আমাদের ছেলেবেলাটা কেটেছে হীনমন্যতায়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের গঠন প্রক্রিয়া থমকে যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুত বাংলাদেশকে পিছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল পাকিস্তানি ভাবধারায়। স্বাধীনতাবিরোধীরা চলে আসে ক্ষমতার কাছাকাছি, এমনকি বনে যায় প্রধানমন্ত্রীও।
Advertisement
টানা সামরিক শাসনে বিপর্যস্ত দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার। অর্থনৈতিক অগ্রগতি স্থবির প্রায়। বাজেট হয় বিদেশি সাহায্যে। বাংলাদেশ বিশ্ব শিরোনাম হয় সাইক্লোন আর বন্যার কারণে। কিসিঞ্জারের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য করতে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি হওয়ার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল যেন বাংলাদেশ। ইতিহাস বিকৃতির অন্ধকার সেই সময়ে হীনমন্যতা আর গ্লানির কালো মেঘে ঢাকা ছিল আমাদের ছেলেবেলা।
বাংলাদেশের কেউ নোবেল জেতেনি, বাংলাদেশের কেউ এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেনি, ফুটবল বা ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেনি বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার তো হয়ইনি; বরং বিচার করা যাবে না, এমন কালো আইন কলঙ্কিত করে রেখেছে সংবিধান। যুদ্ধাপরাধীরাও বিচারের কাঠগড়ার বদলে কলঙ্কিত করেছে মন্ত্রিত্বের আসন। নেতিবাচকতা দেখতে দেখতে মনটাও ছোট হয়ে গিয়েছিল।
ভেবেছিলাম আমাদের জীবদ্দশায় এসব অপ্রাপ্তি কখনোই ঘুচবে না, বিচারহীনতার গ্লানি নিয়েই হয়তো কেটে যাবে বাকি জীবন। কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপ খেলা ছাড়া আর সব অপ্রাপ্তি ঘুচে গেছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। শুধু তাই নয়, আমরা ভাবিইনি, এমন অনেক অর্জনও আমাদের গর্বিত করেছে। বাংলাদেশে এখন আর দুর্গম বলে কোনো জায়গা নেই। যোগাযোগের সুবিশাল নেটওয়ার্কে গোটা দেশ। ২৪ ঘণ্টার দূরত্ব নেমে এসেছে তিন ঘণ্টায়। পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, টানেল, স্যাটেলাইট, সাবমেরিন- অবিশ্বাস্য সব অর্জন আমাদের স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে গেছে। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো।
Advertisement
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ ডলার। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার মর্যাদা অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব সূচকে পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। কোনো কোনো সূচকে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। ভোটাধিকার, মানবাধিকার, গণতন্ত্র প্রশ্নে অনেক সমালোচনা আছে, যেতে হবে আরও বহুদূর। তবে বাংলাদেশ এখন আর নেতিবাচক শিরোনাম নয়।
বাংলাদেশ এখন দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি, স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে মর্যাদার সাথে আমরা বিশ্ব আসরে মাথা উঁচু করে চলতে শিখেছি। আমাদের ছেলেবেলার সেই হীনমন্যতা আর গ্লানি বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে স্পর্শ করেনি। তারা এখন আধুনিক বাংলাদেশে মাথা উঁচু করে গর্বের সাথে চলতে পারছে। আমাদের চাওয়া আর তাদের চাওয়ার মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক। আমরা যা স্বপ্নেও ভাবিনি, তারা সেটা অনায়াসে পেয়ে গেছে। পৌঁছতে চাচ্ছে উৎকর্ষের চূড়ায়। মঙ্গা এখন ডিকশনারিতে ঠাঁই নিয়েছে। পান্তাভাতেই যারা সন্তুষ্ট ছিল, তারা এখন মাংস খাওয়ার স্বাধীনতা চায়।
তবে সাফল্যেরও একটা ক্লান্তি আছে। একসময় বাংলাদেশ ক্রিকেটে কেনিয়াকে হারালেও মধ্যরাতে দেশজুড়ে মিছিল হতো। এখন অস্ট্রেলিয়াকে হারালেও ফেসবুকে অভিনন্দন লিখে ঘুমিয়ে পড়ি। একসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকতো না। এখন আধঘণ্টার লোডশেডিংয়ে দেশে তুলকালাম বেধে যায়। যেখানে পায়ে হেঁটে যেতে তিন ঘণ্টা লাগতো, সেখানে গাড়িতে যেতে রাস্তায় ঝাঁকুনি লাগলে সরকারের পিন্ডি চটকাই।
বলছিলাম সাফল্যের ক্লান্তির কথা। অকল্পনীয় সব অর্জনও আমরা অবলীলায় গ্রহণ করতে পারি। নইলে ঢাকায় যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যাত্রা শুরু হলো, সেটা নিয়ে আমাদের আনন্দ আছে, কিন্তু উচ্ছ্বাস নেই যেন। আমরা এখন মনে করি, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল, সরকারের দায়িত্বই তো উন্নয়ন করা। কিন্তু আপনি যে দলই সমর্থন করুন, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, ১০ বছর আগেও কি আপনি ভেবেছিলেন; এই বাংলাদেশে পদ্মা সেতু হবে, মেট্রোরেল হবে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে, কর্ণফুলী টানেল হবে, সাবমেরিন হবে, স্যাটেলাইট হবে। কিন্তু সবই এখন বাস্তবতা।
Advertisement
ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। প্রায় দেড় কোটি মানুষের পদভারে পিষ্ট প্রিয় ঢাকা। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ঢাকার সীমানা ছিল একসময় ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন নেতার মাজার এলাকায় এখনও ঢাকা গেট আছে। সেই ছোট্ট ঢাকা বাড়তে বাড়তে এখন উত্তরা ছাড়িয়ে টঙ্গী ছুঁয়েছে। পূর্বাচলে গড়ে উঠছে নতুন শহর। একসময় ঢাকা শুধু উত্তরে বেড়েছে। বুড়িগঙ্গার কারণে দক্ষিণ দিকে বাড়তে পারেনি। পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ার পর ঢাকা এখন দক্ষিণ দিকেও বাড়ছে। শিগগির কেরানীগঞ্জ ঢুকে যাবে ঢাকার পেটে।
ফুলবাড়িয়া থেকে রেলস্টেশন সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল কমলাপুরে। এখন সেই কমলাপুরও ঢাকার মধ্যখানে। কথা হচ্ছে, কমলাপুর থেকে রেলস্টেশন সরানোর। আমরা ছেলেবেলায় ঢাকা এসে বাস থেকে নামতাম গুলিস্তানে। সারাদেশের সব বাসই গুলিস্তানে আসতো। তারপর গড়ে তোলা হলো সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী বাস টার্মিনাল। এখন আলোচনা হচ্ছে এই টার্মিনালগুলোও সরিয়ে নেওয়ার। তেজগাঁও থেকে বিমানবন্দর গেলো কুর্মিটোলায়। এখন কুর্মিটোলাও ঢাকার ভেতরে। তাই আলোচনা হচ্ছে আরও দূরে বিমানবন্দর সরিয়ে নেওয়ার।
মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ঢাকা কেমন হবে, সেটা ভাবতে আমি স্বপ্নাতুর হয়ে যাই। এই জীবনে সবটা দেখে যেতে পারবো কি না জানি না। তবে যেভাবে আমাদের স্বপ্নের চেয়েও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, তাতে একটি গতিশীল, সচল ঢাকা আর দূরের স্বপ্ন মনে হয় না।
এভাবে ঢাকা বেড়ে উঠছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু নদীতে বেষ্টিত ঢাকা সৃষ্টিকর্তার এক আশীর্বাদ। কিন্তু আমরা দখলে-দূষণে নদীগুলোকে হত্যা করতে বসেছি। আশীর্বাদ এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। বিদেশিরা ঢাকায় এলে আমাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়। কিন্তু যানজটকেই তারা চিহ্নিত করে ঢাকার এক নম্বর সমস্যা হিসেবে। হাজারও সমস্যায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু আমরাও মানি যানজটই ঢাকার প্রধান সমস্যা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় কেটে যায় আমাদের মূল্যবান সময়। কোনো কাজে সময়মতো পৌঁছানোর উপায় নেই।
বিদ্যুৎও বাংলাদেশের বড় একটা সমস্যা ছিল। সরকার সেই সমস্যার সমাধান করেছে। এখন সময় যানজট নিরসনের। কিন্তু ঢাকার মতো ঘনবসতি শহরের যানজট নিরসন সহজ কাজ নয়। একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকার কথা। সেখানে ঢাকায় আছে ১০ শতাংশেরও কম। কংক্রিটের এই জঙ্গলে নতুন রাস্তা বানানো সত্যি কঠিন। কেউ এক সুতা জমিও ছাড়তে চান না। তাই যানজট নিরসনের একমাত্র বিকল্প উড়ালপথ বা পাতালপথ।
বিদেশে গেলে মেট্রোরেল বা উড়ালপথ দেখলে আফসোস হতো, আহা আমাদের ঢাকায় যদি এমন হতো। সেই আফসোসের দিন বুঝি ফুরালো। মেট্রোরেলের আংশিক চালু হয়েছে আগেই। এবার শুরু হলো আমাদের স্বপ্নের উড়াল যাত্রা। ঢাকায় আগেই বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার হয়েছে। এবার শুরু হলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। মাত্র ১২ মিনিটে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট। কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।
মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যতটুকু চালু হয়েছে, তাতে যানজট সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে যাত্রাটা তো হলো। মেট্রোরেলের পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তা বদলে দেবে ঢাকার স্কাইলাইন। একই সঙ্গে পরিকল্পনা হচ্ছে পাতাল রেলেরও। তবে সর্বশেষ চালু হওয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েও একটি স্বপ্নের পথে যাত্রা।
আপাতত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যতটুকু চালু হয়েছে, তা ঢাকার মধ্যেই। তবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল লক্ষ্য ঢাকাকে বাইপাস করে মহাসড়কগুলো সংযুক্ত করা। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত চালু হওয়া এক্সপ্রেসওয়ের মূল পথ বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী। তাতে অনায়াসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, যেটি বাংলাদেশের অর্থনীতি লাইফলাইন, সেটি যুক্ত হয়ে যাবে আরও বৃহত্তর বাংলাদেশের সাথে। বিমানবন্দর থেকে সাভারের ইপিজেড পর্যন্ত নির্মাণাধীন আরেকটি উড়ালসড়কের কাজ শেষ হলে এ প্রকল্পের পুরোপুরি সুফল মিলবে। তখন ঢাকার যানজট এড়িয়ে দ্রুতগতিতে ট্রাকসহ অন্য যানবাহন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যেতে পারবে। আশুলিয়া পথের উড়ালসড়ক চালু হলে ইপিজেড ও উত্তরবঙ্গের যানবাহন ঢাকার যানজট এড়িয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পথে চলতে পারবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালুর আগে থেকেই শুরু হয়েছে সমালোচনা। এটি বড়লোকের রাস্তা, গরিব মানুষ উঠতে পারবে, এসব অর্থহীন আলোচনাও শোনা যাচ্ছে। আপাতত এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল এবং তিন চাকার যান চলতে পারবে না। এটা খুবই সঠিক সিদ্ধান্ত। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বানানোই হচ্ছে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে, ঢাকার ওপর চাপ কমাতে। পৃথিবীর সবখানেই এক্সমপ্রেসওয়েতে চলতে টোল দিতে হয়। যার সামর্থ্য আছে, সে দ্রুতগতিতে যাবে এটাই নিয়ম। পাছে লোকে কী বলে, সেটাকে পাত্তা না দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে স্বপ্নের পথ ধরে।
মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ঢাকা কেমন হবে, সেটা ভাবতে আমি স্বপ্নাতুর হয়ে যাই। এই জীবনে সবটা দেখে যেতে পারবো কি না জানি না। তবে যেভাবে আমাদের স্বপ্নের চেয়েও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, তাতে একটি গতিশীল, সচল ঢাকা আর দূরের স্বপ্ন মনে হয় না।
৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস