তৌফিক সুলতান
Advertisement
গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কাপাসিয়ায় উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের নরাইট বিল। যেখানে ফুটে আছে শাপলা ফুল। সকাল, দুপুর, বিকাল সব সময় লাল শাপলার সমারোহ যেন এক প্রাকৃতিক স্বর্গ। সবুজের মাঝে লাল শাপলার বিচরণ দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সবাই এখন একে শাপলা বিল নামেই চেনে।
সূর্যের স্বর্ণোজ্জ্বল রশ্মি পানিতে পড়তেই কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় বিলের সৌন্দর্য। বছরের এই সময়ে যারা ঢাকার আশপাশে থাকেন, ছুটে আসেন বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। ছোট্ট এই গ্রাম এখন ভ্রমণপিপাসুদের কেন্দ্রবিন্দু।
আরও পড়ুন: শাপলার রাজ্য সাতলা গ্রামে ঘুরতে যাবেন কীভাবে, খরচ কত?
Advertisement
জুলাই থেকে শাপলা ফোটা শুরু হয়। বিলের সঙ্গে যাদের বাড়ি, শাপলা তুলতে কিংবা মাছ ধরতে কলাগাছের তৈরি ভোরকা বা ভেলা, তাল গাছের তৈরি কুন্ধা ও ছোট নৌকাই তাদের একমাত্র বাহন। এক পলকে মনে হবে, কোনো ক্যানভাসে আঁকা লাল শাপলার আহা কি চমৎকার চিত্র। সবুজ আর পানিতে ঝিলিকদেওয়া আকাশের মাঝে বিলজুড়ে শাপলার রাজত্ব।
এখানে ঢাকার আশপাশ থেকে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসছেন পাশাপাশি বিদেশি অনেক পর্যটক আসছে প্রতিনিয়ত। শাপলা বিলের পরিচিতি দিন দিন বাড়ছে, এর সুনাম ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। পর্যটকরা মুগ্ধ পর্যটকদের ভিড় আর মুগ্ধতায় এলাকার মানুষও ভিষণ আনন্দিত।
শাপলা বিলের পাশে অবস্থিত বর্জ্জাপুর গ্রাম সেই গ্রামের মানুষ ফাহাদ, জোনায়েদ, সাদিকুল, মিজান, সাইফুল সাদেকা তারা সাই বলেন, ‘আমরা খুবই আনন্দিত এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকদের আনন্দ দেখে।’
আরও পড়ুন: হাউজবোটে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে কীভাবে যাবেন, খরচ কত?
Advertisement
তাদেরকে আনন্দিত দেখতে পেয়ে আমাদেরও আনন্দ হয়, তবে এর যথাযথ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রয়োজন। যার মাধ্যমে এলাকার বেকার যুবকদের কর্ম সংস্থানের ব্যাপক সুযোগ তৈরি হতে পারে।
তবে এই বিষয়ে এলাকার মানুষদের সহযোগিতার পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ। শাপলা বিল ছাড়াও এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সাজানো মনোমুগ্ধকর অনেক টেক বিল ও নিদর্শন আছে।
যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে শাপলা বিলের মতো ওই সমস্ত স্থানও হয়ে উঠবে পর্যটকদের আকর্ষনের কেন্দ্র বিন্দু। শুধু প্রয়োজন উদ্যোগ গ্রহণ ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন। পুরো অঞ্চল প্রকৃতির সৌন্দর্যে সাজানো মনোমুগ্ধকর অপার স্নিগ্ধতার ভালো লাগার পরিবেশ।
যারা ঢাকা থেকে এই শাপলার রাজ্যে যেতে চান, তারা মহাখালী থেকে সম্রাট বাসে চালা বাজার গিয়ে নামবেন। চালা বাজার থেকে অটোরিকশা অথবা সিএনজি রিজার্ভ করে সরাসরি শাপলা বিলে চলে আসতে পারেন।
অথবা বর্জ্জাপুর বাজারে নেমে গাড়ি নিতে পারেন কিংবা পশ্চিম দিকের পথধরে হেঁটে চলে আসতে পারেন চারপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পাশেই দেখা মিলবে পদ্মফুলের সঙ্গে এরপরই আপনার কাঙ্খিত স্থান শাপলা রাজ্য।
আরও পড়ুন: ৬ বছরেই দেশের ৬৪ জেলা ঘুরেছেন সাফাত-শিখা দম্পতি
অন্য বাসে আসতে চাইলে দ্বিতীয় পথটি হলো অনন্যা, উজানভাটি, জালসিঁড়ি টিকিট কাউন্টার থেকে আমরাইদ বাজারের টিকিট কাটতে হবে। বাস আপনাকে এয়ারপোর্টে-টঙ্গী-গাজীপুর চৌরাস্তা- রাজেন্দ্রপুর- কাপাসিয়া- তরগাঁও হয়ে আমরাইদ বাজার নিয়ে আসবে।
আমরাইদ বাজারে যাওয়ার পর আপনাকে বাস থেকে নামতে হবে। এবার পূর্বদিকের রাস্তা ধরে গেলে গিয়াসপুর বাজার ভায়া জলিল মার্কেট পৌঁছে যাবেন। জলিল মার্কেটে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে।
এবার চাইলে অটোরিকশা নিতে পারেন কিংবা উত্তর দিকের রাস্তা দিয়ে হেঁটে বা আপনার নিজস্ব যানবাহনে করে পৌঁছে যেতে পারেন শাপলা বিলে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা বিলের জলে ফুটন্ত লাল শাপলা দেখতে ভিড় করছেন সেখানে।
গাঢ় সবুজের বুকে ফুটে ওঠা এ যেন বাংলার ‘লাল স্বর্গ’। বিলে লাল, সাদা ও বেগুনি রঙের শাপলা জন্মালেও লাল শাপলা বেশি লাল ও সাদা শাপলাকে শাপলা বলা হলেও বেগুনি শাপলাকে এলাকার মানুষ সন্দি বা সন্ধি বলে ডাকে।
আরও পড়ুন: থাইল্যান্ডের কোরাল দ্বীপ ভ্রমণে কীভাবে যাবেন?
এই ফুল থেকে ফল হয় যাকে এলাকার মানুষ বেট বলে, তা খাদ্য হিসেবেও গ্রহণ করা হয়। এই বেট তুলে আবার বিভিন্ন প্রসেসিং করে খই বা মুড়ির মতো ভেজে খাওয়া হয়। শাপলা গাছের নিচেও শাপলা ফল বা বীজ হয় যাকে শালুক নামে ডাকা হয়। এই শালুক উঠিয়ে পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুকিয়ে ভেজে খাওয়ার উপযোগী করা হয়।
যদিও না ভেজেও খাওয়া যায় তবে ভেজে খেতে অনেক মজা। বিলের যত ভেতরে চোখ যায়, ততই লালের আধিক্য সবুজের মধ্যে এ যেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের জেনেচেরি সৈনিকের দল। একপর্যায়ে মনে হবে শাপলার রাজ্যে হারিয়ে গেছেন।
দেখা মিলবে, অনেক মানুষের কেউ কেউ মুঠো ভরে শাপলা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ফটোসেশন করছেন। শাপলার বিল শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, জীবিকারও মাধ্যম। বিল থেকে শাপলা তুলে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে কিছু পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে।
এলাকার কেউ কেউ বিলের শাপলার ওপর নির্ভরশীল। কেউ শাপলা তোলেন, কেউবা বিল থেকে মাছ শিকার করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
আরও পড়ুন: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আলতাদিঘি
অনেকের পছন্দের তরকারি শাপলা। গ্রামের মতো শহরেও দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সহজলভ্য শাপলা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। শাপলায় আছে প্রচুর ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ আলুর চেয়ে সাতগুণ বেশি। শাপলা চর্ম ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী।
বিলে ভ্রমণের জন্য চাইলে স্থানীয়দের কাছ থেকে ছোট নৌকা ভাড়া করা যায়। বিলে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে আত্মতৃপ্তি অনুভূত হবে। যেন এই তো শুধু আমার সোনার বাংলাদেশ নয়, সুখের ঠিকানা। এত কিছুর মাঝে আবার দেখা মিলবে অনেক পাখি।
বক, মাছরাঙা, শালিক, চড়ুইসহ নাম না জানা পাখি এসে বিলের মাঝে কিচিরমিচির করে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। যারা ঢাকার আশেপাশে থাকেন, তারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে একদিনের জন্য ঘুরে আসতে পারেন।
কম খরচে সহজে যাওয়ার জন্য উত্তম জায়গা এটি। এই বিলে নৌকায় চড়ে কাঁটাতে পারবেন সুন্দর মুহূর্ত। এই বিলের সৌন্দর্য আপনার ক্লান্তি কেরে নিয়ে উৎফুল্ল দিয়ে পূর্ণ করে দিবে ক্লান্তির আবরণ।
আরও পড়ুন: সহস্রধারা ঝরনায় একদিন
আশপাশে আরও অনেক সুন্দর জায়গায় আছে, সময় থাকলে সে গুলোও ঘুরে দেখতে পারেন। প্রয়োজনে গুগলের সাহায্য নিতে পারেন ওয়েলফেশন অফিস রোড ধরে সামনে গেলেই পেয়ে যাবেন অনেক সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর সব স্থান।
যেমন- ১০০ বছর যাবত কারোদের অধীনে থাকা কারোর টেক প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এক মন মুগ্ধকর স্থান। প্রায় দুই যুগ পূর্বে প্রতিষ্ঠিত সৌদিয়া বড় মসজিদ, সেখানে ওয়েলফেশন অফিসের উত্তর পাশে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা দুই যুগ পূর্বে নির্মিত ইটের তৈরি মিনার।
ইতিহাসের স্মৃতি বহন করা শাহী মসজিদ ও লোহাদির লোহার খনি- যদিও অল্প কিছু নিদর্শনই দেখতে পারবেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায়ই হারাতে বসেছে এসব। ধাঁধা চর’সহ ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহাম্মেদ এর বাড়িতেও।
জেএমএস/এমএস