দেশজুড়ে

‘রোদে বসে ক্লাস করতে কষ্ট হয় আমাদের’

ভোলায় রাতের আঁধারে স্কুল ভেঙে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সুপারি গাছ রোপণের অভিযোগ উঠেছে স্কুল কমিটির সাবেক সভাপতি ও তার ছেলের বিরুদ্ধে। এদিকে স্কুল হারিয়ে বাধ্য হয়ে খোলা আকাশের নিচে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন শিক্ষকরা।

Advertisement

ঘটনাটি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মধ্য চর আইচা কো-ইড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড গরম ও রোদের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে বসে পাঠদান চলছে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চর মানিকা ইউনিয়নের এক কপাট এলাকার মধ্য চর আইচা কো-ইড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অস্ট্রেলিয়ান কো-অপারেশন ইন ডেভেলপমেন্ট’র পরিচালনায় ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যালয়টি। ওই বিদ্যালয়ের জন্য ২৪ শতাংশ করে মোট ৪৮ শতাংশ জমি দান করেন স্থানীয় ফাতেমা খাতুন ও বশির উল্লাহ। ফাতেমা খাতুনের দান করা জমিতে টিনশেড ঘর নির্মাণ করে পাঠদান করা হতো। পরে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদ্যালয়টির নতুন ভবনের কাজ শুরু হলে পুরোনো স্কুলের একটু পাশে একটি অস্থায়ী টিনশেড ঘরে পাঠদান শুরু করে বিদ্যালয়টি।

কিন্তু গত ২৫ আগস্ট ভোরের দিকে বিদ্যালয়টির অস্থায়ী টিনশেড ঘরটি ভেঙে মালামালসহ গায়েব করে দেন অভিযুক্তরা। এরপর থেকেই খোলা আকাশের নিচে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন শিক্ষকরা।

Advertisement

ওই স্কুলের শিক্ষার্থী মো. আরিফ, মো. জিসান, রুপা আক্তার ও মো. শাকিব জানায়, তাদের বিদ্যালয়টি ভেঙে ফেলার পর থেকে তারা খোলা আকাশের নিচে ক্লাস করছে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে তারা অনেক কষ্ট করে বসে ক্লাস করছে। বৃষ্টি এলে তারা গাছের নিচে বা আশপাশের কারও বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

অভিভাবক মো. রফিক ও কুলসুম বেগম জানান, তাদের ছেলে-মেয়েরা দীর্ঘদিন ধরে মধ্য চর আইচা কো-ইড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। কিন্তু কয়েকদিন আগে স্কুলটি ভেঙে ফেলার কারণে শিক্ষকরা খোলা আকাশের নিজে ক্লাস করাচ্ছেন। এতে ঠিকমতো ক্লাস হয় না। আর রোদের কারণে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তারাও ক্লাস করতে চায় না। এতে তাদের সন্তানদের পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। তারা দ্রুত বিদ্যালয়টি আগের মতো স্কুলঘরে পরিচালনার জন্য দাবি করেন।

মধ্য চর আইচা কো-ইড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম ও জোনায়েত উল্লাহ জানান, তারা অস্থায়ী টিনশেডের ঘরে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে আসছিলেন। ২৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার তারা পরীক্ষা শেষে স্কুল বন্ধ করে সবাই বাড়ি চলে যান। এরপর রোববার স্কুলে এসে দেখেন সেখানে কোনো স্কুলঘর নেই।

তারা আরও জানান, গত ২৫ আগস্ট শুক্রবার ভোরের দিকে তাদের বিদ্যালয়টির সাবেক সভাপতি মো. বশির উল্লাহ ও তার ছেলে বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক এমদাদুল হক বাকের লোকজন দিয়ে অস্থায়ী টিনশেড ঘরটি ভাঙচুর করে মালামালসহ গায়েব করে দেন। তাই তারা বাদ্য হয়ে খোলা আকাশের নিচে পাঠদান করছেন। এতেও অভিযুক্তরা তাদের বাধা ও হুমকি দিচ্ছেন।

Advertisement

তারা আরও জানান, খোলা আকাশের নিচে পাঠদানের কারণে অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাই অনেক অভিভাবকরা তাদের শিশুদের ক্লাস করতে পাঠান না। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থায় তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর সুষ্ঠু বিচারের দাবি করেন।

অস্ট্রেলিয়ান কো-অপারেশন ইন ডেভেলপমেন্টের চরফ্যাশন উপজেলার সমন্বয়ক মো. রিয়াজ জানান, ২০০৬ সালের প্রতিষ্ঠিত হয় ওই বিদ্যালয়টি। পরে ২০২০ সালে দিকে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদ্যালয়টির নতুন ভবনের কাজ শুরু হলে পুরাতন স্কুলের একটু পাশে একটি অস্থায়ী টিনশেড ঘরে ক্লাস পরিচালিত হচ্ছিল বিদ্যালয়টি। নতুন ভবনের কাজ ৮০ ভাগ শেষ হলে হঠাৎ করে পূর্ব চর আইচা আদর্শ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি স্কুলের ভবন দাবি করেন মো. বশির উল্লাহ ও তার ছেলে এমদাদুল হক বাকের। আর আমাদের মধ্য চর আইচা কো-ইড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্থায়ী টিনশেড ঘরটি ভেঙে ফেলার হুমকি দেন। পরে অভিযুক্তরা টিনশেড ঘরটি ভেঙে মালামালসহ গায়েব দিয়েছেন। তারা স্কুলের স্থানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সুপারি গাছের চারা রোপণ করেছেন। এ ঘটনায় আমরা দক্ষিণ আইচা থানায় একটি মামলা করলেও কোনো প্রতিকার পাইনি। আমরা এ ঘটনার দোষীদের বিচার চাই।

তিনি আরও জানান, অভিযুক্তরা পূর্ব চর আইচা আদর্শ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে জাতীয়করণ করতে আমাদের বিদ্যালয়ে ভাঙচুর করেছেন। অভিযুক্তদের বিশ্বাস আমাদের বিদ্যালয় থাকলে তাদের স্কুলটি জাতীয়করণ হবে না। তাই তারা এসব করেছেন।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত মো. বশির উল্লাহ ও তার ছেলে এমদাদুল হক বাকের সব অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, মধ্য চর আইচা কো-ইড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কোনো জমি দলিল করে দেওয়া হয়নি। তাদেরকে জমি ভাড়া দেওয়া হয়েছে কিন্তু ভাড়ার টাকা তারা দেয়নি। ওই জমি তারা জাতীয়করণ হওয়ার অপেক্ষায় থাকায় পূর্ব চর আইচা আদর্শ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে দেওয়া হয়েছে। আর নতুন ভবনটিও তাদের স্কুলের। এছাড়াও কো-ইড স্কুলের অস্থায়ী ভবনটি ঠিকাদাররা ভেঙে ফেলেছেন বলে দাবি তাদের।

এদিকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মো. রাশেদ বলেন, তাদের না জানিয়ে মো. বশির উল্লাহ ও তার ছেলে এমদাদুল হক বাকের কো-ইড স্কুলের অস্থায়ী টিনশেড ঘরটি ভেঙে ফেলেছেন। বিষয়টি আমরা জানতে পেরে অভিযুক্তদের চাপ দিয়েছি।

চরফ্যাশন সার্কেলের (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সহকারী পুলিশ সুপার মো. মাসুম বিল্লাহ জানান, মধ্য চর আইচা কো-ইড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙচুরের ঘটনায় ৫ জনকে আসামি করে গত ২৭ আগস্ট একটি মামলা দায়ের করেছেন ওই বিদ্যালয়ের পরিদর্শক এনএম আলমগীর। মামলাটির তদন্ত চলছে। আমরা দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করবো।

মধ্য চর আইচা কো-ইড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১৮৪ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন ৪ জন শিক্ষক।

এফএ/এমএস