ফিচার

বিশ্বের যে স্থানের মানুষ এখনো পোশাক পরেন না

ইন্টারনেট এখন পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। কোথায় কখন কী ঘটছে তা বিশ্বের যে কোনো স্থানে বসেই জানতে পারছেন। তবে এখনো এমন এক জাতি আছে যারা একবিংশ শতাব্দীতেও সভ্যতার আড়ালে। আধুনিকতার কিছুই পৌঁছায়নি তাদের কাছে। এখনো কাপড়ের ব্যবহারই জানেন না তারা।

Advertisement

ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের একটি প্রত্যন্ত দ্বীপে বাস করে এক উপজাতিরা। দ্বীপটির নামানুসারেই এদের বলা হয় সেন্টিনেলিজ জাতি বা গোত্র। দ্বীপটির নাম সেন্টিনেল। সেখানেই ৬০ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই জাতির বাস। ১২৯৬ সালে মার্কো পোলোর লেখায় উল্লেখ মেলে সেন্টিনেলিজদের! তিনি লিখেছিলেন, এই উপজাতির মানুষরা নরখাদক। এদের চোখ লাল, তীক্ষ্ণ দাঁত। দ্বীপের বাসিন্দা নয়, এমন কাউকে দেখলেই এরা আক্রমণ করে এবং মেরে ফেলে। যদিও ঐতিহাসিকদের মতে, মার্কো পোলো আদৌ আন্দামানে আসেননি। সম্ভবত কারও মুখে তিনি এই বিষয়ে শুনেছিলেন। সেখান থেকেই নিজের মতো করে তাদের বিবরণ দিয়েছেন।

সমুদ্রের বুকে এক নির্জন কোণে অবস্থিত নর্থ সেন্টিনেল। ভৌগোলিক কারণে মেলা ‘নির্জনতা’র আড়ালে নিজেদের জন্য একটি নিভৃত কোণ বেছে সভ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিন গুজরান তাদের। অন্য কারও উপস্থিতি তাদের একেবারেই পছন্দ নয়। একা থাকতেই ভালোবাসেন তারা।

আরও পড়ুন: নরখাদক হিসেবে পরিচিত যে উপজাতি

Advertisement

২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিক জন অ্যালেন চাউ সেখানে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ২৬ বছরের মার্কিন মিশনারি অ্যালেন সেখানে যেতে গেলে তাকে হত্যা করে সেন্টিনেলিজরা। তারপর কবরও দিয়ে দেওয়া হয় দ্বীপেই। দীর্ঘদিন ধরেই ভারত সরকার নর্থ সেন্টিনেল ও তার চারপাশের ৩ নটিক্যাল মাইল এলাকায় প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু ওই অস্ট্রেলীয় যুবক সেখানে তাও গিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার অধিবাসীদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা। শুরুতেই কিন্তু সেন্টিনেলরা তাকে মেরে ফেলেনি, পদুইবার তীর ছুঁড়ে সতর্ক করেছে তাদের কাছে না যাওয়ার। কিন্তু কথা শোনেননি অ্যালেন। তৃতীয় বারের প্রচেষ্টার সময়ই প্রাণ খোয়াতে হয় তাকে।

এদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। কাউকেই ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না সেন্টিনেলরা। এখানকার নারী পুরুষ উভয়েই উলঙ্গ হয়েই থাকে। তারা জানেও না শরীরে লজ্জাস্থান ঢেকে রাখতে হয়! তবে ঠিক কতজন মানুষ এখানে রয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ২০১১ সালের ভারতীয় আদমশুমারিতে ১২ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী। রিপোর্টে প্রাপ্ত ফলাফল হেলিকপ্টার থেকে উপজাতি পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া যায়। অন্যান্য বিষয়ক গবেষণা থেকে অনুমান করা হয় এদের সংখ্যা ১০৫ অথবা ৩৯ থেকে ৪০০ এর মধ্যে।

সেন্টিনেলদের এখানে বসবাস প্যালিওলিথিক সময় থেকে শুরু হয়েছে বলে ধারণা অনেকের। সেন্টিনেলরা ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার বছর আগে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এসেছিলেন বলে মনে করা হয়। এই উপজাতিরা আফ্রিকা ছেড়ে যাওয়া প্রথম ব্যক্তির বংশধর হতে পারে। পোর্ট ব্লেয়ারে একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে, সেন্টিনেল দ্বীপের বাসিন্দারা হলো আসলে পাঠান দণ্ডপ্রাপ্তরা। তারা ছিলেন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের একটি গোত্র। যারা ব্রিটিশ কারাগার থেকে পালিয়ে দ্বীপটিতে লুকিয়ে রয়েছে।

আরও পড়ুন: স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গেই বছরের পর বছর ঘুমান তারা

Advertisement

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে মূলত চারটি আফ্রিকার উপজাতি গোত্র বাস করে। গ্রেট আন্দামানিজ, অনেজ, জারাওয়া এবং সেন্টিনেলিজ। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাস করে দুইটি মঙ্গোলয়েড গোত্র-শোম্পেন এবং নিকোবারিজ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর এই দ্বীপে একটি কারা কলোনি স্থাপন করে, যেখানে বন্দীদের আটকে রাখা হত। কিছুদিন পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গেই তাদের লড়াই শুরু হয়ে যায়। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে গ্রেটার আন্দামালিজ বাহিনীর সঙ্গে প্রথম লড়াই হয় ১৮৫৯ সালে। যার ফলাফল সহজেই ধারণা করা যেতে পারে। যুদ্ধ এবং রোগের বিস্তারের কারণে স্থানীয় গোত্রগুলোয় দ্রুত জনসংখ্যা কমতে শুরু করে। তবে সেন্টিনেলরা বাস করতো একটি দূরের দ্বীপে, ফলে এই দ্বীপের বাসিন্দা ঔপনিবেশিক শাসনের আওতার বাইরে থেকে যায়।

বেশ কয়েকবারই এই দ্বীপের মানুষদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত। তবে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে তারা। বর্তমানে এই গবেষণা পুরোপুরি স্থগিত করে দিয়েছে ভারত সরকার। এই উপজাতি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় নগ্ন এই মানুষগুলোর ভাষা দুর্ভোদ্য এক ভাষা। এই দ্বীপের আশেপাশে থাকা অন্য গোত্রগুলোর ভাষার অনেকটা কাছাকাছি ধরনের। সেন্টিনেলিজরা খুব লম্বাও নয়, আবার খুব খাটোও নয়। তারা তীর ধনুক বহন করে।

আদিম মানুষের মতোই শিকারই এদের জীবিকা। নৃতত্ত্ববিদরা আকাশপথে বা সমুদ্রে নিরাপদ দূরত্ব থেকে যতটুকু দেখতে পেয়েছেন, তা থেকেই এই সব তথ্য মিলেছে। এই আদিবাসী গোত্রের লোকজন তীর ধনুক দিয়ে মাছ ও বুনো শুকর শিকার করে। এছাড়াও গাছের শিকড়, বনের ফলমূল আর মধু তাদের প্রধান খাবার।

তবে শুরুতেই কিন্তু এই জাতি এমন হিংস্র ছিল না। অতীতে সেন্টিনেলিজরা একটি শান্তিপ্রিয় জাতি ছিল। তারা মানুষজনের ওপর হামলা করত না। তারা আশেপাশের এলাকায় কখনো যেত না বা কারও সঙ্গে ঝামেলাও তৈরি করত না। তবে ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ এম ভি পোর্টম্যানের নেতৃত্বে একটি দল সেখানে গিয়েছিল। এক প্রৌঢ় দম্পতি ও চারটি শিশুকে তুলে আনে তারা। উদ্দেশ্য এদের পরীক্ষা করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই মানুষেরা কেউই বেশিদিন বাঁচেনি। মূলত এই বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি সেন্টিনেলিজরা। আধুনিক মানুষের প্রতি অবিশ্বাস ও ক্ষোভ তাদের বাড়তেই থাকে। ধীরে ধীরে হিংস্র হয়ে ওঠে তারা।

সূত্র: বিবিসি

কেএসকে/জেআইএম