করোনা মহামারি পার করে নতুন এক বৈশ্বিক মহামারিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি আমরা। আর তা হলো ডেঙ্গু মহামারি। এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গু ইস্যুতে সতর্কতা জারি করেছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফল হিসেবে পূর্বে যে সব দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ছিল না, চলতি বছর এমন বেশ কিছু দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ছিল লক্ষণীয় ২০২২ সালে যেখানে ডেঙ্গু সংক্রমণ হওয়া দেশের সংখ্যা ছিল ১২৯, চলতি বছর এরই মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণ হওয়া দেশের সংখ্যা ১৪১টি। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
Advertisement
মূলত জুন থেকে সেপ্টেম্বর অবধি নিরক্ষ রেখা বরাবর থাকা অধিকাংশ দেশে চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বাংলাদেশও এই অক্ষরেখা বরাবর থাকায় এখানে চলতি বছরের মে মাসের শেষ থেকে শুরু হয় ডেঙ্গুর সংক্রমণ, যা বর্তমানে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, মার্চ-এপ্রিল মাস থেকে দেশের অভ্যন্তরের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা চলতি বছর ডেঙ্গু সংক্রমণের বিষয়ে সতর্কবার্তা জানাতে থাকে। দেশি-বিদেশি বেশ কিছু গণমাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
এ সময় রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি দেশের প্রধান সিটি করপোরেশনগুলো জানায়, ডেঙ্গু মশা (এডিস মশা) নিয়ন্ত্রণে তাদের পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু জুন-জুলাই থেকে বেশ স্পষ্ট হয়ে যায়, সিটি করপোরেশনের প্রস্তুতি যথেষ্ট ছিল না। স্বাস্থ্য খাতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মৃত্যুর সংখ্যা। এনিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ লাখ ৭ হাজারের বেশি রোগী। সেই সঙ্গে মৃতের সংখ্যা ৫০০ জন ছাড়িয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়বে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এমন এক পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম প্রতিবেদনে দায়ী করা হচ্ছে কখনও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। আবার কখনও দায়ী করা হচ্ছে সিটি করপোরেশনগুলোকে। কিন্তু দিন শেষে এর দায় এককভাবে কারও নয়। এর নেপথ্যে আছে অনেক কিছু।
Advertisement
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই নগর পিতা জুন মাস থেকে শহরজুড়ে অভিযান পরিচালনা করছে মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের জন্য। এক্ষেত্রে জরিমানাও করা হয়েছে অনেককে। সেই সঙ্গে ঢাকার ওয়ার্ড অনুসারে ভাগ করে মশা নিধনে চলছে অভিযান, মশক নিধনে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ওষুধ। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না কেন?
ডেঙ্গুসহ অন্যান্য মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল, এ বিষয়টি বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তারা যেই প্রস্তুতি নিয়েছে, সেটিও কার্যকর হচ্ছে না। মশা নিধনের জন্য যেই ফগ শহরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, এর কার্যকারিতে কোনোভাবেই ১০ শতাংশের বেশি উন্নীত করা যায় না। প্রয়োজন ছিল ডেঙ্গু মশার আবাসস্থল ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা। এক্ষেত্রে জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। কেননা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই, সরকার শব্দটি আসলে শুধু ক্ষমতা বা পদে থাকা ব্যক্তি নয়। একটি সরকার মানে হলো ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের পাশাপাশি ওই দেশের সব জনগণের সমন্বয়ে তৈরি একটি ব্যবস্থাপনা।
এক্ষেত্রে বারবার জরিমানা করেও ঢাকা শহরে মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। নির্মাণাধীন ভবন বা সরকারি বিভিন্ন নির্মাণ কাজের স্থানগুলোতে জমে থাকা পানি মশা প্রজননের অভয়ারণ্য। এর পাশাপাশি আমাদের আবাসস্থলগুলোতেও জন্ম নিচ্ছে মশার এক সেনাবাহিনী। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঢাকা শহরে দুই বাড়ির মধ্যখানে থাকা অংশগুলোতে মানুষ প্রবেশের মতো যথেষ্ট ব্যবস্থা না থাকলে, এখানে পড়ে থাকা পলিথিন ও ময়লার মধ্যে বৃষ্টির পানি জমে জন্ম নেয় মশা।
এসব তো আমাদের ব্যর্থতা। এর বাইরেও সিটি করপোরেশনের আরও একটি ব্যর্থতার কথা সম্প্রতি সামনে এসেছে, যা খুব একটা আলোচনায় নেই আশ্চর্যরকম এক কারণে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশার লার্ভা ধ্বংসে সিটি করপোরেশন আমদানি করে ব্যাকটেরিয়া বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই)। বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস বা বিটিআই নামের ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ডেঙ্গুর লার্ভা ধ্বংসের কার্যক্রম ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন শুরু করে চলতি মাসের ৬ তারিখে। এটি বেশ কার্যকর একটি পদ্ধতি। কিন্তু দেখা যায়, এ পদ্ধতি কাজ করছে না। কিন্তু কেন?
Advertisement
মশাবাহিত সব রোগের জন্য তৈরি হচ্ছে টিকা। এটি এখন মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মশাবাহিত যে কোনো রোগ থেকে মৃত্যুর হার হ্রাস করতে সক্ষম হবে বিশ্ব। তবে তার আগ পর্যন্ত কেবল সচেতনতাই আমাদের রক্ষা করতে পারবে মশার হাত থেকে।
চলতি মাসের ২১ তারিখ বিটিআই সরবরাহে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ায় এক চীনা নাগরিকসহ চারজনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ডিএনসিসির সহকারী ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রাহাত আল ফয়সাল বাদী হয়ে এ মামলা করেন। গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল্লাহ আল মামুন মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ডিএনসিসির পক্ষ থেকে চারজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন- মার্শাল অ্যাগ্রোভ্যাট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আলাউদ্দিন ও নির্বাহী পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ এবং চীনা নাগরিক লি কিউইয়াং।
গত ১৯ মে মার্শাল অ্যাগ্রোকে বিটিআই আমদানির কার্যাদেশ দেওয়া হয় এবং ২১ মে এ বিষয়ে একটি চুক্তি হয়। ১ আগস্ট মার্শাল অ্যাগ্রো ডিএনসিসিকে বিটিআই কীটনাশক হস্তান্তর করে। এসব কীটনাশকের মোড়কের তথ্য অনুযায়ী, সেগুলো সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল থেকে আনা হয়েছে। পরে বেস্ট কেমিক্যাল তাদের ফেসবুক পেজে সতর্ক বার্তায় জানায়, তারা মার্শাল অ্যাগ্রো নামে কোনো প্রতিষ্ঠানকে বিটিআই কীটনাশক সরবরাহ করেনি। এতে আরও বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জালিয়াতি ও প্রতারণা করে কীটনাশক সরবরাহের মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের জন্য এ কাজ করেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমে ব্যবহৃত কীটনাশক সরবরাহের কাজ পায় মার্শাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। পরে প্রতিষ্ঠানটি ৫ হাজার কেজি জৈব কীটনাশক ডিএনসিসিকে সরবরাহ করে। একইসঙ্গে দাবি করে, এগুলো বিটিআই বেস্ট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড সিঙ্গাপুরে উৎপাদিত। কিন্তু সরবরাহ করা কীটনাশক সিঙ্গাপুরের উৎপাদিত এবং সরবরাহ করা নয় বলে ওই কোম্পানির ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছে।
পরে মার্শাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে পরপর দুটি চিঠি দিয়ে ব্যাখ্যা চায় ডিএনসিসি। এরপর গত ১৭ আগস্ট মার্শাল এগ্রোভেটের পাঠানো চিঠির বিষয়ে মশক নিধন কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি কারিগরি এবং যাচাই কমিটির অনুষ্ঠিত সভায় পর্যালোচনা করা হয়। পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহ করা বিটিআই পণ্যটি যে বেস্ট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড সিঙ্গাপুরে উৎপাদিত এবং সরবরাহ করা হয়েছে এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি। এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ডিএনসিসিকে জানায়, মার্শাল এগ্রোভেট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে বিটিআই সরবরাহ করেনি বেস্ট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এছাড়া মার্শাল এগ্রোভেট বেস্ট কেমিক্যালের নিযুক্ত পরিবেশক নয়।
ধারণা করা হয় এই বিটিআই ক্রয় করা হয়েছে ভিন্ন কোনো দেশ থেকে। কিন্তু কীভাবে? এক্ষেত্রেও নেওয়া হয়েছে প্রতারণার আশ্রয়। ভিন্ন পণ্য আমদানির কথা বলে আমদানি করা হয়েছে এ ভুয়া বিটিআই, যা কোনোভাবেই সিঙ্গাপুরে উৎপাদিত বিটিআইর মতো কার্যকর নয়।
এতো গেলো একটি সমস্যার কথা। আরও সমস্যা রয়েছে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে। ডেঙ্গু মশার আবাসস্থল নিধনের জন্য মে মাস থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও সিটি করপোরেশনগুলোর বড় সব উদ্যোগ শুরু হয় জুন মাস শেষ ভাগে এসে। অর্থাৎ যখন ডেঙ্গু প্রকোপ বাড়ছে এবং বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। মশার আবাসস্থল ধ্বংস বিষয়ক জনসচেতনতা কার্যক্রমগুলোও শুরু হয় এ সময় থেকে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এটি শুরু হওয়া উচিত ছিল এপ্রিল মাস থেকে। যখন বৃষ্টি শুরু হয়।
চলতি বছর ডেঙ্গুর এ প্রকোপ আরও মাস দেড়েক থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির নিচে স্থায়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার সুযোগ নেই। আরও একটি আশার বিষয় হলো, মশাবাহিত সব রোগের জন্য তৈরি হচ্ছে টিকা। এটি এখন মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মশাবাহিত যে কোনো রোগ থেকে মৃত্যুর হার হ্রাস করতে সক্ষম হবে বিশ্ব। তবে তার আগ পর্যন্ত কেবল সচেতনতাই আমাদের রক্ষা করতে পারবে মশার হাত থেকে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস/ফারুক