ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একটি বহুল আলোচিত নাম। কয়দিন পরপর তিনি নানা প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে আলোচনার টপিক হয়ে যান। তিনি একজন নোবেল বিজয়ী। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল জয়ীর নাম ড. ইউনূস। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে নিজ দেশের ছোট বড় কোনো ইস্যুতে আমরা তাঁকে পাইনা। বরং বিশ্বব্যাংকে প্রভাব খাটিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থ বাতিল করেছেন- এমন গুরুতর অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে।
Advertisement
সংবাদপত্রের হেডলাইন হচ্ছে “আবারও আলোচনায় ড. ইউনূস”। এই “আবারও” মানে কি? পিছনে ফিরলেই উত্তরটা পাওয়া যাবে। আসলে তিনি প্রতিবার নির্বাচনের আগেই একটা করে সংবাদ হওয়ার মত উপকরণ তৈরি করেন। তিনি শান্তিতে নোবেল পেলেও দেশের চরম অশান্তির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজে দল করে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেটা প্রচলিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে। নোবেল জয়ের মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত সরকার আসার পরপরই তিনি দল গড়ার কাজে হাত দিয়েছিলেন। স্বপ্ন ছিল প্রেসিডেন্ট হবেন। দেশের মানুষতো অত বোকা নয় যে নোবেল পেলেই একজন রাজনৈতিক জ্ঞানে অশিক্ষিত ব্যক্তিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে।
দেশের কোনো ক্রান্তিকালে আমাদের শান্তির দূতকে পাওয়া না গেলেও নিজের সকল দুর্নীতি ও বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে ঠিকই বিদেশী বন্ধুদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন তিনি। এ কাজটি তিনি সবসময়েই করে আসছেন। এর আগেও বহুবার তার বন্ধু সেই সময়কার ক্ষমতাশালী ফার্স্টলেডি এবং পরবর্তীতে ওবামা প্রশাসনের নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিংটনকে দিয়েও সরকারের উপর নানা চাপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সফল হয়েছেন কি কখনও? হতে পারেননি। বরং নিজের নাম ও সুনামের প্রতি একপ্রকার অবিচার তিনি নিজেই করে চলেছেন ক্রমাগত।
এখন আসা যাক চলমান বিষয়ে। ড. ইউনূস একজন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তার মানে কি এই যে তিনি দেশের সকলপ্রকার আইন আদালত বা নিয়ম কানুনের ঊর্ধ্বে? তিনি কি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন? যেহেতু করেননি সুতরাং তিনি নিজদেশের যেকোনো আইন বা নিয়মের হাতে বন্দি যেমনটা আমি বা আমার মত সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দেশেতো ভিআইপিদের জন্য কোনো আলাদা আইন করা হয়নি বা সংবিধানেও কোথাও লেখা নেই।
Advertisement
ইউনূস সাহেবের বিরুদ্ধে যেসব মামলা চলছে সেগুলো কি সরকার করেছে? একটাও সরকার করেনি। সবটাই করেছে তারই হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান (নোবেলের অংশীদারও বটে) গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অংশীদাররা। শ্রম আদালতে যে মামলা সেটি করেছে গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীরা কারণ কর্মীদের ন্যায্য পাওনা দেয়নি বলেই অভিযোগ। ১৮ টি মামলার বিষয় হচ্ছে কর্মীদের লভ্যাংশের অংশ তিনি পরিশোধ করেননি যা সরাসরি শ্রম আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
আরও কিছু মামলা আছে যেগুলো করেছে কলকারাখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ আর কর ফাঁকির মামলাতো অনেকদিন ধরেই আলোচনায় আছে। তিনি একজন শান্তির দূত অথচ তিনি কর ফাঁকি দিয়েছেন! সেটিতো আর মিথ্যে নয়। তথ্য প্রমাণতো প্রকাশ্যেই আছে। কয়েকদিন আগেই তো উচ্চ আদালতের রায়ের পর পরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দাবি করা ১২ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার টাকার বকেয়া কর পরিশোধ করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এবার আসি বিদেশী বন্ধুদের বিবৃতি প্রসঙ্গে। যেসব নোবেল জয়ীরা বিবৃতি দিয়েছেন তারা কি জানেননা যে প্রতিটি দেশের নিজস্ব আইন ও নিয়ম আছে যা মেনে চলতে একজন নাগরিক বাধ্য? তাঁরা কি তাদের দেশের নিয়ম লঙ্ঘন করে চলেন? তাদের দেশে কি শ্রমিক ঠকানো, কর ফাঁকি দেয়া জায়েজ? অথচ উনারা একেকজন বিশ্ববাসীকে অনেক কিছু শিখাচ্ছেন। শিরিন এবাদী নিজে একজন আইনের লোক। তিনি কি সই করার আগে খোঁজ নিয়েছিলেন যে কোন মামলায় ইউনূস সাহেব দোষী আর সেই মামলা সরকার করেনি?
ড. ইউনূস আসলে কী চান বোধগম্য নয়। তিনি কি কর ফাঁকি দিতে চান, শ্রমিকের পাওনা মেরে দিতে চান, দেশের নানাবিষয়ে কলকাঠি নাড়তে চান, নাকি প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চান- মানুষজন এটাই জানতে চায়।
Advertisement
আমি নিশ্চিত যে সই করা মানুষগুলোই নিজের দেশে আইন মেনে চলে। আন্তর্জাতিক আইন কী বলছে? আন্তর্জাতিক আইনের কোথাও কি বলা আছে একজন ব্যক্তি নোবেল পেলেই তিনি আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যাবেন এবং তার বিরুদ্ধে দেশের কেউ কোন মামলা করতে পারবে না?
আন্তর্জাতিক আইনে কি বলা আছে যে একটি স্বাধীন দেশের বিচার ব্যবস্থায় অযাচিত হস্তক্ষেপ করা অন্যায় নয়? তারা যে ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে সেটি সরাসরি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং অমার্জনীয় অপরাধ। ইউনূস সাহেবের মামলা এখন দেশের বিচার ব্যবস্থায় চলমান। সেখানে সাক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কে দোষী আর কে নিরপরাধ। বিদেশীরা কি দেশের সরকারকে নির্দেশ দিতে পারে? আমাদের সরকার কি সেইসব নোবেল বিজয়ীদের কাছে কোন বন্ডসই দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে?
তারাতো কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামেরও অংশ নয় যে সেই আদালতের ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ কোন চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তাহলে তাদের কি এই সামান্য জ্ঞানটুকু নাই যে কোনো দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর সরকারও হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি হস্তক্ষেপ করে তাহলে সেই বিচার ব্যস্থা নিরপেক্ষতা হারায়?
এই আমেরিকাইনা কয়দিন আগে বললো দেশে বিচার ব্যবস্থাকে স্বাধীন দেখতে চায়। এই কি তাদের স্বাধীন দেখতে চাওয়ার নমুনা? একটি নির্বাচিত সরকারকে হুমকি দিচ্ছে একজন ব্যক্তির মামলা বিষয়ে? এই সাহস তাদের কে দিলো? ইউনূস সাহেব কি নিজেকে বাংলাদেশের আইনের চেয়েও বড় কিছু ভাবছেন? ‘বিবৃতি ভিক্ষা’ করে তিনি কি ভাবছেন বিদেশী বন্ধুরা এসে তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করে দিয়ে যাবেন? আমার মনে হয় সরকারের উচিত পাল্টা বিবৃতি দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যে বিবৃতি দাতারা কোন কোন আইন লঙ্ঘনের দায়ে অপরাধী। বিশ্ববাসী দেখুক বুঝুক।
ড. ইউনূস আসলে কী চান বোধগম্য নয়। তিনি কি কর ফাঁকি দিতে চান, শ্রমিকের পাওনা মেরে দিতে চান, দেশের নানাবিষয়ে কলকাঠি নাড়তে চান, নাকি প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চান- মানুষজন এটাই জানতে চায়।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস