ফিচার

চিঠির সোনালি অতীত

মিরাজ উদ্দিন

Advertisement

এক টুকরো কাগজে কত কথা, কত স্বপ্ন বন্দি হতো। কথামালার সঙ্গে প্রিয় কোনো ফুলের পাপড়ি কিংবা সুগন্ধি ছড়িয়ে দিতেন প্রেমিকা। প্রেমিক সেই চিঠি শার্টের বুক পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। বারবার সেই চিঠি পড়তেন, ঘ্রাণ নিতেন সেই ফুলের সুবাসের। যে সুবাস প্রেমিকার স্পর্শকে মনে করায় বারবার।

শুধু প্রিয়তমা নয়, বাবা-মা, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার একমাত্র উপায় ছিল চিঠি। আভিধানিক ভাষায় চিঠি হলো একজনের পক্ষ থেকে অন্যজনের জন্য তথ্যধারক বার্তা। চিঠি দু'জন বা দুপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ায়। বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সম্পর্ক আরও নিবিড় করে এবং পেশাধারী উন্নয়ন ও আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেয় এই চিঠি।

শুধু বাঙালি নয়, পুরো বিশ্বের মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চিঠির সোনালি স্মৃতি। একবিংশ শতাব্দীতে চিঠি বাংলা ব্যকরণ বিষয়ের একটি অধ্যায় মাত্র। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানেন না চিঠির সঙ্গে মিশে থাকা আবেগ, অনুভূতি কেমন হতে পারে। তবে নব্বই দশকে যাদের জন্ম তারা খুব ভালোভাবেই চিঠির গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। তারা হয়তো চিঠির একেবারে শেষ সময়টুকুর সাক্ষী হতে পেরেছেন।

Advertisement

একযুগ পেছনে তাকালেও বোঝা যায় এই চিঠির কতটা গুরুত্ব ছিল। তবে বর্তমান ডিজিটাল যুগের এই করাল গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে চিঠির গুরুত্ব। প্রবাস থেকে সন্তান মায়ের কাছে অথবা স্বামী স্ত্রী কিংবা ছেলেমেয়ের কাছে চিঠি লিখে অতি যত্নে খামে ভরে দিয়ে আসতেন ডাকঘরে। আর সেই চিঠি পৌঁছাতে সময় লাগতো ২০-২৫ দিন। কখনো সেই সময় গড়িয়ে যেত ১ মাসেরও বেশি।

আরও পড়ুন: যে চিঠির উত্তর কখনো আসবে না

চিঠি নিয়ে পিয়নরা এখন আর গ্রামে গ্রামে ঘোরেন না। বাড়ির দরজার সামনে এসে বলেন না, চিঠি আছে চিঠি, আপনাদের বিদেশ থেকে চিঠি এসেছে। কী জানি কোনো দুঃসংবাদ আসছে কি না! নানান শঙ্কা নিয়ে মা সেই চিঠি কাউকে দিয়ে পড়াতেন। আশ্বস্ত হতেন সন্তানের ভালো থাকার খবরে।

বিয়ে, আকিকা, জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী, বিদায় অনুষ্ঠান এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও চিঠির ব্যবহার ছিল। কয়েক বছর আগের কথা এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সময়ও আমরা চিঠি দিয়েছি আত্মীয়-স্বজনদের কাছে। কিন্তু এখন সেই চিঠির দাওয়াত নেই বললেই চলে, আর এখনকার স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা চিঠির গুরুত্বও জানেন না।

Advertisement

এখন আর পূর্ণিমার রাতে জানালার পাশে স্বামী কিংবা প্রিয়জনের জন্য চিঠি লিখতে বসতে হয় না। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইল ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে খবর আদানপ্রদান করা হয়। এক মুহূর্তের মধ্যে একপ্রান্তের খবর পৌঁছে যায় অন্যপ্রান্তে।

কিছুদিন আগে ঢাকা বাংলা বাজারে ঘুরতে গিয়েছিলাম, হঠাৎ তিনটি ডাকবাক্স সামনে পড়লো, সেই সঙ্গে চোখে ভেসে উঠলো সেই সোনালি অতীত। আব্বু তখন চট্টগ্রাম থাকতেন। বাড়িতে যোগাযোগের জন্য চিঠি দিতেন নিয়মিত। যদিও ছোট ছিলাম কিন্তু স্মৃতিতে সব রয়ে গেছে। মা বাড়ির পাশের এক ফুফুকে দিয়ে চিঠি পড়িয়ে নিতেন এবং তাকে দিয়েই সেই চিঠির উত্তর লিখে পাঠাতেন আব্বুর কাছে। এখন আর এই যোগাযোগের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয় না। মুহূর্তের মধ্যে খবরাখবর পৌঁছে যায় বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে। কিন্তু ভালোবাসা আর অনুভূতির পার্থক্য অনেক।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

কেএসকে/এমএস