জাগো জবস

মানুষের কটু কথা অনেক কষ্ট দিয়েছে: মামুন

আব্দুল্লাহ আল মামুন ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে (উদ্ভিদ বিজ্ঞান) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের চৌমুখ গ্রামে তার বাড়ি, তবে জন্মস্থান নানাবাড়ি পাকশিয়া গ্রাম। বাবা আবুল কালাম আজাদ, মা শাহীনা আক্তার। তিনি আলহাজ আমেনা খাতুন বিদ্যাপীঠ থেকে এসএসসি এবং পাংশা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানে ভর্তি হন। সেখান থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করেন।

Advertisement

সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মমিন উদ্দিন—

জাগো নিউজ: বিসিএসে ক্যাডার পাওয়ার অনুভূতি কেমন? আব্দুল্লাহ আল মামুন: এটা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। বরফ ঢাকা শীতকাল পেরিয়ে যেমন বসন্তের আগমন ঘটে কিংবা মরুভূমির বুকে এক পসলা বৃষ্টির মতো। পথহারা নাবিকের গন্তব্য খুঁজে পাওয়ার মতো। মরুর বুকে হারিয়ে যাওয়া ঘোড়ার মতো। প্রথমে একমাত্র ছোট বোন মীম ফোন দিয়ে জানায়। রেজাল্ট শিটে নিজের রোল দেখে চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মেসের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আবার রোল মিলিয়ে নিশ্চিত হলাম। মহান রবকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম। প্রথমে আব্বুকে ফোন দিলাম। আম্মু ধরলেন, শুনে শুধু কাঁদলেন। অনেক ইচ্ছা ছিল সবাইকে বলার, আমি ভালো কিছু করেছি। আল্লাহ সুযোগ করে দিয়েছেন। অনাগত শিশুর মতো পরিবারের সবাইকে খুশি করতে পেরেছি।

আরও পড়ুন: আব্বা খুশিতে কান্না করে দিয়েছেন: গালিব

Advertisement

জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল?আব্দুল্লাহ আল মামুন: আমি কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসেছি। বাবার রক্ত পানি করা টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। প্রচুর টিউশনি করতে হয়েছে। থাকতাম পুরান ঢাকায়। টিউশনি করতাম মালিবাগ। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি নোয়া খালা, ছোট মামা এবং ছোট খালার প্রতি। ছোট মামা নানাভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বিশেষ করে নোয়া খালা এবং ছোট খালাকে, আমার খুব বাজে সময়ে (করোনা পরবর্তী) তারা যেভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, মানসিকভাবে সব সময সমর্থন দিয়েছেন। তাদের এ নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না। আমার একাডেমিক কিছুটা গ্যাপ ছিল। ফলে নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে। অনেকগুলো সরকারি চাকরির ভাইবা দিয়ে যখন কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাচ্ছিলাম না; তখন অনেকেই এমন কিছু কথা বলেছেন। তখন শুধু মুখ বুজে সহ্য করেছি। মা শুধু কান্না করতেন। দোয়া করতেন আর বলতেন, আল্লাহ তোমাকে হতাশ করবে না। অনেকে এমনও বলেছেন, ‘ও যদি কিছু করতে পারে তাহলে...’। যখন কেউ ভরা মজলিসে (বাবা-মার সামনে) বলেন, বিসিএস ভাইবা দেওয়ার পরও অনেকে দশ-বারো হাজার টাকার চাকরি করে। যারা এ বেতনে চাকরি করেন, তাদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, তখন কেমন লাগে? যারা ভুক্তভোগী তারাই জানেন। আরও কিছু কথা; যেগুলো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। শেষের দিকে এসে ঈদের আগের দিন বাড়ি গিয়েছি। পরের দিন চলে এসেছি। বাড়ির বাইরে বের হতাম না। সব সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতাম। সবার প্রশ্ন, এখন কী করছো? প্রশ্নগুলো শেষের দিকে এসে তীরের মতো বিদ্ধ হতো। আমি বারবার পরে গিয়েছি আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। মচকে গিয়েছি কিন্তু ভাঙিনি। মায়ের অশ্রুসিক্ত মুখ আর বাবার ক্লান্ত ঘর্মাক্ত শরীর আমাকে কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?আব্দুল্লাহ আল মামুন: একাডেমিক রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পর থেকেই চাকরির কথা চিন্তা করতে থাকি। এটা বেশি প্রভাবিত করেছে। ৩৫-৩৬তম বিসিএসের রেজাল্টে তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪-৫ বিষয়ে প্রথম হয়েছে। তখন মনে হয়েছে আমার দ্বারাও সম্ভব। যদিও বাবার ইচ্ছা ছিল (সব সময় বলতেন) আমার ছেলে প্রশাসন ক্যাডার হবে।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—আব্দুল্লাহ আল মামুন: অনার্স শেষ করে বিসিএসের পড়া শুরু করি। একটা কোচিংয়ে ভর্তি হই বন্ধুরা মিলে। প্রথম দুটি বিসিএসে অকৃতকার্য হই এবং মানসিকভাবে ভেঙে পরি। তবে কয়েকটি ভাইবা কিছুটা আশান্বিত করেছিল, যদিও চাকরি হয়নি। প্রস্তুতি যখন তুঙ্গে; তখনই আসে করোনা। ঢাকা থেকে চলে গেলাম বাড়ি। প্রস্তুতিতে ভাটা পড়লো। একদিকে ভাইরাস অন্যদিকে বয়সের টান। হতাশা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। এর মধ্যে ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার তারিখ হলো। দিন-রাত এক করে পড়লাম। এমনও হয়েছে, জ্বর এসেছে; ওষুধ খেয়ে লাইব্রেরিতে গেছি আবার। ওষুধ খেয়ে পড়তে বসেছি। আসলে আমার অন্য কোনো উপায় ছিল না। ভালো পরীক্ষা হলো, টিকলাম এবং রিটেনটা ভালোমতো দিলাম। রিটেনের পর একটা ঝড় এসে জীবনটাকে পুরো এলোমেলো করে দিয়েছিল। ধন্যবাদ বন্ধু জসীমকে খারাপ সময়ে পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য। ভাইভায় ডাক পেলাম। শরীফ মাফির সঙ্গে ভাইভা প্রিপারেশন নিলাম। যেহেতু আগে বিপিএসসি যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। খুব বেশি নার্ভাস ছিলাম না। ভাইভা ভালো হলো। সবশেষে সুপারিশপ্রাপ্ত হলাম।

আরও পড়ুন: বিসিএস ভাইভা নিয়ে ভয়েই ছিলাম: হারুনুর রশিদ

Advertisement

জাগো নিউজ: কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?আব্দুল্লাহ আল মামুন: মায়ের অশ্রুসিক্ত নয়ন এবং বাবার ঘর্মাক্ত দেহই আমার অনুপ্রেরণা। আমি এখনো কিছু করতে পারছি না। তাদের কোনো কাজে আসতে পারছি না। যা আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে। সেখান থেকে শক্তি লাভ করেছি। কিছু করার চেষ্টা করেছি। আল্লাহ দিয়েছেন। ৩৫তম বিসিএসে ডিপার্টমেন্টের অনেকে ক্যাডার হয়েছেন। যা আমাকে আশান্বিত করেছে। তাছাড়া হাল ছেড়ে না দেওয়ার মানসিকতাই আমাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে আর মা-বাবার দোয়া।

জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?আব্দুল্লাহ আল মামুন: আদর্শ শিক্ষক হতে চাই। আল্লাহ তাআলা জাতি গঠনের যে সুযোগ দিয়েছেন, তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যাবহার করতে চাই। পাশাপাশি সবাইকে ভালো রাখতে চাই। নিজের ফ্যামিলি, সমাজ ও দেশকে কিছু দিতে চাই।

জাগো নিউজ: যারা বিসিএস পরীক্ষা দিতে চান, তদের জন্য পরামর্শ—আব্দুল্লাহ আল মামুন: যাদের স্বপ্ন ভালো কিছু করা, তাদের আমি বলবো নিজের সাবজেক্টটা ভালোভাবে পড়তে। কারণ এটা সব জায়গায় লাগবে। আমাদের দেশে একটা কথা চালু আছে—অনার্সে পড়তে হয় না। এটি সম্পূর্ণ ভুল। ৩য় বর্ষ পরীক্ষার পর থেকেই চাকরির জন্য ভালোমতো পড়া শুরু করা উচিত। যাদের অঙ্ক ও ইংরেজি সমস্যা আছে, অনার্স ১ম বর্ষ থেকেই এ দুটি সাবজেক্ট একটু একটু করে পড়া উচিত।

এসইউ/জেআইএম