রাজধানীর ফার্মগেট মনিপুরী পাড়ায় পরিবার নিয়ে থাকেন শাহরিয়ার হোসেন। উত্তরা আজমপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রতিদিন সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হতে হয় অফিস ধরতে। রাজধানীর যানজট কাটিয়ে তাকে পৌঁছাতে হয় অফিসে। রোদ, ঝড়, বৃষ্টির মাঝে তার নিত্যদিনের সঙ্গী এই যানজট।
Advertisement
শাহরিয়ার হোসেনের মতো এমন অনেকেই প্রতিদিন দীর্ঘপথ পেরিয়ে উত্তরা থেকে ফার্মগেট এলাকা বা ফার্মগেট এলাকা থেকে উত্তরা গিয়ে এভাবেই অফিস করেন। শুধু তাই নয়, রাজধানীর বিমানবন্দর-উত্তরা এলাকা থেকে অনেকেই তেজগাঁও, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার এলাকাতেও অফিস করতে আসেন।
ঢাকা শহরের যানজট ও নগরবাসীর ভোগান্তি নিরসনে নির্মাণ করা হয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। তবে সেই এক্সপ্রেসওয়েতে সব ধরনের যানবাহন চললেও মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার (সিএনজিচালিত অটোরিকশা) চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এতে অনেকটা আক্ষেপই জানিয়েছেন মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার চালকরা।
তবে সেতু সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কোনো বিরতি নেই। ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়িগুলো চলাচল করতে পারবে। সেখানে মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার চলাচল করলে দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকবে। তাই এই যানগুলো আপাতত চলার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
Advertisement
জানা গেছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী এলাকা পর্যন্ত। আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯.৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘের এই প্রকল্পটি ২০২৪ সালের ২ জুন শেষ হবে। এরই মধ্যে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৬৫ শতাংশ। প্রকল্পে ওঠা-নামার জন্য মোট ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র্যাম্প রয়েছে। এরমধ্যে এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট মেইন লাইনের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এই পথে র্যাম্প রয়েছে মোট ১৫টি। এরমধ্যে ১৩টি র্যাম্প উন্মুক্ত। এ পথে এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত আসতে সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট।
আরও পড়ুন: এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: অপেক্ষা ঘুচবে মালবাহী ট্রাকের
এই অংশ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এ অংশ। উদ্বোধনের পর ৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৬ টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ যানবাহন চলাচল করবে।
রাজধানীর উত্তরায় একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন তুহিন আহমেদ। অফিস শেষে প্রতিদিনই উত্তরা থেকে আসেন ধানমন্ডিতে। ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলে নিয়মিত যাতায়াত করেন তিনি। কখনো দেড় ঘণ্টা, কখনো দুই ঘণ্টা সময় লাগে ধানমন্ডিতে আসতে। অফিস শেষে এমন তিক্ত যাতায়াত তাকে প্রতিদিনই অস্বস্তিতে ফেলে। কিন্তু তাতেও যেন তার কিছু করার নেই। জীবনজীবিকার তাগিদে তাকে এটা মেনে নিয়েই চলতে হয়। ভোগান্তি নিয়েই দিন পার করতে হয় তুহিনকে।
Advertisement
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, প্রতিদিন দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে যাতায়াত করা কঠিন হয়ে যায়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যাতায়াত সেই ভোগান্তিটা দূর করবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু পাঠাও বা সিএনজি দিয়ে আমাদের মতো মানুষের আসার কোনো সুযোগ নেই।
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় কথা হয় মোটরসাইকেলের চালক সোহেল তানভীরের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, রাজধানীতে চলাচলের জন্য মোটরসাইকেল কিনেছি। নগরবাসীর যাতায়াতের জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করে এখন যদি আমাদের মোটরসাইকেল নিয়েই চলতে না দেয় তাহলে এর সুফল সবাই পাচ্ছি না।
আরও পড়ুন: মহাখালী-বনানী র্যাম্পের কাজ শেষ হতে লাগবে আরও কয়েক মাস শাহীন নামের আরেক মোটরসাইকেলচালক জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকার যানজট ও মানুষের ভোগান্তি কমাতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করা হয়েছে। আমাদের যদি চলতেই না দেয় তাহলে এই ভোগান্তি থেকে আমরা আর মুক্তি পেলাম কোথায়?
রাজধানীতে পাঠাওচালক মৃদুল। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, দূরের পথ হলে অনেকেই পাঠাওয়ে যেতে চান। আবার বাসে সবাই যাতায়াত করতেও পারে না। কেউ যদি ফার্মগেট থেকে বিমানবন্দর যেতে চায় তাহলে তাকে তো আগের মতো মহাখালীসহ পুরো এলাকা ঘুরেই যেতে হবে। সে-তো আর পাঠাও নিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে যেতে পারছে না। ভাড়াও কমবে না।
রফিকুল ইসলাম নামের এক সিএনজিচালক জাগো নিউজকে বলেন, সবাই যদি এলিভেটেড দিয়ে চলতেই না পারে তাহলে লাভ কী? পদ্মাসেতুর মতো আলাদা একটা লেন দিতে পারতো। তাহলে আমরাও যেতে পারতাম। প্রয়োজনে একটা গতিসীমা নির্ধারণ করে দিতে পারতো।
সোহেল নামের আরেক পাঠাওচালক জাগো নিউজকে বলেন, যাত্রী সংকটে পড়বো আমরা। বাসেই বেশি যাতায়াত করবে। দিন দিন আমাদের জন্য পাঠাও চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত রাজধানীতে রেজিস্ট্রেশনকৃত বৈধ মোটরসাইকেল ছিল ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৮৬৬টি। সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যাও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফলে এ ধরনের যানবাহন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলতে না পারলে অন্যান্য সড়কে যানজট থেকেই যাবে বলে মনে করেন চালকরা।
দেশি বাইকার গ্রুপের সদস্য মশিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, রাজধানীতে লাখ লাখ বাইক চলাচল করে। নগরবাসীর ভোগান্তি দূর করতে এই এক্সপ্রেসওয়েতে বাইক ও সিএনজি চলতে না দেওয়া মানে আমাদের বঞ্চিত করা। একটা নিয়ম চালু করে হলেও চলাচল করতে দেওয়া উচিত।
এ ধরনের যানবাহন চলার অনুমতি না দেওয়ার বিষয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক এএইচএম সাখাওয়াত আখতার জাগো নিউজকে বলেন, মানুষ সহজে যেতে পারবে, এ জন্যই এটা বানানো। এ ধরনের যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা তো আছেই, ট্রাফিক হয়ে গেলে তো আর করে লাভ হলো না। ফলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যে উদ্দেশ্য, সেটি আর থাকবে না। তাদের একটা দাবি আছে, পরবর্তীতে পুরোপুরি চালু হলে হয়তো নতুনভাবে এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা হতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা শহরে এটিই প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এই এক্সপ্রেসওয়েটি নগরীর যানজট নিরসনের জন্য ভালো হবে আশা করা যায়। তবে মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার যানবাহনের অনুমতি না দেওয়াটা ইতিবাচকভাবেই নেওয়া উচিত। কারণ এ ধরনের যানবাহনগুলো সড়কে টার্ন করে বেশি, ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। সার্বিকভাবে এখন শুধু গতিসীমাটা নজরদারিতে রাখতে পারলেই এর সুফল পাবে নগরবাসী।
আরএসএম/এমএইচআর/এএসএম