনের নজরে নিয়ে আসা হবে।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের যে জিরো টলারেন্সের প্রতিশ্রুতি রয়েছে নতুন আইনে সে প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ হয়েছে। আইনটি পাস হওয়ায় দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তির সুযোগ আরও জোরদার হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজস্ব বোর্ডের একজন সদস্য বলেন, দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। এর ফলে সুশাসন নিশ্চিত হয়। দুদকের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরাও দুদকের মত একই ভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করি। যেমন- কেউ একজন কর ফাঁকি দিলে সেটা নিয়েও আমরা কাজ করি।

আগের আয়কর অধ্যাদেশের সঙ্গে নতুন আইনে বড় কোনো মৌলিক পরিবর্তন নেই। তবে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন- কোম্পানির সংজ্ঞা পরিবর্তন; কোম্পানিকে প্রতি মাসে উৎসে করের রিটার্ন দাখিল; রিটার্নের প্রমাণ দাখিলে বাধ্যবাধকতায় আরও পাঁচ খাত যুক্ত, বিদেশে ঘুরতে গেলে সম্পদের তথ্য দেওয়া ইত্যাদি। আবার নতুন আইনে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাতিলের সুযোগ রাখা হয়েছে। বাড়িভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসায় সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে নতুন আইনে প্রত্যেক টিআইএনধারীর দুই হাজার টাকা বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন দেওয়ার বিধান বাতিল করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: ন্যূনতম আয়কর ২ হাজার টাকা

রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে রিটার্ন জমা সহজ করতে আয়কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা কমিয়ে জাতীয় সংসদে স্থিরকৃত আকারে ‘আয়কর বিল-২০২৩’ পাস হয়। নতুন আইনে করবর্ষের শেষ তারিখে ৪০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ থাকলে, বছরের কোনো সময়ে চিকিৎসা বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বিদেশ ভ্রমণ করলে সম্পদ ও দায়ের বিবরণী জমা দেয়া (রিটার্ন) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়াও নতুন আইনে কালো টাকা সাদা করার স্থায়ী সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।

দুদক বা অন্য কোনো সংস্থা তথ্য চাইলে রাজস্ব কর্মকর্তারা যা করতে পারবেন সেটি আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪-তে বলা আছে। অধ্যাদেশটির ১৬৩ ধারায় বলা হয়েছে, অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট বা বাংলাদেশে বলবৎ অন্য যে কোনো আইন থাকুক না কেন, কোনো অথরিটিকে তথ্য দেওয়া যাবে না। আয়কর অধ্যাদেশ, পেনাল কোড অফেন্স, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী তদন্ত পর্যায়ে কোনো সংস্থাকে তথ্য দেওয়ার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন: বাজেটে রাজস্ব ব্যবস্থার অটোমেশন চায় বেসরকারি খাত

এছাড়া ১৬৮ ধারায় বলা হয়েছে, করদাতার তথ্য অন্য কারও কাছে প্রকাশ দণ্ডনীয় অপরাধ। মানিলন্ডারিং ও টেরোরিস্ট ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় তথ্য দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সেখানেও শর্ত আছে। অনেক সময় দেখা যায় দুদক কর্মকর্তারা ঢালাওভাবে করদাতার ১০ বছরের বা তারও আগের তথ্য চান, নতুন আয়কর আইনে তো সেই সুযোগ নেই।

এসএম/এমকেআর/এএসএম