দেশজুড়ে

রোগী আসে না বলে চেম্বারে বসেন না চিকিৎসকরা

নওগাঁ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চালু হওয়া বৈকালিক চিকিৎসাসেবার সুফল মিলছে না। পর্যাপ্ত রোগী না হওয়ায় চিকিৎসকরাও সময়মতো আসেন না। এরপর কোনো রোগী এলে তাদের বসিয়ে রেখে চিকিৎসকদের মোবাইল ফোনে ডেকে এনে দেওয়া হচ্ছে সেবা। এতে বিরক্ত হচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একই সেবা সকালে কম টাকায় মেলায় বিকেলে রোগীরা বেশি টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখাতে চান না। তাই বৈকালিক সেবায় কোনো দিন এক-দুইজন রোগী এলেও কোনোদিন আবার রোগীর দেখাই মেলে না।

নওগাঁ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তথ্যমতে, এই হাসপাতালে প্রতিদিন সকালে আউটডোরে পাঁচ টাকার টিকিট কেটে রোগী দেখান অন্তত ১২০০ থেকে ১৫০০ জন। সেখানে বৈকালিক সেবায় রোগী নেই বললেই চলে। এপ্রিল মাসে এখানে প্রথম বৈকালিক সেবা চালু হয়। ওই মাসে রোগী হয়েছে মাত্র ৩৪ জন। মে মাসে রোগী হয় ৩৪ জন। জুন মাসে চিকিৎসা নেন ১৮ জন। জুলাই মাসে বৈকালিক সেবা দেওয়া হয় ২৮ জনকে। আর আগস্ট মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন ২৮ জন রোগী। অর্থাৎ বৈকালিক সেবা চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৪২ রোগী সেবা নিয়েছেন।

জানা যায়, এই সেবার আওতায় প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সিনিয়র ও জুনিয়র কনসালট্যান্টরা সরকারি নির্ধারিত ফিতে রোগীদের সেবা দেন। বৈকালিক ডিউটিতে একজন অধ্যাপকের ফি ৫০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ফি ৪০০ টাকা, সহকারী অধ্যাপকের ফি ৩০০ টাকা এবং এমবিবিএস/বিডিএস ও সমমানের চিকিৎসকদের ফি ২০০ টাকা।

Advertisement

গত রোববার (২৭ আগস্ট) বিকেল ৩টায় সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের পুরাতন ভবনের নিচ তলার প্রবেশমুখে বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে কাউন্টার খোলা হয়েছে। কাউন্টারে দায়িত্বে থাকা দুইজন সেখানে বসে থাকলেও চারপাশে সুনসান নীরবতা। রোগীর উপস্থিতি নেই, নেই কোনো চিকিৎসকও। পাশেই চিকিৎসকের রুমগুলো তালাবদ্ধ। অথচ কাউন্টারের ওয়ালে টাঙানো তালিকায় দেখা গেলো, ওইদিন বৈকালিক সেবা দেবেন চারজন চিকিৎসক।

এরপর বিকলে ৩টা ২০ মিনিটে শহরের পার-নওগাঁ থেকে এক দম্পতি আসেন সেবা নিতে। কাউন্টারে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পারলেন- রোগী না থাকায় চিকিৎসক বসেননি এখনো। রোগী আসার বিষয়টি চিকিৎসককে জানালে তিনি এসে চিকিৎসা দেবেন। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে।

বিকেলে কাউন্টারে দায়িত্বে ছিলেন হাসপাতালের কর্মচারী গোলাম কবির খান। সেবা নিতে আসা রোগীদের অপেক্ষা করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোগী না থাকার কারণে ডাক্তারও নেই। এইমাত্র একজন রোগী এসেছেন। আমি সিনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি) ডা. দিলরাজ বানুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি চলে আসবেন।

তিনি আরও বলেন, বৈকালিক সেবায় রোগীদের চাপ না থাকায়, ওইভাবে চেম্বারে চিকিৎসকরা বসেন না। কোনো রোগী আসলে চিকিৎসকদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করে আসতে বললে তারা এসে চিকিৎসা দেন।

Advertisement

চিকিৎসা নিতে আসা ওই দম্পতির একজন বললেন, আমরা জানতাম না এখানে বৈকালিক চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এক আত্মীয়ের কাছে শুনে আসলাম। কিন্তু এসে দেখি, যে চিকিৎসককে দেখাবো তিনি নেই। দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তি বললেন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন ডাক্তারকে ফোন দিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন। এজন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু এক ঘণ্টার বেশি সময় হয়ে গেলো, এখনো ডাক্তার আসেননি। ডাক্তার এলে চিকিৎসা নিয়ে চলে যাবো।

এরপর সেখানে অপেক্ষা করে দেখা যায়, বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ডা. দিলরাজ বানু বৈকালিক সেবা দিতে হাসপাতালে আসলেন। পরে অপেক্ষা করা সেই রোগীকে সেবা দিয়েই ৪টা ৪২ মিনিটে আবারও হাসপাতাল থেকে চলে গেলেন। ওই সময় পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসা নিতে আর কোনো রোগীকে দেখা যায়নি।

বিকেল ৩টা থেকে বৈকালিক সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রায় দেড় ঘণ্টা পর হাসপাতালে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. দিলরাজ বানু বলেন, সারাদিন রোগী দেখেছি। সকালে বেশি রোগী হচ্ছে কিন্তু বিকেলে রোগী নেই। আজ বিকেলে মাত্র একজন রোগী আসার খবর পেয়ে চেম্বারে এসে ওই রোগীকে দেখলাম।

তিনি আরও বলেন, মূলত মানুষ এইটার বিষয়ে আগ্রহী নয়। কারণ, একই চিকিৎসক সকালে পাঁচ টাকায় দেখছেন, বিকেলে দেখছেন ৪০০ টাকায়। এছাড়া রোগীরা সকালে ওষুধও পাচ্ছেন কিন্তু বিকেলে বেশি ফি দিয়ে দেখিয়েও ওষুধ মিলছে না। প্রচার-প্রচারণা না হওয়ায় রোগীরা বৈকালিক সেবার বিষয়ে এখনো পুরোপুরি জানেন না। মূলত এসব কারণেই বিকেলে রোগী হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওইদিন হাসপাতালে ডা. দিলরাজ বানু ছাড়া আরও তিনজন চিকিৎসক দায়িত্বে ছিলেন। তারা হলেন- সিনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি) ডা. মুক্তার হোসেন, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (পেডিয়াট্রিক্স) ডা. ফারহানা আক্তার ফারুক, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অর্থো) ডা. রেজাউল আলম। বিকেল ৫টা পর্যন্ত তাদের কাউকেই সেখানে পাওয়া যায়নি।

চেম্বারে না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মুক্তার হোসেন বলেন, বিকেলে আমার কোনো রোগী ছিল না। এজন্য চেম্বারে ছিলাম না। তবে আশপাশেই ছিলাম।

এ বিষয়ে নওগাঁ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, সাধারণ মানুষ বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে আগ্রহী না। একই সেবা সকালে কম টাকায় মেলায় বিকেলে রোগীরা বেশি টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখাতে চান না। এজন্য রোগী কম হয়।

রোগীকে বসে রেখে চিকিৎসকদের মোবাইল ফোনে ডেকে এনে সেবা দেওয়া হয়, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোগী কম থাকায় হয়তো ডাক্তাররা চেম্বারে বসেন না। রোগী বেশি হলে অবশ্যই নিয়মিত চেম্বারে বসে সেবা দেবেন।

এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. আবুহেনা মুহাম্মাদ রায়হানুজ্জামান সরকার বলেন, এই সেবার বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে বলে থাকি। যাতে করে সবাই বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা নেন। তবে মাইকিং করার কোনো নির্দেশনা নেই। আশা করছি, আস্তে আস্তে সবাই জেনে যাবে।

এমআরআর/জিকেএস