জাতীয়

বিমানবন্দর-উত্তরা সড়কের ‘মুশকিল আসান’ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

বিমানবন্দর-উত্তরা সড়কের যানজট যেন চলাচলকারীদের কাছে বিভীষিকা, আতঙ্কের নাম। বিশেষ করে অফিসযাত্রী ও বিদেশগামীরা এর প্রধান ভুক্তভোগী। এই সড়কে যানজটের কারণে ফ্লাইট মিস কিংবা হেঁটে লাগেজ মাথায় নিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ অনেকটা নিয়মিত ঘটনা। যাদের সময় মেনে অফিসে ঢুকতে হয় তাদেরও পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। সাধারণ যাত্রীরাও পড়েন সীমাহীন দুর্ভোগে। এসব ভোগান্তির ‘মুশকিল আসান’ হবে ঢাকা এলিভেডেট এক্সপ্রেসেওয়ে। তবে পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Advertisement

যানজট নিরসনে বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে বড় প্রকল্প ও চালু হতে যাওয়া প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এটি। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে বিমানবন্দর ও উত্তরাকেন্দ্রিক যে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় সেটি অনেকাংশে কমে আসবে। এতে বাঁচবে সময়, ট্রাফিক সদস্যদের কাজও কমবে। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট যাওয়া-আসা করতে সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট।

আরও পড়ুন>> টার্মিনাল এলাকায় যানজট, লাগেজ মাথায় নিয়ে হাঁটছেন বিদেশগামীরা

স্থানীয়রা বলছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ার পর বিমানবন্দরকেন্দ্রিক যাত্রীরা ভোগান্তি থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবেন, দেখতে হবে না গুগল ম্যাপের ট্র্যাফিক আপডেট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে না গাড়িতে কিংবা ফ্লাইট মিস করার ভয়ে হেঁটেও যেতে হবে না বিমানবন্দরে।

Advertisement

কিছুদিন আগের ঘটনা, বিমানবন্দর সড়ক থেকে নিজ গাড়িতে ৪৫ মিনিটে টার্মিনাল-২ এর ৮ নম্বর ফটকে (ভিআইপি) যান গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার মালিক কাদির খান। যানজটের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ব্যবসার কাজে প্রায়ই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দরের মতো এমন নোংরা পরিবেশ, যানজট দুনিয়ার আর কোনো বিমানবন্দরে নেই। এমন পরিবেশের কারণে বিদেশিরা এই বিমানবন্দরে নেমেই বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পাচ্ছেন। আর প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দেশের মানুষ।

এমন চিত্র এই সড়কের নিত্য ঘটনা। ভিআইপি মুভমেন্ট থাকলে এই যানজট আরও গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। বিদেশিরাও দেশে ঢুকে এক ধরনের বিরূপ অবস্থার মধ্যে পড়েন। তবে আশার আলো দেখাচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।

রাজধানী ধানমন্ডি-২৭ নম্বরের বাসিন্দা আশফাক সাঈদ আশিক। ব্যবসায়িক কাজে তিনি প্রতিদিন ধানমন্ডি থেকে ফার্মগেট হয়ে মহাখালী এরপর বনানী-বিমানবন্দর পার হয়ে উত্তরায় ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করেন। ধানমন্ডি থেকে উত্তরায় যেতে সময় লাগে তার এক ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা ২০ মিনিট পর্যন্ত।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ধানমন্ডি থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যেতেই অসংখ্য ট্রাফিক সিগন্যালে পড়তে হয়। কোনো কোনো সিগন্যাল ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করায়। এক ঘণ্টার রাস্তা যদি মাত্র ১০ মিনিটে যাতায়াত করা যায় এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে। টোল দিয়ে হলেও মানুষ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করবে।

Advertisement

আরও পড়ুন>> বিমানবন্দর সড়কে অসহনীয় যানজট, ফ্লাইট মিস করছেন যাত্রীরা

সেতু বিভাগের তথ্যমতে, উদ্বোধনের পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সাধারণের যানচলচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। তবে বাকি অংশের (তেজগাঁও-কুতুবখালী) জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছর পর্যন্ত। ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার উড়াল সড়কে র‌্যাম্প ১১ কিলোমিটার। বিমানবন্দর কাওলা থেকে মোট ১৫টি র‌্যাম্প নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি খুলে দেওয়া হবে। বনানী ও মহাখালী র‌্যাম্প এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। আপাতত র‌্যাম্প দুটি খুলছে না। প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। তবে তেজগাঁও পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি শতভাগ। এ উড়ালপথে গাড়ি চলবে অন্তত ৮০ কিলোমিটার গতিতে। প্রকল্পের পুরোটা চালু হলে দিনে অন্তত ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করতে পারবে নির্বিঘ্নে। এ উড়ালপথে থাকবে না কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল। এতে বদলে যাবে ঢাকার দৃশ্যপট।

নগরীর যানজট নিরসনে জাদুরকাঠি হিসেবে কাজ করবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল লেনের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা থেকে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত দৈর্ঘ্য সাড়ে ১১ কিলোমিটার। প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষ হলে বিমানবন্দর থেকে মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটেই পাড়ি দেওয়া যাবে যাত্রাবাড়ী। ওঠা-নামার জন্য মোট ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র‌্যাম্প রয়েছে। র‌্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিমি।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আকতার বলেন, কাওলা পয়েন্টে একটা টোল প্লাজা আছে। এছাড়া কুড়িল, মহাখালী, বনানী ও তেজগাঁওয়ে আছে টোল প্লাজা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলতে পারবে না দুই ও তিন চাকার কোনো বাহন। বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত পুরো প্রকল্প ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। বর্তমান প্রকল্পে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণ কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশ যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত।

আরও পড়ুন>> বিমানবন্দর-উত্তরা সড়কে তীব্র যানজট

ট্রাফিক এয়ারপোর্ট জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) শাখাওয়াত হোসেন সেন্টু জাগো নিউজকে বলেন, আশা করা যাচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর কিছুটা চাপ কমবে আমাদের বিমানবন্দর সড়কে। চালুর কয়েকদিন গেলেই সেটি বোঝা যাবে। টোল দিয়ে হলেও অনেকেই সময় বাঁচানোর জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করবেন। পুরো এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে অনেকাংশেই যানজট মুক্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

জানতে চাইলে ডিএমপির ট্র্যাফিক উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) নাবিল কামাল শৈবাল জাগো নিউজকে বলেন, ৩ সেপ্টেম্বর সর্বসাধারণের জন্য চালুর পর বোঝা যাবে বিমানবন্দরকেন্দ্রিক কতটা চাপ কমেছে। কারণ বিআরটি ও থার্ড টার্মিনালের কাজ চলমান। এসব উন্নয়নমূলক কাজ শেষ হলে এক্সপ্রেসওয়ের পুরোপুরি সুবিধাটা পাওয়া যাবে। তবে আশা করা যায় কিছুটা হলেও চাপ কমবে। অনেকেই এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচল করবে। বিমানবন্দরগামী গাড়িগুলো এক্সপ্রেসওয়েতেই চলাচল করবে।

এক্সপ্রেসওয়ের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওঠা-নামার স্থানে ট্রাফিক সদস্য মোতায়েন থাকবে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোলক্যাটাগরি-১ এ কার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) এবং হালকা ট্রাক (৩ টনের কম) ৮০ টাকা।ক্যাটাগরি-২ এ মাঝারি ট্রাক (৬ চাকা পর্যন্ত) ৩২০ টাকা।ক্যাটাগরি-৩ এ ট্রাক (৬ চাকার বেশি) ৪০০ টাকা।ক্যাটাগরি-৪ এ সব ধরনের বাস (১৬ সিট বা তার বেশি) ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, উড়ালসড়ক বাস্তবায়নের পর ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক সৃষ্টি হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি হেমায়েতপুর-কদমতলী-নিমতলী-সিরাজদিখান-মদনগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক-মদনপুরে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। উড়ালসড়ক শুধু বিমানবন্দর ও যাত্রাবাড়ী রুটের যাত্রীদেরই স্বস্তি দেবে না, একইসঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল ও পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করতে সহায়তা করবে। উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো ঢাকাকে বাইপাস করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। এতে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অংশে নিরসন হবে যানজট।

টিটি/এএসএ/এএসএম