নানান ছাড় আর লোভনীয় অফারে প্রথমে টানেন ক্রেতা। যথাসময়ে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলে গ্রাহকের কাছ থেকে নেন টাকা। একই প্রলোভন দেখান ভূমির মালিককেও। কাজও শুরু হয়। কিন্তু চলছে তো চলছেই। শেষ হয় না। রিহ্যাবে অভিযোগ দিলেও হয় না কাজ। নানান অজুহাতে করতে থাকেন সময়ক্ষেপণ। মাস যায়, বছর যায় কিন্তু প্রকল্পের কাজ আর শেষ হয় না।
Advertisement
এমন অভিযোগ নব উদ্যোগ লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান নগর ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে। কোম্পানির অন্তরালে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) পরিচালক প্রকৌশলী এ কে সেলিম স্বয়ং করছেন এ প্রতারণা।
আরও পড়ুন>> সরকারি কর্মকর্তারা পাবেন ১১২ আবাসিক ফ্ল্যাট, ব্যয় ৯৮ কোটি
ভুক্তভোগীরা প্রকৌশলী এ কে সেলিমের বিরুদ্ধে একাধিক চিঠি দিয়েছেন রিহ্যাবে। এতে বলা হয়েছে, ভূমি মালিক ও ক্রেতাকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিচ্ছেন না রিহ্যাব পরিচালক প্রকৌশলী এ কে সেলিম।
Advertisement
জানা যায়, তাকে জমি দিয়ে ফ্ল্যাট বুঝে না পাওয়ার কষ্ট সইতে না পেরে মারা গেছেন একজন ভূমি মালিক আক্তারী বেগম। তার ওয়ারিশরাও এখন পর্যন্ত নিজেদের ফ্ল্যাট বুঝে পাননি।
‘অভিযোগ অস্বীকার করে এ কে সেলিম বলেন, ‘অভিযোগকারী তিনজন কিন্তু দলিল করে ফ্ল্যাট বুঝে নিয়েছেন। আমার দুটো ফ্ল্যাট বিক্রি বাকি; এখন জমির মালিকদের সঙ্গে মিলে তা হাতিয়ে নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। রিহ্যাবে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, রিহ্যাব তো সমস্যার সমাধান করেই দিয়েছে, ক্রেতা মানেননি। এরপরও দখল করা হয়েছে।’
এক যুগে একাধিক অভিযোগ দেওয়ার পর রিহ্যাব থেকে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য নগর ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও প্রকৌশলী এ কে সেলিমকে চিঠি দিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি। মিটিংয়ে হাজির থাকছেন না তিনি। রিহ্যাবের মেডিয়েশন অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস স্ট্যান্ডিং কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমান কমিটিও বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও তিনি সাড়া দিচ্ছেন না।
আরও পড়ুন>> রডের বাজার ফের চড়া, টন ছাড়ালো ৯৪ হাজার
Advertisement
তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন জমির মালিক ও ফ্ল্যাট ক্রেতার অভিযোগ রয়েছে রিহ্যাবে। বেশ কয়েকজন ক্রেতা ফ্ল্যাট বুঝে না পেয়ে হতাশার মধ্যে রয়েছেন। তারাও রিহ্যাবে অভিযোগ জমা দেবেন বলে জানা যায়। রিহ্যাব থেকে মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া বর্তমান নেতাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন প্রকৌশলী এ কে সেলিম।
‘অভিযোগের বিষয়ে রিহ্যাবের সহ-সভাপতি বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পাওয়ার পর এ কে সেলিমের সঙ্গে বসার উদ্যোগ নিয়েছি। কেন তিনি ফ্ল্যাট হস্তান্তর করতে পারছেন না, তার কথা শুনতে চেয়েছি। কিন্তু তিনি আসেননি। এটা সমাধান হতে পারে না। নোটিশ দেওয়া হলেও জবাব দেননি। রিহ্যাবের যে সুনাম তা ধরে রাখতে হবে, ক্রেতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার অন্যকে আকর্ষণ করে।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৭ সালে ২২/১৪ খিলজী রোডের মোহাম্মাদপুরে আক্তারী বেগমের সঙ্গে ৯ দশমিক ৫৫ কাঠা জমিতে ১৪তলা ভবন করার চুক্তি করেন প্রকৌশলী এ কে সেলিম। নানাভাবে সময়ক্ষেপণ করে তিনি ভবন নির্মাণ করতে দেরি করেন। এতে নানান জটিলতা তৈরি হয়। চুক্তির পাঁচ বছর পর কষ্ট সইতে না পেরে মারা যান ভূমি মালিক আক্তারী বেগম। এরপর আরও এক দশক পেরিয়ে গেলেও তার ওয়ারিশরা এখনো ফ্ল্যাট বুঝে পাননি। রিহ্যাবে অভিযোগ দেন আক্তারী বেগমের ওয়ারিশরা। এ বিষয়ে জাগো নিউজের হাতে বেশ কিছু নথি এসেছে।
আরও পড়ুন>> ‘আপ্যায়ন’ ব্যয়ে আরও ৬৫ লাখ টাকা আবদার
২০১১ সালে মোহাম্মাদপুর তাজমহল রোডে নগর রোজেটা নামে একটি প্রকল্প শুরু করে বেশ কয়েকজনের কাছে ফ্ল্যাট বিক্রি করেন প্রকৌশলী এ কে সেলিম। কিন্তু প্রকল্প শুরুর এক দশক হলেও তাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিচ্ছেন না তিনি। নিরুপায় হয়ে তারা রিহ্যাবে অভিযোগ দেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ আবাসন ব্যবসায়ীর আরও বেশকিছু প্রকল্পের অবস্থাও একই। টাকা বুঝে নিলেও বুঝিয়ে দিচ্ছেন না ফ্ল্যাট।
রিহ্যাব সূত্র জানায়, প্রকৌশলী এ কে সেলিম বেশ প্রভাবশালী। বর্তমানে প্রকল্প কাজ বন্ধ রেখে নির্বাচনের জন্য কাজ করছেন তিনি। অন্যদিকে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে পথে পথে ঘুরছেন ক্রেতারা। তবে, রিহ্যাব থেকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের আপস নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হলে তিনি সাড়া দিচ্ছেন না। রিহ্যাব মিটিংয়েও হাজির থাকছেন না। উল্টো বিষয়টি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়ায় রিহ্যাবের বর্তমান নেতাদের ওপর চটেছেন।
আরও পড়ুন>> আবাসনে লাগামছাড়া ব্যয়, অভিযোগের অন্ত নেই ক্রেতার
রিহ্যাবের কার্যালয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সিরাজুল ইসলাম নামে একজন ক্রেতার। সিরাজুল ইসলাম মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকেন। রিহ্যাব পরিচালক এ কে সেলিমের প্রতারণার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সিরাজুল জানান, তার সব সঞ্চয় দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। এক দশক পেরিয়ে গেলেও ফ্ল্যাট বুঝে পাননি। প্রকৌশলী এ কে সেলিম একজন বড় প্রতারক।
কথা হয় অন্য ভুক্তভোগী ও জমির মালিক খান রবিউল আহসানের সঙ্গে। মোহাম্মদপুরের ১৫/১ তাজমহল রোডের জমির মালিক রবিউল জাগো নিউজকে বলেন, ২০১০ সালে এ কে সেলিমের সঙ্গে চুক্তি করেছিলাম। জমি হস্তান্তর (হ্যান্ডওভার) হয় ২০১২ সালে। কথা ছিল ৩৩ মাস পর অর্থাৎ ২০১৪ সালের নভেম্বরে জমির মালিক হিসেবে আমাদের পাওনা ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি দেননি। এ নিয়ে আমরা রিহ্যাবে অভিযোগ করেছি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমাদের মনে হয়েছে উনি (সেলিম) ভালো লোক না। প্র্যাকটিক্যালি দেখলাম তাকে, ভালো কথা বলে কাজ শুরু করলেও এখনো ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে পারেননি। কাজ পড়ে আছে।
আরও পড়ুন>> নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি: প্রায় অর্ধেকে নেমেছে ফ্ল্যাট বিক্রি
এসব বিষয়ে কথা হলে অভিযোগ অস্বীকার করে নগর ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও প্রকৌশলী এ কে সেলিম বলেন, ‘আমাদের মোহাম্মদপুরের কয়েকটা প্রজেক্টে সমস্যা হয়েছে। আমরাতো বড় বড় কোম্পানির মতো শক্তিশালী না। অন্য কোম্পানির হলে ‘খান পরিবার’ দখলে নিতে পারতো না। আমার প্রজেক্ট ক্রেতারাই জোর করে দখলে নিয়েছে। আইন কী, আইন নেই, এটা কী করতে পারেন? এ নিয়ে মামলা রয়েছে, দেখি কী হয়।’
এ কে সেলিম বলেন, ‘অভিযোগকারীর তিনজন কিন্তু ফ্ল্যাট বুঝে নিয়েছেন, দলিল করে নিয়েছেন। আমার দুটো ফ্ল্যাট বিক্রি বাকি ছিল, জমির মালিকদের সঙ্গে মিলে সেগুলো হাতিয়ে নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।’
রিহ্যাবে অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘রিহ্যাবতো সমস্যার সমাধান করেই দিয়েছে ক্রেতা মানেননি। এরপরও দখল করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন>> দুবাইয়ের পাম জুমেইরায় বাড়ি কিনলে বিশাল ছাড়
তবে অভিযোগ নিষ্পত্তি নিয়ে রিহ্যাব থেকে বলা হয় ভিন্ন কথা। এ নিয়ে কথা হলে রিহ্যাবের সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ বলেন, যে কোনো প্রকল্প ব্যবসায়ীরা শুরু করবেন এটা স্বাভাবিক। অনেকের কাছে বিক্রি হয় চলমান প্রকল্পের ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট। কিন্তু কোনো ডেভেলপার কোম্পানি ক্রেতাকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেবেন না এটা হতে পারে না। আমাদের ক্রেতা বাঁচলে ব্যবসা বাঁচবে, ব্যবসার সুনাম হবে।
রিহ্যাবের এ নেতা বলেন, আমরা ক্রেতাদের অভিযোগ পাওয়ার পর এ কে সেলিমের সঙ্গে বসার উদ্যোগ নিয়েছি। কেন তিনি ফ্ল্যাট হস্তান্তর করতে পারছেন না, তার কথা শুনতে চেয়েছি। কিন্তু তিনি আসেননি। এটা সমাধান হতে পারে না। নোটিশ দেওয়া হলেও জবাব দেন না। রিহ্যাবের যে সুনাম তা ধরে রাখতে হবে, ক্রেতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার অন্য ক্রেতাকে আকর্ষণ করে।
ইএআর/এমএএইচ/এএসএ/জেআইএম