জাতীয়

নতুন নামে ফিরবে বঙ্গবাজার, হবে ১০ তলা ভবন

নতুন নামে ফের প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে আগুনে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। বিগত তিন দশকে বড় দুটি আগুনে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এ মার্কেট এবার পাবে বহুতল রূপ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এবার এখানে নির্মাণ করছে ১০ তলা ভবন। নাম দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতান’। নতুন এ বিপণি বিতানে তিন হাজার ৪২টি দোকান থাকবে। আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ থাকবে নানান সুযোগ-সুবিধা।

Advertisement

দক্ষিণ সিটির সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতানের নকশা প্রণয়ের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে নকশা অনুমোদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরপর বিপণি বিতান ভবন নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করা হবে। ভবনটি তৈরি করতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৩৮ কোটি টাকা।

সিটি করপোরেশনের এ উদ্যোগে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। তবে বিপণি বিতানের নির্মাণকাজ শুরু হলে ফের ক্ষতির আশঙ্কাও করছেন তারা। ব্যবসায়ীদের দাবি, এখন বঙ্গবাজারের জায়গায় চৌকি বিছিয়ে, শামিয়ানা টাঙিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন তারা। নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হলে এ ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। তাই সিটি করপোরেশন যাতে অস্থায়ীভাবে বিকল্প জায়গায় বসার ব্যবস্থা করে।

আরও পড়ুন>> বঙ্গবাজারের অস্থায়ী দোকানে ক্রেতা সংকট

Advertisement

গত ৪ এপ্রিল সিটি করপোরেশন মালিকানাধীন বঙ্গবাজারে (বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের এনেক্সকো টাওয়ার মার্কেট (একাংশ), মহানগর শপিং কমপ্লেক্স (একাংশ), বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও মার্কেটে। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অগ্নিকাণ্ডে তিন হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩০৩ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতান নির্মাণের নকশা তৈরির কাজটি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। আলাদা তিনটি প্রতিষ্ঠান এই নকশা তৈরির কাজ করছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে নকশা অনুমোদন দিতে পারবো। আর নকশা চূড়ান্ত হলে চলতি বছরের নভেম্বর বা ডিসেম্বরে এই বিপণি বিতান নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করার পরিকল্পনা আছে।

ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর (মার্কেট নির্মাণ সেল) সূত্র জানায়, ১ দশমিক ৭৯ একর জায়গার ওপর প্রস্তাবিত বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতান নির্মাণ করা হবে। ১০ তলা এ বিপণি বিতানের বেজমেন্ট, গ্রাউন্ড ফ্লোরসহ আটটি ফ্লোর থাকবে। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত দোকান থাকবে তিন হাজার ৪২টি। এর মধ্যে গ্রাউন্ড ফ্লোরে ৩৮৪টি, প্রথম তলায় ৩৬৬টি, দ্বিতীয় তলায় ৩৯৭টি, তৃতীয় তলায় ৩৮৭টি, চতুর্থ তলায় ৪০৪টি, পঞ্চম তলায় ৩৮৭টি, ষষ্ঠ তলায় ৪০৪টি, সপ্তম তলায় ৩১৩টি। অষ্টম তলায় দোকান মালিক সমিতির অফিস, কর্মচারী, নিরাপত্তাকর্মীদের আবাস ও অন্য কক্ষ রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন>> বঙ্গবাজারের আগুনে ক্ষতি ৩০৩ কোটি টাকা

Advertisement

এছাড়া প্রস্তাবিত নকশায় রাখা হয়েছে ২২টি খাবারের দোকানের জায়গা। এর বাইরে আরও ৮১টি দোকান বেশি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিটি দোকানের আয়তন হবে ৮০-১০০ স্কয়ার ফুট। বিপণি বিতানটিতে লিফট থাকবে আটটি। এর মধ্যে ক্রেতাদের জন্য চারটি ও মালামাল ওঠানো-নামানোর জন্য কার্গো লিফট থাকবে চারটি। এর বাইরে ১১টি সিঁড়ি থাকবে। ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি থাকবে ছয়টি। এছাড়া প্রতিটি ফ্লোরে চারটি করে টয়লেট থাকবে। পার্কিংয়ে একসঙ্গে ১৮৩টি গাড়ি পার্কিং ও ১১০টি মোটরসাইকেল পার্কিং করা যাবে। ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৫শ বর্গ ফুট আয়তনের এ ভবনটি তৈরি করতে প্রায় ৩৩৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে সৃজনী উপদেষ্টা লিমিটেড।

ডিএসসিসির মার্কেট নির্মাণ সেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. তৌহিদ সিরাজ জাগো নিউজকে বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সৃজনী উপদেষ্টা লিমিটেডও নকশা তৈরির কাজ করছে। এর বাইরে ডিপিএম ও রিফ্লেকশন অ্যান্ড ডিজাইন নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠানকে নকশা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে যাদের নকশা পছন্দ হবে, সেটাই ডিএসসিসি চূড়ান্ত করবে।

তিনি বলেন, ডিএসসিসির বিদ্যমান যেসব মার্কেটে রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে আধুনিকভাবে তৈরি করা হবে বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতান। আশাকরি শিগগির এ বিপণি বিতানের নকশা অনুমোদন দিতে পারবো।

আরও পড়ুন>> ক্রেতাশূন্য বঙ্গবাজার, অনুদানের টাকাও পাননি ব্যবসায়ীরা

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রস্তাবিত বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতানের জায়গায় চৌকি বিছিয়ে, শামিয়ানা টাঙিয়ে ব্যবসা করছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। তাদের অধিকাংশই জামা-কাপড়ের দোকান। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কেনাকাটা করতে আসছেন ক্রেতারা। তবে রোদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করতে গিয়ে অনেক ক্রেতাকে নাজেহাল দেখা গেছে। তবে দোকানগুলোতে বৈদ্যুতিক সংযোগ নিয়ে ছোট টেবিল ফ্যান চালিয়ে ব্যবসা করছেন দোকানিরা।

নেহাল গার্মেন্টেসের ব্যবস্থাপক জামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়ার পর সেখানে বালু ফেলে চৌকি বসানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে দোকান মালিক সমিতি ও সিটি করপোরেশন। কিন্তু গরমে টিকতে না পেরে শামিয়ানা টাঙিয়ে নিয়েছেন দোকানিরা। এখন বৃষ্টি এলে পানি পড়ে। ক্রেতারাও ভিজে যান।

তিনি বলেন, আগে বঙ্গবাজারে যত ক্রেতা আসতেন, এখন তার তিন ভাগের একভাগ আসছেন। বেচাকেনা খুবই কম। এখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে হয়তো আবার ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে।

আরও পড়ুন>> মাঠ দখল করে গড়ে ওঠে বঙ্গবাজার, মার্কেট চান না এলাকাবাসী

তবে নতুন ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হলে আবারও ব্যবসায়ীদের বিপদে পড়তে হবে বলে মনে করেন সুমাইয়া গার্মেন্টের মালিক মাহতাব উদ্দিন। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন যে বিপণি বিতান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে তাতে ব্যবসায়ীরা খুশি। কিন্তু নির্মাণকাজ শুরু হলে এই এলাকা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। সিটি করপোরেশন যদি অস্থায়ীভাবে কোথাও ব্যবসায়ীদের বসার সুযোগ করে দিতো তাহলে ভালো হতো।

জানতে চাইলে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে সব সময় ব্যবসায়ীদের খোঁজখবর রাখছেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তার উদ্যোগেই এখন বঙ্গবাজারে ১০ তলা মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, যে তিনটি প্রতিষ্ঠান বঙ্গবাজারের বহুতল ভবনের নকশা তৈরির দায়িত্ব পেয়েছে, তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। মার্কেটের নকশা কেমন হবে বা মার্কেটে কী কী সুযোগ-সুবিধা থাকবে তার জন্য ব্যবসায়ীদের মতামত নিয়েছেন। আশা করি মার্কেটটি নির্মাণ হলে আগুনে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা তারা পোষাতে পারবেন।

যেভাবে বঙ্গবাজার থেকে ‘বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতান’

বাংলাপিডিসহ বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, মূলত ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত তৈরি পোশাক বিক্রির একটি বাজার ছিল। এখানে সস্তায় মিলতো সব ধরনের পোশাক। পাইকারদের জন্যও এটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৫ সালে জায়গাটি নানা ধরনের খুচরা পণ্যের হকার ও ছোট দোকানদারদের ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

বাজার গড়ে ওঠার বছর চারেকের মধ্যেই ফুলবাড়িয়া থেকে রেলস্টেশন কমলাপুরে সরিয়ে নেওয়া হলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের সংযোগস্থল বলে স্থানটির গুরুত্ব আগের মতোই রয়ে যায়। ফলে হকার ও অন্য দোকানদার বাজারটি না ছেড়ে বরং এখানে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে।

১৯৭৫ সালে ঢাকার পৌরসভা কর্তৃপক্ষ সব ধরনের টিনশেড ও অস্থায়ী কাঠামো ভেঙে দিয়ে এখানে একটি পাকা বাজার গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ জায়গাটির মালিকানা ছাড়তে অস্বীকার করে। এ অবস্থায় দোকান মালিকরা রেল কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে বার্ষিক ইজারা চুক্তির ভিত্তিতে খণ্ড খণ্ড জায়গায় নিজ নিজ দোকান বসানোর অধিকার লাভ করে। ১৯৮৫ সালে সিটি করপোরেশন জায়গাটির মালিকানা পায় এবং ১৯৮৯ সালের মধ্যে পরিকল্পিত পাকা বিপণি কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ হয়।

১৯৮৫ থেকে ১৯৯০- এই পাঁচ বছরেই মূলত বাজারটি তৈরি পোশাকের বাজার হিসেবে রূপান্তরিত হয়। বাজারটি বঙ্গবাজার নামে পরিচিতি অর্জন করলেও বস্তুত এখানে গুলিস্তান, মহানগরী ও আদর্শ হকার্স মার্কেট নামে অন্য তিনটি সংলগ্ন বাজারের দোকান একত্রে মিশেছে। এদের সীমানা আলাদা করা কঠিন।

বিদেশি ক্রেতা ও তাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের জোগান দেওয়া কাঁচামাল ব্যবহারের পর দেশের পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে যত কাপড়, সুতা, বোতাম, জিপার ইত্যাদি উদ্বৃত্ত থাকে মূলত সেগুলি দিয়ে তৈরি বলে বঙ্গবাজারের পোশাক দামে সস্তা। বাংলাদেশে অবস্থিত অনেক দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিদেশিরাও এ বাজারে প্রায় নিয়মিত আসেন। এভাবে বঙ্গবাজার দেশের বাইরেও পরিচিতি অর্জন করেছে।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবাজার এমনিতে যে পরিচিত অর্জন করেছিল তা আরও ব্যাপক হয় ১৯৯৫ সালে। বিশাল অগ্নিকাণ্ডে গোটা বাজার ভস্মীভূত হয়। ঘটনাটি পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে সবিস্তার প্রচারিত হয়। ঢাকা সিটি করপোরেশন এরপর বাজারটিকে নতুন করে গড়ে তোলে। ২০২৩ সালে এসে আরেক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ফের ভস্মীভূত হলে সিটি করপোরেশন নতুন নামে বহুতল ভবনের বিপণি বিতান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।

এমএমএ/এএসএ/এমএস