নিত্যপণ্যের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি করে চলছে ব্যবসায়ীদের একটি চক্র। সাধারণ ক্রেতার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে এই ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভের পরিণতিতে। দায় পড়ে সরকারের ওপর। মানুষ বাজারে গিয়ে শর্ষে ফুল দেখে আর সরকারকে গালি দেয়। অন্যদিকে সরাসরি সরকারও দায় এড়াতে পারে না। কারণ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিত্যপণ্যের বাজারকে সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার দায়িত্ব সরকারের।
Advertisement
ব্যবসায়ীদের ওই চক্রকে দমন ও বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সফল কি ব্যর্থ? এটাও মূল্যায়নের সূত্র হচ্ছে এই বাজার পরিস্থিতি। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের বারবার ঘোষণার পরও বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব-পার্বণ এর সামনে এ প্রবণতা বেশি বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে।
দ্রব্যমূল্য অযৌক্তিক হলে সরকারকে ব্যর্থ হিসেবে আখ্যায়িত করে ক্রেতা সাধারণ। পরের ধাপে সিন্ডিকেটকে দায়ী করে তারা। যেহেতু সিন্ডিকেট সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে তাই একচেটিয়াভাবে সরকারকে দোষারোপ করাটাই চোখে পড়ে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশ এখন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় থেকে আসা। ফলে সিন্ডিকেট মানে সরকার এমন একটা ধারণাও পোষণ করে কেউ কেউ।
সাধারণ মানুষ সরকারের ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সরকারি নীতিমালারও সমালোচনা করে। তাদের বক্তব্য রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ীরা, সরকারে ও সংসদে ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য। যে কারণে সরকারকে ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা জনদুর্ভোগ বাড়াতে দ্বিধা করে না। যে কারণে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রতিবন্ধক এই সিন্ডিকেট ভাঙার সদিচ্ছা থাকলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
Advertisement
এই সিন্ডিকেটের বিষয়টি এতদিন ক্রেতাদের মুখে মুখে থাকলেও সম্প্রতি সরকারি পর্যায়েও মেনে নেওয়া হয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক সাইফুল আলম প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানতে চান, ‘সিন্ডিকেটের কথা দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও বলেন। তারা বলেন, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যায় না। সেখানে হাত দিতে গেলে বিপদ আছে। আমরা মনে করি, সরকার অত্যন্ত শক্তিশালী। সরকার দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে।’ এই নিত্যপণ্যের মৌসুমি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে কি না।’
তিনজন মন্ত্রী যখন বলেন সিন্ডিকেট আছে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় কিংবা কঠিন হবে, স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চ মহলে গুরুত্বসহ ভাবার প্রয়োজন আছে। প্রকাশিত সংবাদগুলো প্রমাণ করে এই দুষ্টচক্র সরকারের জন্য বড় আকারের চ্যালেঞ্জ হিসেবে আভির্ভূত হয়েছে।
সেই সংবাদ সম্মেলনে শুধু বাণিজ্যমন্ত্রীর নাম আসে। প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করবেন বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু পরদিন ৩০ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, তিনি ওইভাবে কথাগুলো বলেননি। বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী যদি তিনি নাও বলেন, কিন্তু কৃষিমন্ত্রী এবং খাদ্যমন্ত্রীও তো এই সিন্ডিকেটের কথা বলেছেন।
পত্রিকাগুলোর সংবাদে দেখা যায় কৃষিমন্ত্রী এবং খাদ্যমন্ত্রীও সিন্ডিকেটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। শুধু তাই নয়, গত ২৬ জুন জাতীয় সংসদের অধিবেসনেও বাণিজ্যমন্ত্রীকে তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল দ্রব্যমূল্য প্রশ্নে বিশেষত এই সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে। বাণিজ্যমন্ত্রীর যোগসাজশ রয়েছে সিন্ডিকেটের সঙ্গে এমন অভিযোগও কোনো কোনো সংসদ সদস্যের মধ্য থেকে উচ্চারিত হয়েছিল।
Advertisement
তখন বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। এটা ঠিক বড় বড় গ্রুপ একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে। চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। তবে আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার, আমরা জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম; সেটা হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে, সেটাও তো সইতে আমাদের কষ্ট হবে। এজন্য আমরা আলোচনার মাধ্যমে নিয়মের মধ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।’ ( যুগান্তর,২৬ জুন ২০২৩)
এর আগে ২০২২ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, খাদ্যমন্ত্রীও সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয় বলে মনে মন্তব্য করেছেন। সিন্ডিকেট ভাঙার ব্যাপারে তিনি সাংবাদিকদেরও সহযোগিতা চেয়ে বলেছিলেন, ‘দেশে চালের বাজারে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে সিন্ডিকেট আছে, তা ভাঙা সম্ভব নয় বলে মনে করেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। ওই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব কি না— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়।’
কৃষিমন্ত্রীও সিন্ডিকেটের বিষয়ে তার মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম- এ ২১ আগস্ট ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, তিনি বলেছেন, ‘নিত্যপণ্যের বাজারে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙা অনেক কঠিন, এবার বলেছেন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, ইচ্ছা করলেই মনিটরিং করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দাম নির্ভর করবে সরবরাহের ওপর।’
তিনজন মন্ত্রী যখন বলেন সিন্ডিকেট আছে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় কিংবা কঠিন হবে, স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চ মহলে গুরুত্বসহ ভাবার প্রয়োজন আছে। প্রকাশিত সংবাদগুলো প্রমাণ করে এই দুষ্টচক্র সরকারের জন্য বড় আকারের চ্যালেঞ্জ হিসেবে আভির্ভূত হয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, সিন্ডিকেট আছে। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে অবৈধ উপায়ে পণ্যের মূল্য বাড়ায়। আর যেহেতু সরকারিভাবেও তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে, এই সিন্ডিকেট বাণিজ্য তাদেরও সমর্থনযোগ্য নয় বলেও প্রকাশ হয়, তাই সিন্ডিকেট ভাঙার কার্যকর উদ্যোগ প্রত্যাশা সবার। কারা সিন্ডিকেট পরিচালনা করে সেটা বের করা খুব কঠিন কাজ বলে মনে করি না।
সরকারের ভেতর যদি সিন্ডিকেটওয়ালার নাও থাকে তাও এটা অসম্ভব কিছু নয়। আর বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ক্রাইসিস তৈরি হবে, সেটাও কতটা যৌক্তিক ভাবতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা উৎসাহ বোধ করে অনিয়ম-অন্যায্য ব্যবসা পরিচালনা করে সরকারের দুর্নাম তৈরিতে। মানুষও দুর্ভোগে পড়ে, সিন্ডিকেটের অপকর্মের কারণে। এটা কি ক্রাইসিস নয়? যদি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ব্যবসায়ীরা ক্রাইসিস তৈরি করে সেই ক্রাইসিসের চেয়ে মূল্য বাড়িয়ে যে ক্রাইসিস তৈরি করা হয় সেটা কি অধিক ক্ষতিকর নয়?
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে জনগণ সরকারকে সমালোচনার পরিবর্তে প্রশংসা করবে। অন্যদিকে সিন্ডিকেটের দৌড়তো এক-দুদিন ধর্মঘট করা। এমনিতেই মানুষ অতিষ্ঠ, দু-চারদিন ক্রাইসিস থাকলে সেটা মানুষ ইতিবাচকভাবেই দেখবে। তবু অন্তত এই সিন্ডিকেটের হাতে জনগণ ও সরকার যেন আর জিম্মি হয়ে না থাকে সেই উদ্যোগই সরকারকে নিতে হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম