স্বাস্থ্য

সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে আবারও বেড়েছে ডেঙ্গুরোগী

# ৫০ শতাংশ রোগীই ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আসে অন্য হাসপাতাল থেকে # সবচেয়ে বেশি ৪৩ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে আইসিইউতে# ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসছে # প্রতি ১০০ জন রোগীর ২৫ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত# বেশিরভাগেরই মৃত্যু হাসপাতালে আনার তিনদিনের মধ্যে

Advertisement

ডেঙ্গুরোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ৮০০ শয্যার ডিএনসিসি হাসপাতালকে ‘ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল’ ঘোষণা করা হয়েছে গত জুলাইয়ে। এরপর থেকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে রোগী আসছেন ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে। ঢাকায় যেসব হাসপাতালে রোগী ভর্তি সম্ভব হয় না বা ক্রিটিক্যাল রোগীদের আইসিউ দেওয়া সম্ভব হয় না, তাদেরই স্থানান্তর করা হয় এই হাসপাতালে। এই হাসপাতালে আইসিইউ বেড সংখ্যা তুলনামূলক বেশি ও ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হওয়ায় এখানে ক্রিটিক্যাল রোগীদের আইসিইউ পেতে সহজ হয়। তবে সেপ্টেম্বরে আবারও রোগীর চাপ বাড়ায় ৪৫টি আইসিইউয়ের ৪৩টিতেই রোগী ভর্তি।

এই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন মুন্সিগঞ্জের ৩৫ বছর বয়সী গৃহবধূ কাজল। হাসপাতালে তার সঙ্গে আছেন ছেলে নিলয়। আইসিউয়ের বাইরে বেঞ্চে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখা যায় নিলয়কে।

শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জ সদর হাসপাতালে চারদিন ভর্তি থাকার পর চিকিৎসকরা ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। তাকে নিয়ে আসেন ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে। তিনদিন ধরে আইসিইউতে ভর্তি তার মা। তবে আগের তুলনায় প্লাটিলেট কিছুটা বেড়েছে। শনিবার বেডে ট্রান্সফার করে প্লাটিলেট দেওয়ার কথা থাকলেও তবে রক্তচাপ কম থাকায় আইসিইউতেই রাখা হয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন>> ডিএনসিসি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা, হটলাইন চালু

আইসিউতে ভর্তি আছেন আরেক রোগী লক্ষ্মীপুরের দুখু মিয়া। সঙ্গে এসেছেন দুলভাই কপিল উদ্দিন। চারদিন ধরে ভর্তি আছে দুখু মিয়া। এর আগে মাইজদি গ্রামীণ হাসপাতালে ছিলেন চারদিন। সেখান থেকে চিকিৎসকরা ঢাকায় স্থানান্তর করলে প্রথমে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে সিট না থাকায় পরে নিয়ে আসা হয় ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে।

কপিল উদ্দিন জানান, ডেঙ্গুর কারণে তার শ্যালকের ব্রেনে প্রভাব পড়েছে। ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না। তবে আশার কথা হলো, হাসপাতালে থাকতে থাকতে তার প্লাটিলেট ১২ হাজার থেকে ৫০ হাজারে উঠেছে।

শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে ডিএনসিসি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, দ্বিতীয় তলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত পাঁচটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুরোগী ভর্তি। হলিডে মার্কেট হিসেবে নির্মিত ভবনের ছোট ছোট দোকানগুলো কেবিন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া বড় রুমগুলোকে ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া ষষ্ঠতলা ব্যবহৃত হচ্ছে আইসিইউ হিসেবে।

Advertisement

আরও পড়ুন>> ডেঙ্গুতে প্রাণহানি ৬০০ ছাড়ালো

হাসপাতালের তথ্যমতে, ১ আগস্ট থেকে এই হাসপাতালে নিয়মিত ২৫০ থেকে ৩০০ রোগী থাকলেও শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) রোগী বেড়ে দাঁড়ায় ৩১৩ জনে। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ভর্তি হর ৮৪ ডেঙ্গুরোগী। এছাড়া এসময়ে মারা গেছেন একজন রোগী। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৬৯ রোগী। এ নিয়ে ১৩ জুলাই থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিন হাজার ৬৫৬ জন রোগী। ছাড়পত্র পেয়েছেন তিন হাজার ৩৪৮ জন। এই হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ডেঙ্গুরোগীতে হিমসিম অবস্থা

করোনা মহামারিতে এই হলিডে মার্কেটকে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ফিল্ড হাসপাতাল করা হয়। বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব না থাকায় এবং সারাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

হাসপাতালের পাঁচটি ওয়ার্ডে ৩৫০টি বেড চালু করা হয়েছে। এছাড়া চালু আছে ৪৫টি আইসিইউ বেড। তবে জনবল ক থাকায় রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক, নার্সসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালের কর্মচারীদের কোনো সপ্তাহিক ছুটি নেই। তবে নার্স এবং চিকিৎসকরা রাতে ডিউটি করলে পরদিন বন্ধ পান। এছাড়া পরিচ্ছন্নতাকর্মী, টেকনিশিয়ানসহ অন্যদের নেই সপ্তাহিক ছুটি।

দক্ষ জনবলের অভাব

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশিরভাগ প্যাথলিজস্টই অনভিজ্ঞ। আগে কোনো হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতা। তবে তাদের হাসপাতাল থেকে নানাভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আইসিইউয়ের দায়িত্বে থাকা নার্সদেরও নেই আইসিউ বিষয়ে আলাদা দক্ষতা। সাধারণ নার্স দিয়েই চলছে আইসিইউ। হাসপাতালটিতে বর্তমানে চিকিৎসক রয়েছেন ৭১ জন, নার্স ১১১ জন।

হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল এ কে এম জহিরুল হোসাইন খান জাগো নিউজকে বলেন, ডেঙ্গুরোগী আরও বৃদ্ধি পেলে হাসপাতালে সিট সংখ্যা ও আইসিইউ শয্যা আরও বাড়ানো যাবে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নতুন করে জনবল সরবরাহ করলে তা সম্ভব হবে। এছাড়া নতুন করে বেড বা আইসিউ চালু করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, অন্য হাসপাতাল থেকে স্থানান্তর করা ক্রিটিক্যাল রোগী আসেন এই হাসপাতালে। গত ১৩ জুলাই থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫১ দিনে এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গুরোগীদের মধ্যে মারা গেছেন ২৯ জন। আর তাদের মধ্যে বেশিরভাগরই মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসার এক থেকে তিনদিনের মধ্যে। এমনকি হাসপাতালে আনার তিন ঘণ্টা থেকে একদিনের মধ্যে মারা যাওয়া রোগীর সংখ্যাও কম নয়।

আরও পড়ুন>> ডেঙ্গুতে একদিনে রেকর্ড ২১ মৃত্যু

কর্নেল এ কে এম জহিরুল হোসাইন খান বলেন, এই মৃত্যুর প্রধান কারণ এখানে খুবই ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন, প্লাটিলেট কমে যাওয়া, শক সিনড্রোম, রক্তচাপ কমে যাওয়াসহ খারাপ অবস্থায় রোগী আসেন। এছাড়া ঢাকা কিংবা ঢাকার বাইরের অনেক রোগী বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে স্থানান্তর হয়ে আসেন এখানে। স্থানান্তরিত রোগীদের কন্ডিশনও ভালো থাকে না। এসব রোগীর কারণে মৃত্যুহারও বেশি। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগীদের এই হাসপাতালে ট্রান্সফার করা হয়। বেশিরভাগ রোগীই এখানে আসার পথে কিংবা আসার এক থেকে তিনদিনের মধ্যেই মারা গেছেন।

এর আগে গত শুক্রবার রাজধানীর গুলশানে এডিস মশার বর্ষাকালীন জরিপ পরিচালনাকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে ভর্তির ৭২ ঘণ্টায় ৯০ ভাগ ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যু হয়ে থাকে। চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গড়ে ৭৫ জন মারা গেছেন। আর মোট মৃত্যুর শতকরা ৯০ ভাগই হাসপাতালে ভর্তির তিনদিনের মধ্যে (৭২ ঘণ্টা) মারা গেছেন।

তিনি বলেন, হাসপাতালে রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে যেসব রোগীর প্লাটিলেট কম থাকে, শক সিনড্রোম, অধিক পেটে ব্যথা, রক্তচাপ কমে যাওয়া বা ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন নিয়ে আসে তাদেরই ভর্তি নেওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসাদের ৫০ শতাংশ সরাসরি আসেন। আর বাকি ৫০ শতাংশ বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে স্থানান্তর হয়ে আসে।

ডা. মো. নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, হাসপাতালে কিছুদিন আগেও আউটডোরে আসা রোগীদের মধ্যে ১৫ শতাংশ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যেতো। এই মুহূর্তে শনাক্তের হারও ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে প্রতি ১০০ জনে ২৫ জনের ডেঙ্গু শানাক্ত হচ্ছে।

এএএম/ইএ/এমএস