মামুন রাফী
Advertisement
সম্প্রতি একের পর এক বীভৎস কায়দায় শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আইন থাকার পরও শিশুদের প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা বাসা বাড়িতে সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলছে। এসব নির্মম আচরণের এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে আমাদের সমাজে। ফলে স্কুলে শিশুদের ওপর দৈহিক নির্যাতন করলেও নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এই শাস্তির কারণে অনেক শিশু লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে এমন নজিরও রয়েছে অনেক। এই আচরণের পেছনে কাজ করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এজন্য আমাদের সামাজিক ও প্রচলিত নেতিবাচক আচরণগুলোকে পাল্টাতে হবে। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তিগতভাবেও পদক্ষেপ নিতে হবে।
বড়দের নিষ্ঠুরতার কাছে শিশুরা সবচেয়ে অসহায়। সেই নিষ্ঠুরতা অনেক সময় বাবা-মার কাছ থেকেও আসে, বাইরের মানুষ থেকেও আসে। সব থেকে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে সুরক্ষা। শিশুরা নিরাপদ নয়। শিশুর নিরাপত্তা খুব জরুরি। শান্তিপূর্ণভাবে বাস করার নিরাপত্তা। স্কুলে আসা-যাওয়ার নিরাপত্তা। খেলাধুলা-বিনোদনের নিরাপত্তা। মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার নিরাপত্তা। স্বাভাবিক সুস্থ জীবনযাপন করার নিরাপত্তা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য একটি সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারিনি। সেজন্য শিশুরা নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হলেও তার সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন: ৬০০ পুরুষকে হত্যা করেছেন যে নারী
Advertisement
পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, ২০২১ সালে ১৮৩টি শিশু হত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। ২০২২ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯৭টিতে। তবে এই এক বছরে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৪১৯টি। যা ২০২১ সালের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। এছাড়া এই এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া শিশু নিয়ে সংবাদ প্রকাশও বেড়েছে প্রায় তিন গুণ, যা সংখ্যা ১৯৬টি।
এমজেএফের শিশু পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২২’ শিরোনামে করা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, এক বছরে ১২টি ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। সেগুলো হলো-যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, সড়ক দুর্ঘটনা, অন্যান্য দুর্ঘটনা, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, আত্মহত্যা, অপরাধে সংশ্লিষ্ট শিশু, নিখোঁজ ও পানিতে ডুবে মৃত্যু। এসব ক্ষেত্রে ২০২১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪২৬টি। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯৪, অর্থাৎ এক বছরে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর হার বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। এছাড়া ২০২১ সালে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিল ৪১ হাজার ৯৫টি শিশু। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩০১, যা আগের বছরের তুলনায় ৯৪ শতাংশ কম।
আরও পড়ুন: মৃৎশিল্প: বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্ম
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনার বাইরে ৩১১টি শিশু অন্যান্য দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এই বছরে ৫৬০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা আগের বছরের (২০২১) তুলনায় প্রায় ৩২ শতাংশ কম। ২০২২ সালে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে ৯৮টি শিশু, যা আগের তুলনায় কিছুটা বেশি। এ ছাড়া ২০২২ সালে ৯৬টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার, ৩০ শিশু অপহরণ, ৬৮ শিশু নির্যাতন, ৩৩ শিশু নিখোঁজ ও ৯টি শিশুর বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্ট হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়ে ৪৪টি শিশুর আত্মহত্যা করার খবর এসেছে সংবাদপত্রগুলোতে।
Advertisement
বাবা-মার কাছে সন্তান সবসময় আদরের, ভালোবাসার। কিন্তু অনেকসময় সন্তানদের লালন পালনের ক্ষেত্রে বাবা মা শিশুদের মারধর করেন, যা একদমই উচিত নয়। শারীরিক নির্যাতনের ফলে শিশুদের মানসিক ক্ষতি হয়। আমাদের দেশে পজেটিভ প্যারেন্টিং নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নেই, এমনকি প্যারেন্টিং এর ব্যাপারেও নেই। আমরা আমাদের শিশুকে কীভাবে লালন পালন করব তা অবশ্যই জানতে হবে। নিয়মিত শারীরিক আঘাত ও বকাঝকা ফলে অনেক ক্ষেত্রে শিশু মানসিকভাবে ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ে।
শিশু নির্যাতন রোধে আপনার প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে নিজে আগে জানা যে, কী উপায়ে আপনার শিশুকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারবেন। একইসঙ্গে আপনার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও বিস্তারিতভাবে জানাতে হবে শিশু নির্যাতন সম্পর্কে এবং সঙ্গে তাদেরকেও বোঝাতে হবে প্রতিরোধের উপায়গুলো। তবে যদি শিশুর মধ্যে নির্যাতিত হওয়ার কোনো লক্ষণ পেয়ে থাকেন, তবে দেরি না করে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিন। যত দ্রুত আপনি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন, আপনার সন্তানের জন্য ততই তা মঙ্গলজনক হবে। ছোট শিশুদের ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। ছোট শিশুরা প্রতিহত করতে পারে না, ভয়ে ঘটনা গোপন করে। ফলে তারা প্রতিবেশী ও স্বজনদের মাধ্যমে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন করতে গণমাধ্যম অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক।
কেএসকে/এমএস