মতামত

ছেলেশিশুও যখন ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি থেকে নিরাপদ নয়

মাত্র ১৩ বছর বয়সী ছেলে শিশুটি হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ছাত্রটির মলদ্বারে ক্যান্সার ধরা পড়ে। পরে ঢাকার মহাখালী জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ আগস্ট শিশুটির মৃত্যু হয়। ঘটনাটি মর্মান্তিক। কিন্তু এর চাইতেও বেশি ভয়াবহ হচ্ছে শিশুটি ধারাবাহিকভাবে যৌন নির্যাতনের কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।

Advertisement

অভিযুক্ত সেলিম গাজী মাদ্রাসার পরিচালক ছিলেন। র‌্যাব জানিয়েছে ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর শিক্ষার্থীদের নিয়ে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে শিক্ষা সফরে যান মাদ্রাসার শিক্ষকরা। ওই রাতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে বলাৎকার করেন পরিচালক সেলিম গাজী। পরে বিষয়টি কারও কাছে প্রকাশ না করার জন্য ভয় দেখিয়েছেন। এতে ওই শিশু বিষয়টি কারও কাছে প্রকাশ করেনি। শিক্ষা সফর থেকে ফিরেও শিশুটিকে বিভিন্ন সময় যৌন নির্যাতন করা হয়েছিল। ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়লে অভিযুক্ত ধর্ষক তাকে নানা ওষুধ দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করলেও, ছেলেটি শেষপর্যন্ত মারা যায়। বলাৎকারের ফলে মৃত্যুর এটা সবচেয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মোট ২৮ জন বালককে বলাৎকার বা ধর্ষণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের বয়স ৬ বছরেরও কম। বাকি ৯ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ এর মধ্যে। এছাড়া বলাৎকারের চেষ্টা করা হয়েছিল আরো ৬ জনকে।

এছাড়াও শুধু এই আগস্ট মাসেই বলাৎকারের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। নওগাঁর রাণীনগরে যৌন হয়রানিসহ নানান অভিযোগে আল-আমিন দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক হারুনুর রশিদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। শিশুটির মা অভিযোগে বলেছেন যে তার ক্লাস ফাইভের ছেলেকে শিক্ষক হোষ্টেল থেকে তুলে নিয়ে বলাৎকার করেছেন।

Advertisement

অন্যদিকে মাদ্রাসার ভেতরে এক শিশু শিক্ষার্থীকে বলাৎকার করে পালিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের এক মাদ্রাসা শিক্ষক। ভুক্তভোগী শিশুটি বলেছে যে সে অসুস্থ হয়ে গেলে কাউকে কিছু বললে, হুজুর তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল। স্কুলছাত্র বলাৎকারের ঘটনায় চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে এক মসজিদের ইমামের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। রক্তাক্ত অবস্থায় ওই স্কুলছাত্রকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নির্যাতনের শিকার ৮ বছর বয়সী শিশুটি স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। শিশুকে বলাৎকারের দৃশ্য দেখে ফেলায় আরেক শিশু শিক্ষার্থীকে শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।

আমরা অনেকেই মনেকরি শুধু মেয়েশিশু ও নারীরাই যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু এই ধারণা একেবারে ভুল। বাংলাদেশে প্রতি চার জন মেয়েশিশুর মধ্যে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, আর প্রতি ছয় জন ছেলেশিশুর মধ্যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় একজন। শুধু পুরুষ নয়, শিশুরা কখনো কখনো নারীর হাতেও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে।

পুরুষরাই প্রধানত যৌন নির্যাতনকারী হলেও, নারীদের বিরুদ্ধেও আছে যৌন হয়রানির অভিযোগ। আগে মানুষ সামাজিক ট্যাবুর কারণে ছেলেদের যৌন হয়রানি নিয়ে মুখ খুলতো না। অবশ্য শুধু ট্যাবু নয়, অনেক অভিভাবকদের মধ্যে ধারণাই ছিল না যে, ছেলেশিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। তাই তারা মেয়ে শিশুদের নিয়েই সাবধান থাকেন বা মেয়েশিশুদেরই সচেতন করেন।

যৌন হয়রানির ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে বাড়িতে, আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধুদের বাড়িতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ছাত্রাবাসে। মনোচিকিৎসকরা বলেন, পরিচিতজন ছাড়া শিশুদের যৌন হয়রানির ঘটনার নজির খুবই কম।

Advertisement

ছন্দা করিম (ছদ্ম নাম) ও তার স্বামী দুজনেই কর্মরত। তাদের ছেলের যখন ৫ বছর বয়স, তখন বাসার যে গৃহকর্মীর কাছে সে থাকতো, সেই নারী নিয়মিতভাবে শিশুটিকে যৌন নিপীড়ন করতো। ক্রমে শিশুটি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলে এবং ঐ গৃহকর্মীকে ভয় পেতে শুরু করলে, তারা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। এরপর তারা বিষয়টি সম্পর্কে বুঝতে পারেন। এই ঘটনা তাদের উপর এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে নিজেরাই অসুস্থবোধ করতে শুরু করেছিলেন। পরে পুরো পরিবারকে কাউন্সিলারের কাছে যেতে হয়েছিল।

একইরকম আরেকটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন আলী (ছদ্মনাম)। জেলা শহরে স্কুলে পড়ার সময়ে ছাত্রাবাসে থাকলেও, মাঝেমাঝে খালার বাসায় যেতো। সেখানে তার খালাতো বড় বোন নিয়মিত তাকে যৌনাচারে বাধ্য করতো। ক্রমে ভয়ে সে খালার বাসায় যাওয়া বন্ধ করেছিল। এইট/নাইনে ওঠার পর বন্ধুদের সামনে মুখ খুলতে পেরেছিল শিকদার। ততোদিনে তার স্কুল জীবন প্রায় শেষ হয়ে আসাতে রক্ষা পেয়েছে সে। কিন্তু এই ঘটনা তাকে মানসিকভাবে ভয়াবহ অসুস্থ করে তুলেছিল। তাকেও নিয়মিতভাবে কাউন্সিলিং করাতে হয়েছে।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড এডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি'র সহযোগী অধ্যাপক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে যৌন হয়রানির শিকার শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। আর এই কাজ করতে গিয়ে তিনি যৌন হয়রানি নিয়ে ক্লিনিক্যাল গবেষণা করেছেন। তাঁর এই গবেষণায় শিশুদের যৌন হয়রানি বিষয়ে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। তাতে দেখা যায়, শতকরা ৭৫ ভাগ যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে। আর ছেলে শিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রায়শই। (সূত্র: ডয়েচ ভেলে)

আমাদের পরিবার ও সমাজে হয়তো এখন কিছু কিছু মেয়েশিশুকে বাবা মা সাবধান করেন বা চোখে চোখে রাখেন। কোনটা গুড টাচ, কোনটা ব্যাড টাচ তাকে তা জানানো হয়। কিন্তু ছেলেশিশুর ব্যাপারে একেবারে উদাসীন। একটি ছেলে শিশুকে কেউ চুরি বা অপহরণ করতে পারে, কিন্তু তাকে বলাৎকার করবে, এটা তারা ভাবেন না। বাংলাদেশের সমাজে বলাৎকার অপরিচিত বিষয় ছিল। তবে ইদানিং বাবা-মায়েরা বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলছেন।

২০২০ সালে ময়মনসিংহের নান্দাইলে একজন শিক্ষার্থী 'নেইল কাটার' দিয়ে তার মাদ্রাসা শিক্ষকের পুরুষাঙ্গে আঘাত করেছে। কারণ তাকে বলাৎকারের চেষ্টা করেছিল বলে অভিযোগ করেছে ১৬ বছর বয়সী ছাত্রটি। বাবা মা সরল বিশ্বাসে সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়তে পাঠান সন্তান আলেম হবে বলে। আবাসিক ব্যবস্থা থাকায় এবং বিনা খরচে বা কম খরচে পড়ানো যায় বলে মাদ্রাসা শিক্ষা অনেক বেশি আকর্ষণীয় এদেশের অভিভাবকদের কাছে।

সেই বিশ্বাসের জায়গায় যখন এরকম ঘটনা ঘটে, তখন অভিভাবকরা ভাবতেন, ধর্মশিক্ষা দেয়া মানুষগুলো এ ধরনের জঘন্য কাজ করেন কীভাবে? অভিভাবকদের একজন বলেছেন, ‘ছেলের মুখ থেকে ঘটনা শুনে লোকলজ্জার বিষয় ভেবে প্রথমে চুপ ছিলাম। পরে যখন চিন্তা করলাম আজকে আমার ছেলের সঙ্গে এমন হয়েছে, কাল আরেকজনের সঙ্গে করবে। তাই লজ্জা-শরম বাদ দিয়ে প্রথমে ইউএনওকে জানাইলাম। তার সহযোগিতায় থানায় গিয়ে মামলা করেছি প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে।”

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে কাওমী ধারার মাদ্রাসায় নজরদারি না থাকার কারণে সেখানে ছাত্রছাত্রীদের উপর যৌন নির্যাতনসহ অন্য নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০ সালে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত “ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতন ও যৌন হয়রানি বন্ধে করণীয়” শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এই বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছিল।

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীনে না থাকার কারণে কাওমী মাদ্রাসায় ঠিক কী হচ্ছে এবং কিভাবে এখানে নিপীড়ন বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব, তা স্পষ্ট নয়। কাওমী মাদ্রাসাসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ণসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা এতদিন ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হলেও, এখন সেইসব ঘটনা ক্রমশ সবার সামনে চলে আসছে।

দরিদ্র ঘরের অনেক শিশু কাওমী মাদ্রাসায় থাকা খাওয়ার সুবিধা পায় বলে, এখানে পড়তে আসে। কাজেই তাদের উপর নির্যাতন করা হলে, এদের পক্ষে মুখ খোলার কেউ থাকেনা। সময় এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধে একটা সামগ্রিক এপ্রোচ নেয়ার।

শুধু মাদ্রাসাতেই কি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে? ২০২০ সালে ৭০০ ক্যাথলিক ধর্মগুরু এবং থাইল্যান্ডে মংকদের বিরুদ্ধের যৌন হয়রানির অভিযোগ এসেছে। ক্যাথলিক গির্জার যাজকসহ অস্ট্রেলিয়ার চার হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বিরুদ্ধে শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই ক্যাথলিকদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। (সূত্র: ২০১৭, ডয়েচ ভেলে)

জার্মানিতে ক্যাথলিক চার্চের যাজকদের দ্বারা হাজারো শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১৯৪৬ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে। ১৬৭০ জন যাজককে চিহ্নিত করা হয়েছিল, যাদের দ্বারা শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল। যৌন হয়রানির শিকার শিশুদের বয়স ছিল ১৩ বছরের কম এবং তাদের বেশিরভাগই ছেলেশিশু। পোপ ফ্রান্সিস এ নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, নিপীড়িতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। কিন্তু নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় তাঁর সমালোচনাও হয়েছে।

আমরা দেখেছি বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ছেলেশিশুর প্রতি যৌন হয়রানি ও বলাৎকার প্রসঙ্গে কোনো স্পষ্ট ধারণা দেয়া হয়নি। তাই আইনজীবী ও পুলিশের কাছেও এটা পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের যে সংজ্ঞা, সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী ও মেয়েদের কথাই বলা আছে। আইনের এই দিকটার সুযোগ গ্রহণ করছে অপরাধীরা।

অনেক দিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন পুরুষ বা নারীর যৌন ক্ষুধার শিকার হয় ছেলেশিশুরা। এছাড়াও সমকামী ও বিকৃত রুচির মানুষেরাও ছেলেশিশুদের উপর যৌন নিপীড়ন চালাতে পারে বা চালায়। কাজেই এখনই সময় এসেছে ছেলেশিশুর যৌন নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার। ছেলেশিশু নিরাপদ এবং যৌন হয়রানির শিকার হবে না, পরিবারের এই ধারণা বদলাতে হবে। শিশুকে সচেতন করুন, নিজেও সচেতন হোন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়টি জবাবদিহিতার সংস্কৃতির আওতায় আনতে হবে। বাবা মা বিশ্বাস করে তাদের শিশুকে শিক্ষাঙ্গনে পাঠান, সেখানে যদি শিশু এইভাবে নিপীড়নের শিকার হয়, তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। আমরা চাইবো সরকার যেন সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে, মাদ্রাসা ও হোস্টেলে নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। ছেলেশিশু বা মেয়েশিশুর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি হলে ভয় না পেয়ে মুখ খুলতে হবে এবং তা এখুনি।

৩০ আগস্ট, ২০২৩লেখক: যোগাযোগকর্মী।

এইচআর/এএসএম