নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে চলমান মামলা স্থগিত চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি দিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নোবেলজয়ী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের ১৬০ ব্যক্তি। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল।
Advertisement
একই সঙ্গে নীল দলের বিবৃতিতে ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দেওয়াকে ‘অযাচিত ও অনভিপ্রেত’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়, ‘বিবৃতি দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিচারিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে শিক্ষক সমাজ সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছে।’
আরও পড়ুন: ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি, দেশের বিচার ব্যবস্থায় অযাচিত হস্তক্ষেপ
রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) সংগঠনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার এবং যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. আমজাদ আলী ও অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলামের সই করা এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬৬ শিক্ষকের নাম রয়েছে।
Advertisement
এতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে বিবৃতিদাতাদের বাংলাদেশের আইন-কানুন ও রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি আইনগত ও সাংবিধানিক বিধি-বিধান অনুধাবন করারও আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল।
আরও পড়ুন: এতই আত্মবিশ্বাস থাকলে বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়ান কেন
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের স্বার্থ রক্ষার্থে দেওয়া বিবৃতিতে বাংলাদেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ওপর আক্রমণ চলছে বলে যে দাবি করা হয়েছে তা অমূলক ও ভিত্তিহীন। দেশের প্রচলিত আইনে চলমান একটি মামলা নিয়ে এ ধরনের বক্তব্য আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থি। এটি আন্তর্জাতিক আইন, রীতিনীতি ও শিষ্টাচার বিবর্জিত এবং একটি রাষ্ট্রের স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও সার্বভৌমত্বকে অসম্মান প্রদর্শনের শামিল। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এবং সার্বভৌমত্বের ওপর এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’
‘জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা, ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট, ব্রিটিশ বিল অব রাইটস, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সংবিধান প্রণয়নসহ পৃথিবীর সব ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মৌলিক দর্শন হলো নাগরিকদের আইনি সমতা নিশ্চিত করা। বিবৃতিদাতারাও নিজ নিজ দেশের আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও নীতিনিষ্ঠ নাগরিক হিসেবে পরিচিত। ফলে এ ধরনের পক্ষপাতমূলতক বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেদের নীতি ও আদর্শকেই তারা অস্বীকার করেছেন।
Advertisement
উল্লেখ্য, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও গ্রেফতার হয়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। অথচ বাংলাদেশের বিষয়ে তাদের অবস্থান আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ব্যাপারে বৈপরিত্য নির্দেশ করে।’
নীল দলের নেতারা বিবৃতিতে বলেন, ‘একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে আইন যে তার নিয়মে পরিচালিত হয়। সেই স্বাভাবিক বিষয়টিকে বিবেচনায় না নিয়ে নিরপেক্ষ বিচারকদের একটি প্যানেল দ্বারা অভিযোগের পর্যালোচনা করা হলে নিশ্চিতভাবে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতিবিরোধী এবং শ্রম আইনের মামলাগুলো থেকে তিনি খালাস পাবেন বলে বিবৃতিদাতারা যে দাবি করেছেন, তার মধ্য দিয়ে চলমান বিচারিক কার্যক্রম প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে এবং ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করবে। প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইন ও বিচারিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে একজন ব্যক্তির স্বার্থরক্ষার এ ধরনের প্রচেষ্টা নজিরবিহীন ও পক্ষপাতিত্বমূলক। এর পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের প্রতিনিধি পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন।’
আরও পড়ুন: ‘বিশ্বনেতাদের খোলা চিঠি বিচার ব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপের শামিল’
এর আগেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নোবেলজয়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে উল্লেখ করে এতে আরও বলা হয়েছে, ‘এসব মামলায় কোনো কোনো নোবেলজয়ী দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। যেমন- বেলারুশের আদালত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎসিকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেছেন। ফিলিপাইনে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসার বিরুদ্ধে দায়ের করা কর ফাঁকির মামলায় তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। এসব নোবেল বিজয়ী আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আদালতের রায় মেনে নিয়েছেন। বিচার প্রক্রিয়া থেকে রক্ষা পেতে তারা কারও দ্বারস্থ হননি।’
‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা বিচারাধীন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে ৬০ বছরে অবসরে যাওয়ার আইন অমান্য করে ৭০ বছর বয়সেও পদ ছাড়তে সম্মত ছিলেন না। এ সংক্রান্ত মামলায় তিনি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনি লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পরে গ্রামীণ ব্যাংকের পদ ফিরে পেতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রভাবশালী দেশে লবিং করেছেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকি, তহবিলের অর্থ বেআইনিভাবে হস্তান্তর, শ্রম আইন লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা ধরনের অভিযোগ আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা কর ফাঁকির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং তিনি আদালতের রায় মেনে নিয়ে ধার্যকৃত কর পরিশোধ করেছেন’, যোগ করেন ঢাবির নীল দলের শিক্ষকরা।
আল সাদী ভূঁইয়া/কেএসআর/জিকেএস