গত ১ সেপ্টেম্বর ছিল দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সেনাবাহিনীর পোশাক পরে, রাষ্ট্রপতির পদে থেকে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেছিলেন। সে হিসেবে বিএনপির বয়স ৪৫ বছর হলো।
Advertisement
মানুষের ক্ষেত্রে সাধারণত শতায়ু কামনা করা হয়। কারণ সাধারণত খুব কম সংখ্যক মানুষই শত বছরের বেশি বাঁচে। কিন্তু রাজনৈতিক দল শত বছরের বেশি বাঁচতে পারে, বাঁচে সে তথ্য আমাদের জানা। কমিউনিস্ট পার্টির বয়স শত বছরের বেশি। ভারতের কংগ্রেসও শত বছর অতিক্রম করছে। মুসলিম লীগও তাই। তবে এ দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় মুসলিম লীগ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এবং মানুষের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে না পারার কারণেই সাধারণত কোনো রাজনৈতিক দল প্রাসঙ্গিকতা হারায়, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আমাদের দেশের অন্যতম দুটি জনপ্রিয় দল। আওয়ামী লীগ বয়সে বিএনপির চেয়ে প্রবীণ। বিএনপি আওয়ামী লীগের তুলনায় নবীন। তবে ৪৫ বছর একটি রাজনৈতিক দলের জন্য একেবারে কম সময় নয়।
৪৫ বছর পরও বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বিএনপি আজও টিকে আছে। যদিও ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে ১৬ বছর ধরে দলটি নানা সংকটে ধুঁকছে। নেতৃত্ব সংকটের চাপা আক্ষেপ বিরাজ করছে দলটির সব স্তরে।
Advertisement
বিএনপির মূল শক্তি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। শারীরিক অসুস্থতা, আইনি জটিলতাসহ পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি আর রাজনীতিতে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবেন সেটা নিশ্চিত নয়।
খালেদা জিয়ার অবর্তমানে একক কর্তৃত্ব ধরে রেখে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আইনের দৃষ্টিতে লন্ডনে পালিয়ে থাকা তারেক রহমান। তিনিও দণ্ডিত আসামি। দেশে ফিরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার অবস্থায় তিনি আছেন বলে শোনা যায় না। এ অবস্থায় বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল, সন্দেহ-সংশয় ও সমন্বয়হীনতার বিষয়টি অস্পষ্ট নয়।
সেজন্যই এখন কারও কারও মনে প্রশ্ন উঠছে, বিএনপির কি আর উত্থানের সম্ভাবনা নেই? অথবা বিএনপি কি মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করবে? আমরা সবাই জানি, মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাঙালির স্বার্থবিরোধী অবস্থান নিয়ে মুসলিম লীগ দ্রুতই এই ভূখণ্ডে নিজের কবর রচনা করে। তারপর আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। মুসলিম লীগ নামে দল বাংলাদেশে এখনও আছে কিন্তু একেবারেই নাম ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাঙালির শীর্ষ এবং খ্যাতিমান নেতারা এই দলের গৌরবের পতাকা বহন করছেন। সব থেকে বড় কথা, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এই দলের নাড়িপোতা হয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগ এখন অবিভাজ্য নাম ও সত্তা।
Advertisement
আওয়ামী লীগের বিকাশ ও উত্থান অনেক বন্ধুর পথ ধরেই হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম মুছে ফেলার যে ঘৃণ্য নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল তা প্রতিহত ও বানচাল করা সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় এবং দেশকে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সম্ভব হয়েছে।
রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবে বিএনপি এখন দুঃসময় অতিক্রম করছে। তারপরও এক দফা দাবি অর্থাৎ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে দলটি। বিএনপির নেতারা বলছেন, দলের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ে রাজপথে সর্বশক্তি নিয়ে সরব থাকা। তবে এর আগে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য জনমত তৈরি করা।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু করলেও ভোট নিয়ে আপাতত ভাবছে না বিএনপি। দলটির সব মনোযোগ এখন আন্দোলনে। যদিও কেউ কেউ মনে করেন, আন্দোলনের পাশাপাশি ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী প্রস্তুতিও রয়েছে বিএনপির।
দলটির সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আন্দোলনে সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে তারা। সরকার যদি এ দাবি উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়, বিএনপি তা প্রতিহত করবে এবং সেই নির্বাচনে অংশ নেবে না। ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির এবার আন্দোলনে জেতাটাই একমাত্র লক্ষ্য।
আওয়ামী লীগবিরোধী সব শক্তি এক হয়ে নানা কৌশল করছে ঠিকই, কিন্তু তাতে সরকারকে কি খুব ভীত বলে মনে হচ্ছে? ২ সেপ্টেম্বর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার স্পষ্ট কথা, এই মাটি আমাদের। কাজেই ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। ভয়কে জয় করে বাংলাদেশের জনগণ তার উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে।’ শেখ হাসিনা যে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তা কখনো ব্যর্থ হয় না। এবারও পথের সব কাঁটা অপসারণ করে শেখ হাসিনা জয়ের পথেই যাত্রা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবেন বলে অনেকেই মনে করেন।
কিন্তু এক দফার আন্দোলনে বিএনপি কি বিজয় অর্জন করতে পারবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি একটি অবাস্তব অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষে দলের যে শক্ত অবস্থান; শীর্ষ নেতারা শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারবে কি না তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। দলটির একাংশ নির্বাচন বয়কটের পক্ষে নয় বলেও শোনা যায়। এসব নেতা মনে করেন, সরকার যদি অতীতের মতো আরেকটি নির্বাচন করে উতরে যায়, তাহলে রাজনৈতিকভাবে বিএনপির ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে।
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোর মধ্যে এখনো অটুট ঐক্য গড়ে ওঠেনি। নির্বাচন সামনে রেখে ছোট দলগুলো নানা হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিতে সরকার নানা উদ্যোগ নিতে পারে বলেও বাজারে কথা চালু আছে। অনেক দলকে চাপের পাশাপাশি নানা সুযোগ-সুবিধার আশ্বাস দিয়ে জোট থেকে বের করে নেওয়ার চেষ্টা চলতে পারে। কোনো দল যুগপৎ আন্দোলন থেকে বেরিয়ে গেলে সেটা নেতিবাচক বার্তা দেবে।
অবশ্য বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, নানা প্রতিবন্ধকতায়ও অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিএনপি এখন বেশি শক্তিশালী। সরকারের হামলা-মামলা মোকাবিলা করে দলটি মাঠে আছে। গত এক বছর বিএনপি দাবি আদায়ে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে রয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তারা দেখাতে সক্ষম হয়েছে, তারা অহিংস পথে লড়াই করছে। কিছু ইতিবাচক ফলও তারা পেয়েছে। নেতারা বলছেন, এই ৪৫ বছরে বহুবার বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু সেসব চেষ্টা সফল হয়নি। বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে পারেনি। সেটাই এখন বিএনপির বড় শক্তি।
বিগত দুটি নির্বাচন শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে প্রতিহতের ডাক দিয়েছিল। কিন্তু সেই নির্বাচন ঠেকানো সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ তখন বিজয়ী হয় এবং টানা দ্বিতীয় বারের মতো সরকার গঠন করে। ওই সময় নির্বাচন নিয়ে মধ্যস্থতা করতে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসেছিলেন। তার উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বৈঠকও হয়।
বিএনপি নেতাদের দাবি, তখন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচনের পর দ্রুততম সময়ে আরেকটি নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছিল সরকার। কিন্তু পরে তারা কথা রাখেনি। এরপর নান রকম টালবাহানা শেষে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশায় প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সংলাপেও গিয়েছিলেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রার্থী মনোয়ন নিয়ে চরম খামখেয়ালিপনা করে অনাকাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করে দলটি। মাত্র সাতটি আসনে বিজয়ী হয়।
সেই অভিজ্ঞতা থেকে এবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপি। এক দফা দাবিতে গত ১২ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করেছে তারা, যেখানে অর্ধশত দল সম্পৃক্ত। জানা গেছে, মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে এক দফার আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি নিয়ে ফের মাঠে নামার চিন্তা রয়েছে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের।
লক্ষ্য অর্জন পর্যন্ত সেই আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা। জানা গেছে, সেই পর্যায়ে কর্মসূচি হবে সম্পূর্ণ ঢাকাকেন্দ্রিক। বিচারালয়ের সামনে অবস্থান ছাড়াও নির্বাচন কমিশন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আসবে। এর সঙ্গে টানা অবস্থান কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তাও রয়েছে বিএনপির হাইকমান্ডের।
এসব করে সরকারকে ফেলে দেওয়া যাবে বলে কারা বিশ্বাস করছে? আওয়ামী লীগবিরোধী সব শক্তি এক হয়ে নানা কৌশল করছে ঠিকই, কিন্তু তাতে সরকারকে কি খুব ভীত বলে মনে হচ্ছে? ২ সেপ্টেম্বর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার স্পষ্ট কথা, এই মাটি আমাদের। কাজেই ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। ভয়কে জয় করে বাংলাদেশের জনগণ তার উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে।’
শেখ হাসিনা যে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তা কখনো ব্যর্থ হয় না। এবারও পথের সব কাঁটা অপসারণ করে শেখ হাসিনা জয়ের পথেই যাত্রা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবেন বলে অনেকেই মনে করেন।
০৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস