ভ্রমণ

জবই বিল পর্যটকদের কাছে ‘মিনি কক্সবাজার’

থই থই পানি আর ঢেউ। আর সেই ঢেউ ভেঙে ছুটে চলে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকা। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির কোথাও কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হিজলগাছ।

Advertisement

এছাড়া বিশাল জলরাশির ওপর ভেসে থাকা কচুরিপানা ও জলরাশির ওপারে দিগন্তরেখায় গ্রামগুলোকে মনে হয় যেন শিল্পীর তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা সবুজ রঙের খেলা।

আরও পড়ুন: একদিনেই কীভাবে ঘুরে আসবেন মহামায়া লেক থেকে?

আর শীতকালে অতিথি ও দেশীয় পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে জলাভূমিটি। অপরূপ এই দৃশ্য নওগাঁর সীমান্তবর্তী সাপাহার উপজেলার জবই বিলের।

Advertisement

বিশাল জলরাশির বিলটি এখন স্থানীয়দের কাছে একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে বর্ষায় বিলের অপার জলরাশি আর শীতকালে পরিযায়ী পাখি দেখতে হাজারো পর্যটকের ঢল নামে এখানে।

ভ্রমণপিপাসুদের কারও কাছে এটা এখন ‘মিনি কক্সবাজার’, আবার কারও কাছে ‘গরীবের কক্সবাজার’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সাপাহার উপজেলার পাতাড়ী ও শিরন্টি ইউনিয়নের মাঝামাঝি এলাকায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তরবঙ্গের এক বিশাল জলাভূমি এই জবই বিল।

আরও পড়ুন: হাউজবোটে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে কীভাবে যাবেন, খরচ কত?

মূলত পাঁচটি ছোট ছোট বিল নিয়ে গঠিত জলাভূমি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এই জবই বিল। ছোট ছোট বিলগুলো হলো উত্তরে ডুমরইল, কুচুন্দুরি ও মাহিল বিল ও দক্ষিণে বোরা মির্জাপুর ও কালিন্দার বিল।

Advertisement

সাপাহারের জবই গ্রামের পাশে অবস্থিত হওয়ায় এই পাঁচটি বিলের জলাভূমিটি জবই বিল নামে পরিচিতি পেয়েছে। ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার তপন থানার ডুমরইল ও কুচুন্দরি বিল থেকে আসা পানি জবই বিলের পানির প্রধান উৎস। বর্ষায় ডুমরইল ও কুচুন্দরি বিল দিয়ে পানি এসে বিলটিকে দিগন্তহীন সমুদ্রের মতো বানিয়ে ফেলে।

বর্ষা, শরৎ ও শীতকালে সব সময়ই বিলটি পর্যটকে ঠাসা থাকে। তবে দুই ঈদের সময় ভিড়টা অনেক বেশি হয়। বিশেষ করে বিকেলে শত শত দর্শনার্থীতে ভরে ওঠে বিলের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া জবই-পাতাড়ী সড়কের বটতলী ও নতুন ব্রিজ এলাকা।

আরও পড়ুন: ৬ বছরেই দেশের ৬৪ জেলা ঘুরেছেন সাফাত-শিখা দম্পতি

জবই বিলে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে জবই বিলের মাছ দিয়ে চলে যাওয়া সড়কের বটতলী ঘাট এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে মাছ চত্বর।

বিলের ঠিক মাঝ দিয়ে চলে গেছে সড়ক। বর্ষায় সড়কের দুই পাড় যখন পানিতে ভরে উঠে, তখন সড়কটি যেন কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত ও মেরিন ড্রাইভ সড়কে রূপ নেয়। একটু বাতাস উঠলেই বিলে ঢেউ উঠে। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে বিলের মাঝ দিয়ে যাওয়া সড়কের দু’ধারে ফেলে রাখা ইট-সিমেন্টের ব্লকে।

সড়কের দুই ধারে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে কংক্রিটের বেঞ্চ। বেঞ্চে বসে বিশাল জলরাশি দেখতে দেখতে নির্মল বাতাসের স্পর্শ নেওয়া যায়। সবশেষে ইঞ্জিনচালিত নৌকা কিংবা স্পিড বোটে চেপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে ভেসে ভেসে সমুদ্রের আমেজ উপভোগ করা যায়।

আরও পড়ুন: থাইল্যান্ডের কোরাল দ্বীপ ভ্রমণে কীভাবে যাবেন?

জবই বিলের পশ্চিম তীরবর্তী কলমুডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা ও কলেজ শিক্ষক আব্দুল হাই বলেন, জবই বিলকে এক সময় বলা হতো দেশি মাছের আধার। তবে বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা অভয়াশ্রমে প্রাকৃতিকভাবে দেশি মাছের প্রজনন ও উৎপাদনের পাশাপাশি মাছের পোনা ছেড়ে দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছের চাষও করা হয়।

এই বিলে ধরা পড়া পাতাশী, টেংড়া, বোয়াল মাছসহ বিভিন্ন দেশীয় মাছ খেতে খুবই সুস্বাদু। খেতে সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে সব সময় জবই বিলের মাছ বেশি দামে বিক্রি হয়। সরকারি হিসাবে বিলটির আয়তন ৪০৩ হেক্টর বা ৯৯০ একর।

বিলটিতে সারাবছরই পানি থাকে। শুষ্ক মৌসুমে পানির বিস্তৃতি কমে এলেও একেবারে পানিশূন্য হয়ে পড়ে না। বিলে সারাবছর পানি থাকায় এখানে দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ থাকে।

আরও পড়ুন: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আলতাদিঘি

সাপাহারের আশড়ন্দ গ্রামের বাসিন্দা রাহাত ফরহাদ বলেন, জবই বিলকে অনেকেই বলে থাকেন গরীবের কক্সবাজার। যাদের টাকা খরচ করে কক্সবাজারে গিয়ে সমুদ্রসৈকত দেখার সুযোগ হয় না, তারা বাড়ির পাশে এই জবই বিলে এসে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অনুভূতি নিতে পারেন।

প্রতিদিন বিকেলে হলেই নির্মল বাতাস নিতে আর জবই বিলের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে লোকজন এখানে ছুটে আসেন। নজিপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া বন্ধুদের সঙ্গে জবই বিলে ঘুরতে এসেছেন।

জবই বিলে ঘুরতে এসে কেমন লাগলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে জবই বিলের কথা মানুষের মুখে মুখে শুনেছিলাম। মানুষের মুখে জবই বিলের কথা শুনে ও ফেসবুকে ও ইউটিউবে ভিডিও দেখে এখানে ঘুরতে আসার অনেক শখ ছিল।’

আরও পড়ুন: ঢাকার কাছেই ঘুরে আসুন শাপলার রাজ্যে

‘আজকে বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম এখানে ঘুরতে আসলাম। অনেক ভালো লাগলো। নৌকায় চড়ে বিলের মাঝে গিয়েছিলাম। অনেক অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা হলো।’

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি সোহানুর রহমান সবুজ বলেন, ‘এই বিলকে ঘিরে স্থানীয় কয়েকটি গ্রামের সচেতন কিছু তরুণদের উদ্যোগে জবই বিল জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কমিটি গঠন করা হয়। শিকারিরা যেন পাখি শিকার করতে না পারেন সেদিকে খেয়াল রাখেন কমিটির সদস্যরা।’

‘এছাড়া বিলের জলজ উদ্ভিদ যেন নষ্ট না হয় ও বিলে প্রাকৃতিকভাবে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন যেন ব্যাহত না হয় সে বিষয়ে স্থানীয় জেলেদের সচেতন করতে কমিটির সদস্যরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে থাকে।’

আরও পড়ুন: নিকলী হাওর ভ্রমণে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?

কীভাবে যাবেন?

জবই বিলে যেতে প্রথমে নওগাঁ শহর থেকে বাসে করে ১৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে সাপাহার উপজেলা সদরে পৌঁছাতে হবে। এরপর সাপাহার উপজেলার সদরে জিরোপয়েন্ট এলাকা থেকে ২৫-৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে জবই বিলের প্রবেশপথ বটতলী ঘাটে পৌঁছানো যায়।

জবই বিলের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া সড়কের দুই ধারে বাঁধা থাকে সারি সারি নৌকা। ঘণ্টা হিসাবে চুক্তি করে নৌকায় চেপে জবই বিলে ঘুরে বেড়ানো যায়।

খাবারের জন্য বিলের বটতলী ঘাটে আছে বেশ কিছু খাবারের দোকান। এছাড়া শিশুদের খেলনার বেশ কয়েকটি দোকানও আছে সেখানে।

জেএমএস/জেআইএম