ফিচার

যে চিঠির উত্তর কখনো আসবে না

১ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব চিঠি দিবস’। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আমরা তো প্রিয়জনকে চিঠি লিখতে ভুলেই গেছি। তবে আজকের দিনে একটি মায়াভরা চিঠি সবচেয়ে প্রিয়জনকে তো লেখাই যায় মন খুলে। তাই তো বিশ্ব চিঠি দিবস স্মরণে একটি চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন কবি সৌমেন্দ্র গোস্বামী—

Advertisement

অনিন্দিতাশুরুতে একটি দুঃসংবাদ দিই। যদিও আমি জানি, দুঃসংবাদটি শুনে তোমার একটুও মন খারাপ হবে না। কেনইবা হবে? আমাদের তো যোগাযোগ নেই, কথা নেই। কেবল তোমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছি। তা-ও একেবারে না থাকার মতো। আমার কোনো পোস্টে কখনো লাইক বা কমেন্ট করতে দেখিনি। হয়তো বেশি বেশি পোস্ট করার কারণে আনফলো করেছো। তোমার নিউজফিডে আমার পোস্ট আর পৌঁছায় না। কিংবা আমার সব লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়, মনে মনে হাসো, আনন্দিত হও। কিন্তু নীরব থাকো, লাইক-কমেন্ট করো না। অথবা অন্য কিছুও হতে পারে।

ফেসবুকে তো এখন কত কত ফিচার। আর কিছুদিনের মধ্যে ফেসবুক মানুষকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে। মানুষ ফেসবুকের ওপর নির্ভর করতে শুরু করবে। যেমন অলিখিতভাবে আমি তোমার ওপর নির্ভরশীল। সে কথা থাক, দুঃসংবাদটি বরং দিই। যদিও দুটি মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা না থাকলে একজনের দুঃসংবাদ, সু-সংবাদ আরেকজনের হয়ে ওঠে না। তাই দুঃসংবাদটি শুনে দুঃসংবাদ তোমার না-ও মনে হতে পারে। তারপরও বলছি, আমি একটা ফেলোশিপ পেয়েছিলাম। একজন শিক্ষক করুণা করে হোক আর স্নেহ থেকে হোক, সুযোগটা পাইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সুযোগটা নিইনি। কেন নিইনি? সে কথা পরের চিঠিতে বলবো।

আজ শুধু বলি, তোমাকে কেবল ভালোবাসার জন্যই ভালোবেসিছি আমি। কোনো চাওয়া-পাওয়া, আবদারের লোভ নেই। হ্যাঁ, হয়তো ততটাও সুদর্শন নই। যতটা সুদর্শন হলে অনেকের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকতাম। তারপরও ব্যাপারটা মোটেই এমন নয় যে, ইশারায়, ঠারোঠোঁরে কেউ কখনো ভালো লাগার ইঙ্গিত দেয়নি। তার গল্পটা বলি, যে প্রায় ফোন করে, মেসেজ দেয়, খোঁজ-খবর নেয়। নাম, পরিচয় না বলি। কী দরকার অহেতুক তাকে ছোট করার। কথাটা সচেতনভাবেই বলছি। কারণ প্রায় পরিচিত বলয়ে প্রাক্তনকে নিয়ে, কেউ পছন্দ করলে সেই মানুষটিকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে শুনি। ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ হয় না আমার।

Advertisement

একজন মানুষের আরেকজন মানুষকে পছন্দ করার, ভালো লাগার অধিকার আছে। তেমনইভাবে তাকে ভালো না লাগলে তাকে তা জানানোর বা বলে দেওয়ারও অধিকার প্রত্যেকের আছে। তাই বলে কাউকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করাটা কি শিক্ষিত মানুষের শোভা পায়। আচ্ছা, আমি যে তোমাকে ভালোবাসি। তোমার জন্য কবিতা লিখি, গল্প লিখি, গান গাই। আমাকে নিয়ে তুমিও কি বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি করো? তোমার বন্ধুরা কি আমার যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে? করে করুক, কিছু আসে-যায় না। লোকে কী বলবে, কী ভাববে ইত্যাদি বিষয়ে ভাবা বাদ দিয়েছি অনেকদিন হলো।

যা হোক, আর কথা না বাড়াই। ওই মেয়েটির কথা বলি। তার বাবার সূত্রে তার সঙ্গে পরিচয়। তখন তৃতীয় বর্ষে পড়ি। সম্ভবত একাডেমিক কোনো বই কেনার উদ্দেশে লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। বই নিয়ে বেরোচ্ছি হঠাৎ একজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে ধাক্কা লাগলো। পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি; তাকে ধরে ফেলি, সরি বলি। তিনিও সরি বলেন। তারপর নানা কথা হয়। কোন বিষয়ে পড়ি, বাবা কী করেন, বাড়িতে কে কে আছেন ইত্যাদি। এক পর্যায়ে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য বললেন তিনি। শুধু বললেনই না, এক প্রকার কথা আদায় করে নিলেন।

সন্ধ্যায় ভদ্রলোকের বাড়িতে গেলাম। দারুণ আতিথেয়তার পর বাড়িতে ডাকার কারণটি বললেন। ‘ছোট মেয়ে ইন্টার পরীক্ষা দিচ্ছে কিন্তু কোন বিষয়ে কোচিং করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তোমাকে ডেকেছি, ওর সঙ্গে কথা বলে ওকে একটু সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করো।’ সাতপাঁচ না ভেবেই কথা বলতে আরম্ভ করলাম। সিদ্ধান্ত হলো, সে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য কোচিং করবে। না, সে ব্যর্থ হয়নি। একটি স্বনামধন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

নিজের দর বাড়ানোর জন্য মেয়েটির কথা বলছি না। বলছি, এই কারণে যে সে আমাকে ফোন দেয়, খোঁজ-খবর নেয়। কিন্তু কী আশ্চর্য, তার জন্য আমার হৃদয়ে তোলপাড় নেই। তাকে ভেবে কিছু লিখতে পারি না। তাকে সম্মান করি, স্নেহ করি কিন্তু ভালোবাসতে পারি না। আমার সবটা জুড়ে কেবল তোমারই আগ্রাসন। চেষ্টা করেও তোমার থেকে নিজেকে দূরে সরাতে পারি না।

Advertisement

জানি, পৃথিবীর সব কঠিন নিয়মের সরলীকরণ সম্ভব হলেও তোমাকে পাচ্ছি না। তারপরও কোনো আফসোস নেই। বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক পড়ে দেখেছি, সব সাহিত্যিক প্রায় একই রকম বলেছেন। ভালোবাসার মানুষকে পেলেই ভালোবাসা হারাতে থাকে। না পাওয়াতেই ভালোবাসা মহিমান্বিত হয়। এই কথার পক্ষে-বিপক্ষে বলতে পারছি না। কারণ না পেলে, পাওয়ার স্বাদ কেমন তা তো উপলব্ধি করা যায় না।

আজ ১ সেপ্টেম্বর। বিশ্ব চিঠি লেখা দিবস। প্রত্যেকে তার ভালোবাসার মানুষকে চিঠি লিখবে, উত্তর পাবে। আমি উত্তর পাবো না জেনেও তোমাকে লিখলাম। না মহাদেব সাহার কবিতার সুরে সুর মিলিয়ে করুণা করে হলেও চিঠি দিতে বলছি না। এই চিঠি আমার তরফ থেকে তোমাকে দেওয়া ভালোবাসার উপহার। নিশ্চয়ই হাসছো, ভাবছো এই দুর্মূল্যের বাজারে উপহার হিসেবে শেষে কি না একটা চিঠি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উত্তরটা দিই, ‘পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে, তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়।’

শেষে শুধু একটা কথাই বলি, ভালো না বাসো, কাছে না ডাকো শুধু এইটুকু শুভ কামনা রেখো, তোমাকে ভালোবেসেই একটা জীবন যেন কাঁটিয়ে দিতে পারি।

ইতিসৌমেন্দ্র গোস্বামী১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

এসইউ/এএসএম