পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার নিউমার্কেট চত্বর। কেনাকাটা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, সাজগোজের সবকিছুই প্রায় এক ছাতার নিচে পাওয়া যায় সেখানে। স্বাভাবিক ভাবেই বিদেশিদের কাছে বিশেষ করে বাংলাদেশিদের কাছে অত্যন্ত পছন্দের জায়গা এই নিউমার্কেট। অনেকের কাছেই আবার মিনি বাংলাদেশ বলেও পরিচিত।
Advertisement
বাংলাদেশি পর্যটকরা কলকাতায় পা রেখেই নিউমার্কেটের মার্কুইস স্ট্রিট, কিডস স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, টটিলেনসহ বিভিন্ন জায়গার হোটেলেই অবস্থান করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো এখানে বাংলাদেশি নাগরিকরা কতটা নিরাপদ ও সুরক্ষিত?
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ১৪ কেজি সোনা উদ্ধার পশ্চিমবঙ্গে, আটক ২
সম্প্রতি বাংলাদেশি পর্যটকরা নিউমার্কেট এলাকায় রাতের বেলায় ছিনতাই, বহিরাগতদের উপস্থিতিসহ কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, যে কোনো মৌসুমে নিউমার্কেটে এসে হোটেল না পাওয়া কিংবা অতিরিক্ত পয়সা দিয়ে হোটেল বুক করার অভিযোগও ওঠে।
Advertisement
এমনও দেখা গেছে যে, হোটেল রুম না পেয়ে রাস্তায়ই রাত কাটাতে হয়েছে পর্যটকদের। বিশেষ করে বড়দিন, বছরের শেষ দিনে এরকম ঘটনা সামনে আসে। এর ওপর রয়েছে বাংলাদেশি পর্যটকদের ভিসা সমস্যা। এসব কারণে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও দাবি করা হয়।
খুব দ্রুত যেন এই সমস্যার সমাধান করা যায়, ছোট ছোট যে বিক্ষিপ্ত ঘটনা হচ্ছে তা যেন শূন্যে নামিয়ে আনা যায় সে লক্ষ্যেই এক মতবিনিময় সভা হয়েছে কলকাতায়।
মার্কুইস স্ট্রিটের হোটেল এমারেল্ডে যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন, মার্কুইস স্ট্রিট ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিট রেসিডেন্সিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, হোটেল এবং রেস্তোরাঁ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, নিউমার্কেট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন।
বাংলাদেশি পর্যটকদের ক্ষেত্রে ভিসা সরলীকরণের দাবি তুলে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনোতোষ কুমার সাহা জানান, নিউমার্কেট এলাকা মূলত বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ভিসা সমস্যার কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশি পর্যটকদের আগমন অনেক কমে গেছে। ফলে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
Advertisement
কয়েক মাস আগেও যেখানে দৈনিক পাঁচ হাজার পর্যটক আসতেন, সেখানে পাঁচ শতাধিক পর্যটকও আসছেন না। দ্বিতীয়ত ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তে অভিবাসন দপ্তরেও বাংলাদেশি পর্যটকদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সর্বোপরি যারা কলকাতায় আসছেন সেসব পর্যটকরা কিভাবে এখানে সুরক্ষিত থাকতে পারেন মূলত সেসব বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে।
নিউমার্কেট সুরক্ষিত নয় এটি মানতে রাজি নন কটন গ্যালারির কর্ণধার কামরুদ্দিন মালিক। তার মতে, ছোটখাটো বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটে এটা সত্যি। তবে সেই ঘটনাও যাতে না ঘটে সেটা নিশ্চিতের জন্য আমরা আজ মিলিত হয়েছি। বাংলাদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কথা ভেবে খুব শিগগির পুরো নিউমার্কেট চত্বরে বসানো হচ্ছে সিসি ক্যামেরা। এর পাশাপাশি চালু করা হবে হেল্পডেস্ক। কোনো বিপদে পড়ে ফোন করলেই সমস্যার সমাধান হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি পর্যটকরা আমাদের কাছে লক্ষ্মী। তাই তাদের নিরাপত্তা সুরক্ষা করা, ভালো পরিষেবা দেওয়ার জন্য যদি আমাদের খরচ করতে হয় সেখানে কোনো অসুবিধা নেই।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনিয়ে সদস্য মনোতোষ সরকার জানান, বাংলাদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের ভ্রমণ ঝামেলা মুক্ত করার বিষয়েও আলোচনা করা হয়। যদিও কলকাতা অনেক নিরাপদ একটি শহর। বাংলাদেশিরাও সেখানে যথেষ্ট নিরাপদ। তিনি বলেন, হকারজনিত একটা সমস্যা হয়েছিল সেটা আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে মেটানোর চেষ্টা করছি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকেও আমরা সহায়তা পাচ্ছি। তার মতে, ভিসা সমস্যাই বড় আকার ধারণ করেছে। এই সমস্যা যেন দ্রুত সমাধান করা যায় সেই আবেদন জানানো হয়।
আরও পড়ুন: এক বছরে ৬১ কোটি বোতল মদ বিক্রি দিল্লি সরকারের, আয় কত?
বাংলাদেশিদের সুরক্ষার জন্য ৩২টি সিসি ক্যামেরা লাগানো হবে। মার্কুইস স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, নিউমার্কেট ফ্রি স্কুল স্ট্রিট সিসি ক্যামেরায় মুড়ে ফেলা হবে। পাশাপাশি মার্কেট অ্যাসোসিয়েশন এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি হেল্পডেস্ক করা হবে। কোনো বাংলাদেশি পর্যটক সমস্যার সম্মুখীন হলেই সেখানে ফোন করলেই সপ্তাহের ৭ দিন ২৪ ঘণ্টাই তাদের সহায়তা প্রদান করা হবে।
শ্যামলী পরিবহনের কর্ণধার অবনী ঘোষ জানান, আগে যেখানে ৫ থেকে ৬ হাজার পর্যটক আসতো সেই সংখ্যা এখন কমে গেছে। তিনটি কারণে এখানে পর্যটকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে ভিসা দেওয়া হচ্ছে না।
তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে আমরা দাবি করে যাচ্ছি, এসব এলাকার পর্যটকদের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিতে সব ধরনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই এলাকায় বাংলাদেশি পর্যটকদের সুরক্ষার জন্য সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়াও এখানে একটি কন্ট্রোল রুমও খোলা হবে।
তিনি আরও বলেন, এখানে এত পর্যটক আসছে হোটেলে ঠিকভাবে জায়গা দেওয়া যায় না। এছাড়াও এখানে কয়েকজন হোটেল মালিক বলেন, আমরা ভাড়া ঠিকভাবেই নিচ্ছি। কিছু কিছু অভিযোগ পর্যটকরা করছে সেই অভিযোগের মধ্যেও সত্যতা আছে। আমাদের আজকের এই বৈঠকে আলোচনা হলো আমরা সংঘবদ্ধ ভাবে যেন এই অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি এবং এর সমাধান বের করতে পারি। অনেকের মধ্যেই লোভ আছে। কেউ দেখছে ১৫০০ রুপির ভাড়া যদি ২০০০ রুপিতে পাই খারাপ কী, এটা কিন্তু সাময়িক।
কলকাতার ঐতিহ্যশালী চর্ম শিল্প ব্যবসায়ী শ্রীলেদার্সের মালিক সত্যব্রত দে বলেন, আমি নিজেও বাংলাদেশের লোক। আমি চাইব যে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোনো পার্থক্য যেন না থাকে। কারণ আমাদের খাওয়া-দাওয়া সংস্কৃতি ঐতিহ্য সবকিছুই এক। আমরা চাই সেই সম্পর্ক দিন দিন যেন বাড়ে। যদিও কলকাতায় বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এদিকে কলকাতায় ঘুরতে আসা বাংলাদেশের সিলেটের বাসিন্দা কোবির আহমেদ বলেন, আমি কলকাতায় দু’তিন বছর ধরে আসছি এবং এই নিউমার্কেট এলাকা অনেক নিরাপদ জায়গা। এখানে চলাফেরায় আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। পকেটমার বা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতে পারে কিন্তু আমাদের সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। তবে সিসি ক্যামেরা লাগালে আমাদের নিরাপত্তা আরও বাড়বে।
আরও পড়ুন: কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ছাড়া ভারতের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক অসম্ভব
কলকাতায় চিকিৎসা করাতে আসা বাংলাদেশের সিলেটের বাসিন্দা শেখ মো: বাদশা বলেন, হয়তো অন্য কারও সঙ্গে পকেটমার বা ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। সিসি ক্যামেরা লাগালে এবং কন্ট্রোলরুম খুললে এতে পর্যটকরা আরও নিরাপদে কলকাতায় ঘুরতে পারবেন।
এছাড়াও রাতে হকারদের নিয়ে যে সমস্যা ছিল কলকাতা প্রশাসনের সাহায্যে সেই সমস্যাও অনেকটাই মেটানো সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করেন সংগঠনের কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে তারা বলেন, বিদেশি পর্যটকদের সুরক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন মার্কুইস স্ট্রিট ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা।
ডিডি/টিটিএন