আল্লাহতাআলা জ্ঞান অর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কোরআন করিমে আল্লাহপাক শিক্ষাকে ‘আলো’ এবং মূর্খতাকে ‘অন্ধকার’ বলে উল্লেখ করেছেন। যারা শিক্ষার আলোয় আলোকিত তাদের ‘উৎকৃষ্ট জীব’ বলা হয়েছে, অন্যদিকে যাদের শিক্ষার আলো নাই তাদের ‘নিকৃষ্ট জীব এবং অন্ধ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
Advertisement
আল্লাহতাআলা আদেশ করেছেন, ‘তুমি পাঠ কর কেননা তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে তা যা সে জানত না’ (৯৬:৩-৮)। ‘যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে’ (২: ২৬৯)। তিনি আরও বলেন, ‘তুমি বল যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে? বস্তুত ধীসম্পন্ন লোকগণই কেবল শিক্ষা লাভ করে’ (৩৯: ৯)।
জ্ঞানার্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করে আল্লাহতাআলা বান্দাকে দোয়া শিখিয়েছেন, ‘হে আমার প্রভু! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর’ (২০: ১১৫)। কোরআনপাকে বার বার শিক্ষালাভ সম্পর্কে তাগিদ করা হয়েছে। শিক্ষালাভ সম্পর্কে আল্লাহতাআলার আদেশের গুরুত্ব উপলব্ধি করে মহানবি (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর জন্য ফরজ’ (ইবনে মাজাহ)। তিনি (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিদ্যা শিক্ষার পথ অনুসরণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেবেন’ (মুসলিম)। তিনি (সা.) আরও বলেন, ‘একজন বিশ্বাসীর জ্ঞান অন্বেষণ প্রচেষ্টা শেষ হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে জান্নাতে দাখিল হয়’ (তিরমিজি)।
আল্লাহতাআলা শিক্ষাকে আলো বলেছেন, কারণ এ ‘আলো’ আঁধাররূপী সব অজ্ঞানতা, পঙ্কিলতা, অন্যায় অনাচার দূর করে দিয়ে মানুষকে সঠিক পথ অর্থাৎ ন্যায়নিষ্ঠা ও সত্যের অনুসারী করে। এক কথায় মানুষ হয় আল্লাহর প্রিয় বান্দা! মানুষকে জ্ঞান শিক্ষা দিবার জন্যই কোরআন মজিদ অবতীর্ণ হয়েছে। মানুষের মধ্যে মনুষত্ববোধ সৃষ্টি, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা, স্রষ্টা ও তার সৃষ্টি সম্পর্কে জানার জন্য পবিত্র কোরআনে দিকনির্দেশনা রয়েছে। কোরআন করিমের শিক্ষার বাস্তবায়ন ঘটেছে মহানবির (সা.) পবিত্র জীবনে। তিনি মানুষকে এই শিক্ষার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং তাগিদ করেছেন তা গ্রহণ করতে, এর আলোকে আলোকিত হয়ে সুফল লাভ করতে। তাই মহানবির (সা.) জীবনাদর্শ এবং তার মুখনিঃসৃত বাণী মানুষের জন্য অবশ্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। কেননা মানব ধর্ম ‘ইসলাম’কে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই হজরত রাসুল করিম (সা.) এর আবির্ভাব হয়েছে এবং আল্লাহতাআলা তার কাছেই পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছেন।
Advertisement
শিক্ষা মানুষকে আয়ত্ব করতে হয়। জন্মের পর থেকে শিশু তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে শিখতে শুরু করে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে ও বংশগতভাবে কতগুলো বিষয় শিশুর মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। বিশেষ করে মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় মাতার অনেক আচরণ ও আমল শিশুর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু সাধারণ অর্থে শিক্ষার যে সংজ্ঞা, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, জন্মের পর একটি সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তুলতে সাহায্য করে ‘শিক্ষা’। মানুষকে নীতিবান ও বিবেকবান করে তোলে ‘শিক্ষা’। এ কারণে আগে যে শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল তা ছিল গুরুগৃহে অবস্থান পূর্বক শিক্ষা লাভ করা। এ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর গুরুগৃহে অবস্থান করতে হতো।
শিক্ষাগুরু শিক্ষার্থীকে দৈনন্দিন শিষ্টাচার, ধর্মীয় শিক্ষাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় শিক্ষা দিতেন। প্রাচীন ভারতেও এ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। শিক্ষার্থী শিক্ষাগুরুর শিষ্যত্ব লাভ করে সাহচর্যে থেকে বিভিন্ন শাস্ত্রে পান্ডিত্যসহ চরিত্র গঠন, আদব-কায়দা ও ধর্মীয় শিক্ষা লাভের সুযোগ পেত। গুরুগৃহে শিষ্যের অবস্থানের মেয়াদ ছিল ৫ বছর থেকে ১০-১৫ বৎসরকাল। তখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা খুবই কম ছিল। থাকলেও প্রথমে গুরুগৃহে শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো। তাই দেখা যায় বড় বড় মণীষী ও জ্ঞানীগুণী পন্ডিতরা যারা গত হয়েছেন তারা কোনো না কোনো গুরুর শিষ্য হয়ে জ্ঞান লাভ করেছেন।
অনেক সময় দেখা গেছে যে, শিষ্য গুরুকে ছাড়িয়ে গেছেন। তবে এ পদ্ধতিতে শিক্ষা লাভ করাকে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষালাভ করা হয় বলে ধরা যায় না। ইসলাম এ পদ্ধতিকে সমর্থন করে না। কারণ এ পদ্ধতিতে শিক্ষালাভ করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়, কেবল বিত্তবান, সামর্থ্যবান এবং কোনো জ্ঞান-পিপাসুরাই এভাবে শিক্ষা লাভ করতে পরতো। এতে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ শিক্ষা লাভের সুযোগ পেত, সিংহভাগ মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হতো কিন্তু ইসলামই সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা দিয়েছে।
ইসলাম জ্ঞান আহরণের জন্য বিভিন্ন স্থানে গমনপূর্বক শিক্ষালাভকে একটি অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে; তবে একে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা বলা হয় না। কেননা আল্লাহতাআলা সন্তানের জন্য পিতা-মাতাকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং তার পক্ষ থেকে পৃথিবীতে পিতা-মাতা হলেন তাদের নিজ নিজ সন্তানদের অভিভাবক। কাজেই জন্মের পর থেকে পিতা-মাতাই হলো সন্তানের শিক্ষাগুরু।
Advertisement
আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থাও ইসলাম কায়েম করেছে। এতে গুরুগৃহে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও পরিবারই সে যান্ত্রিক যুগে কীভাবে একটি শিশু ছোটবেলা থেকে শিক্ষা লাভ করে একজন সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে সে বিধি-বিধান বা নিয়মকানুন পবিত্র কোরআন এবং রাসুল করিম (সা.) এর সুন্নাহর মধ্যে নিহিত রয়েছে।
এক্ষেত্রে ইসলাম পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে ব্যবহারিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। পুঁথিগত বিদ্যা অর্থাৎ তোতাপাখির মতো মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে সনদ বা সার্টিফিকেট পাওয়া যায় বটে কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে যদি তার প্রতিফলন না ঘটে তবে সে শিক্ষার কোনো মূল্যই থাকে না। ‘শিক্ষা’র অর্থ হলো ‘আলো’। কাজেই যে শিক্ষা বা আলো অন্ধকার অর্থাৎ সব ধরনের অজ্ঞতা দূর করতে ব্যর্থ হয় সে শিক্ষায় শিক্ষা লাভ করা আর না করা একই সমান।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় আমাদের সমাজে বহুল পরিচিত প্রবাদ বাক্যটির কথা, যেমন- ‘বেয়াদবের লেখাপড়া যেমন সাপের ফণা ধরা’। প্রবাদ বাক্যটি দ্বারা এটাই প্রতিপন্ন হয়, বেয়াদব কোনো শিক্ষার্থী লেখাপড়া শিখে বড় মাপের একজন শিক্ষিত বেয়াদবে পরিণত হয়। সে সমাজের কোনো উপকারে আসে না বরং সমাজ তার দ্বারা কলুষিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ আদব-কায়দা, মান-মান্যতা ও শিষ্টাচার বিবর্জিত শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি সত্যিকার মানুষ বলে গণ্য নয়। সে বিবেক-বিবেচনাহীন ও একগুয়েমি স্বভাবের হয় বলে কেউ তাকে ভালোবাসে না, শ্রদ্ধা করে না এবং তার প্রতি কারও কোনো আস্থা থাকে না। তাই সে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ নামের অযোগ্য বলে সে আল্লাহতাআলার কাছেও অপছন্দনীয়।
কাজেই সত্যিকার শিক্ষা বলতে যা বোঝায় তা একমাত্র ইসলামই প্রদান করেছে। সুশীল সমাজও শ্রেষ্ঠ জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের বিকল্প আর কিছু নেই। হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে শিশুর শিক্ষা শুরু হয় মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায়।’ শিশু বিজ্ঞানীরাও একই মত পোষণ করেছেন। এ সময়ে মায়ের আমল, চিন্তা-ভাবনা, ধর্মপরায়ণা ও সুষম খাদ্যগ্রহণ ইত্যাদি সব কিছুই গর্ভের সন্তানের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে এবং তা শিশুর সঠিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাই এ সময় মাতাকে বিশেষ সচেতন থাকতে হয় এবং নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হয়। কারণ অসৎ আমল, কুচিন্তা, ধর্মহীনতা ও অসম খাদ্য গ্রহণ দ্বারা সুস্থ ও পবিত্র শিশু জন্মলাভ করতে পারে না।
হজরত রাসুল করিম (সা.) তাই বলেছেন, ‘সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই তার তরবিয়ত অর্থাৎ চরিত্র গঠন শুরু করা উচিত।’ জন্মের পর শিশুর শিক্ষা পরিবারের আওতাভুক্ত থাকে। পরিবার ও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভালো হলে শিশুর শিক্ষাও সঠিক এবং সুন্দর হয়। এখানে শিশুর শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার ভূমিকাই প্রধান। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আগে গৃহের পরিবেশই হলো শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গন, যেখানে শিশুর সত্যিকার স্তম্ভ গঠিত হয়। তাই শিশুকে ধর্মীয় উত্তম শিক্ষায় গড়া তোলার পেছনে তার পরিবার ও পিতা-মাতার ভূমিকাই সর্বাগ্রে।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস