জাতীয়

রেলপথের ওপর হওয়ায় নির্মাণকাজে ভোগান্তিতে পড়েনি ঢাকাবাসী

রেলপথের ওপর হওয়ায় নির্মাণকাজে ভোগান্তিতে পড়েনি ঢাকাবাসী

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ২০১১ সালে। যানবাহন চলাচলের জন্য প্রকল্পের আংশিক উদ্বোধন হচ্ছে আজ। তবে রাজধানীর বুকে এক যুগ ধরে চলা এ প্রকল্প নগরবাসীর কাছে অতটা পরিচিত নয়। কারণ, মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলাকালে নগরবাসীকে যেভাবে ধুলা আর যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে সে তুলনায় কিছুই ছিল না। রেললাইনের ওপর দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ায় ভাঙতে হয়নি অন্য কোনো বড় স্থাপনাও। ফলে রাজধানীবাসীর ভোগান্তিও হয়েছে কম।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে কাজ চললেও নগরবাসী টেরই পায়নি কীভাবে কাজ করা হয়েছে। রেললাইনের ওপর দিয়ে নিয়ে আসার কারণে জনসাধারণের কোনো দুর্ভোগ বা ভোগান্তি তৈরি হয়নি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে। এমনকি ২ কোটি মানুষের বসবাসের ছোট্ট এই নগরীতে ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহারই যেন নিশ্চিত হয়েছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী এলাকা পর্যন্ত। ২০১১ সালে হাতে নেওয়া হয় প্রকল্পটি। আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। এরই মধ্যে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৬৫ শতাংশ। প্রকল্পে ওঠানামার জন্য মোট ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র‌্যাম্প রয়েছে। র‌্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এরমধ্যে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট মেইন লাইনের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এই পথে রয়েছে মোট ১৫টি র‌্যাম্প। এর মধ্যে ১৩টি র‌্যাম্প খোলা হচ্ছে আজ। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত আসতে সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট!

আরও পড়ুন: এক্সপ্রেসওয়ে যানজটমুক্ত থাকলে টোলে আপত্তি নেই নগরবাসীর

Advertisement

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অধিকাংশই রেললাইনের ওপর দিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে রেললাইনের দুইপাশের অনেক অবৈধ ও কিছু বৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রেললাইনের পাশের ছোট ছোট দোকান, বাড়ি। তবে অবৈধ ও বৈধ সব স্থাপনার মালিকদেরই দেওয়া হয়েছে ক্ষতিপূরণ।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক এএইচএম সাখাওয়াত আখতার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা রেলওয়ের জমি ব্যবহার করেছি। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অধিকাংশই রেললাইনের ওপর দিয়ে করা হয়েছে। রেললাইনের ওপর দিয়ে নিয়ে আসার কারণে জনসাধারণের কোনো দুর্ভোগ বা ভোগান্তি সৃষ্টি হয়নি। মানুষ টেরই পায়নি আমরা কীভাবে কাজ করেছি।’

তিনি বলেন, ‘রেললাইনের পাশে বৈধ-অবৈধ অনেক স্থাপনা ছিল। আমরা বৈধ ও অবৈধ স্থাপনার মালিক সবাইকেই ক্ষতিপূরণ দিয়েছি। ছোট ছোট ব্যবসায়ী যারা ছিলেন তাদের এবং যারা অবৈধভাবে ছোট ছোট ঘর করেছিলেন তাদেরকেও ক্ষতিপূরণ দিয়েছি।’

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুর মতো মোটরসাইকেলের আলাদা লেন দাবি

Advertisement

রাজধানীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারসহ যেসব ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে তার অধিকাংশই কাজ করতে গিয়ে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। একই সঙ্গে নগরবাসীকে বছরের পর বছর নানা দুর্ভোগ ও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সর্বশেষ রাজধানীতে সবচেয়ে বড় মেগা প্রকল্প মেট্রোরেল তার বড় প্রমাণ। বছরের পর বছর উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে ঢাকার মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের কারণে রাস্তা ছোট হওয়া, রাস্তা বন্ধ রাখার ফলে ধুলাবালি আর যানজটে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল নগরবাসী। গত কয়েক বছরে এটাই ছিল নগরবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে সেই দিক থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজের বিষয়ে অনেকটাই স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল নগরবাসী। প্রকল্পটি সড়ক বা কোনো লোকালয়ের মধ্য দিয়ে না হওয়ায় কোনো ভোগান্তিতে পড়েনি রাজধানীবাসী।

সাইফুল ইসলাম আপেল নামের এক ব্যক্তি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোন দিক দিয়ে হয়েছে এতদিন তাই জানি না। এর অবশ্য একটা কারণ হতে পারে যে সড়কের ওপর দিয়ে হয়নি। কোনো ধরনের যানজট তৈরি করেনি। যা মেট্রোরেলের কাজের জন্য গত কয়েক বছর হয়েছে।’

মো. শাহীন নামের আরেক ব্যক্তি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষের ভোগান্তি এড়িয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়নমূলক কাজ করলে সেটা বেশি ফলপ্রসূ হয়। মেট্রোরেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তার বড় প্রমাণ। মেট্রোরেলের কারণে মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে কয়েক বছর, আর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিষয়ে অনেকেই জানে না। কোনো ভোগান্তিতেও পড়তে হয়নি জনগণকে।’

আরও পড়ুন: বিমানবন্দর-উত্তরা সড়কের ‘মুশকিল আসান’ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২১৫ একর জমি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে। এরমধ্যে ৩০ একর রয়েছে ফ্লাইওভারের জন্য। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার মধ্যে ১৮ কিলোমিটার উড়াল সড়ক এসেছে রেললাইনের ওপর দিয়ে। রাজধানীর কুড়িল এলাকায় একটু জায়গা রয়েছে যেখানে রেললাইনের পাশ দিয়ে আসেনি। বাকি পুরো উড়ালসড়কই রেললাইনের ওপর দিয়ে এসেছে। তবে এতে রেলওয়ের কিছু কাজ আটকে ছিল।

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্প পরিচালক নাজনীন আরা কেয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘এলিভেটের এক্সপ্রেসওয়ের কাজের জন্য আমাদের কাজের কিছু দেরি হয়েছে। তেজগাঁও থেকে মালিবাগ পর্যন্ত এই জায়গাটুকু এখনো আমরা বুঝে পাইনি। এখনো বেশকিছু বিষয়ের সমাধান হয়নি। এগুলোর সমাধান করতে হবে। তবে একটি বিষয় বেশ ভালো হয়েছে যে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কাজের জন্য রেললাইনের পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সব পরিষ্কার করে ফেলেছে। এটা আমাদের জন্য ভালো হয়েছে।’

শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দরের কাছের কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার অংশ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগেই যানবাহন চলাচলের জন্য প্রস্তুত করা হয় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এই অংশ। উদ্বোধনের পর ৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টা থেকে সাধারণ যানবাহন চলাচল করবে। তবে মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার জাতীয় কোনো বাহন এক্সপ্রেসওয়েতে চলবে না। ফলে খুশি হতে পারছেন না মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার চালকরা।

প্রকল্পটি রেললাইনের ওপর দিয়ে করায় মানুষের যেমন ভোগান্তি হয়নি, আবার পুরো প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে যানজট অনেকাংশে কমে যাবে। এর ফলে ঢাকায় ভ্রমণের সময় ও খরচ কমবে। যানজটের নগরীর তকমা থেকেও মুক্তি পেতে পারে রাজধানী ঢাকা। আর নগরবাসীও যানজটের ভোগান্তি কমলে কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে। এছাড়া শুধু বিমানবন্দর ও যাত্রাবাড়ী রুটের যাত্রীদেরই স্বস্তি দেবে না, একই সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল ও পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করেই সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারবে। উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো ঢাকাকে বাইপাস করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। এতে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অংশে নিরসন হবে যানজট।

নগরে চলাচলের এমন পরিকল্পনা বেশ কাজে দেবে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়- বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘রেললাইনের ওপর দিয়ে এলিভেটের এক্সপ্রেসওয়ে রাজধানীতে এটাই প্রথম। এই ধরনের সড়কে যানবাহন দ্রুত গতিতে চলে। ফলে রাজধানীর যানজট অনেকটাই কমতে পারে। আর রেললাইনের ওপর দিয়ে করায় এটা নির্মাণের সময় তুলনামূলক কম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে নগরবাসীর।’

আরএসএম/কেএসআর/এমএস