দেশজুড়ে

সিলেটে বন্ধের পথে ‘নগর এক্সপ্রেস’

নগরবাসীকে উন্নতমানের ও সাশ্রয়ী ভাড়ায় গণপরিবহন সেবা দিতে ২০১৯ সালে দ্বিতীয় দফায় সিলেটে চালু করা হয় ‘নগর এক্সপ্রেস’ বাস সার্ভিস। যাত্রা শুরু ২১টি বাস নিয়ে। চালুর কয়েকদিনের মাথায় আরও ২০টি নতুন বাস এলেও সেগুলো ফেরত পাঠানো হয়।

Advertisement

২১টি বাসের মধ্যে এখন নিয়মিত চলাচল করছে ১৩-১৪টি। বাকি আটটি বাসের মধ্যে তিন-চারটি নষ্ট হয়ে গেছে। যেগুলো চলছে তার মধ্যে তিন-চারটি বাস অলস বসিয়ে রাখা হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশা শ্রমিক ও পুলিশের বাধার কারণে। যে বাসগুলো চলাচল করছে সবগুলোই ভাঙাচোরা।

যাত্রার শুরুতে চলাচল করতো নগরের ১০টি রুটে। এখন সঙ্কুচিত হতে হতে মাত্র দুটি রুটে চলাচল করছে এসব বাস। অথচ একসময় এ বাসগুলোই ছিল নগরবাসীর একমাত্র গণপরিবহন।

এর আগে ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিলেট নগরে ‘টাউন বাস সার্ভিস’ চালু করা হয়। চকচকা রঙের ২৫ সিটের ৩৫টি মিনিবাস শুরুতে টুকেরবাজার, মোগলাবাজার, হেতিমগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমার জালালপুর, বটেশ্বরসহ বেশকিছু সড়কে একযোগে চলাচল করতো। তবে লোকসান আর রোড কমে যাওয়ায় ২০১৮ সালের শেষ দিকে বন্ধ হয়ে যায়।

Advertisement

অথচ উন্নত যাত্রীসেবার আশ্বাস দিয়ে নগরের ব্যস্ত সড়কগুলোতে নামানো হয়েছিল ‘নগর এক্সপ্রেস’। বলা হয়েছিল, নগর এক্সপ্রেসে থাকবে ওয়াই-ফাই সেবা। নারীদের জন্য থাকবে আলাদা বাস। নারীদের বাসে চালক এবং চালকের সহকারী দুজনই হবেন নারী। নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি বাসে থাকবে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা।

আরও পড়ুন: আরডিএর ফাইলবন্দি সিটি সার্ভিস

শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে তিনটি স্কুল বাস; থাকবে ই-টিকেটিংয়ের ব্যবস্থা। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। অন্য সাধারণ বাসের মতোই চলছে ‘নগর এক্সপ্রেস’। তবে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এসবের কোনোটিই বাস্তবে দেখা মেলেনি।

রোববার (২৭ আগস্ট) দুপুরে নগরের বন্দরবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে যাত্রী তুলছে নগর এক্সপ্রেসের বাস। একটি বাসের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ সিটই ভাঙাচোরা ও নোংরা।

Advertisement

এ বাসে থাকা আহমদ হোসেন নামের এক যাত্রী বলেন, ‘বাস কখন আসে কখন যায় এসবের ঠিক নেই। যেকোনো জায়গায় থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। ফলে গন্তব্যে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে। সিটগুলোর অবস্থাও খুব বাজে।’

বাসচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাসের সিট ভাঙাচোরা, ফ্যান চলে না। এগুলো নিয়ে যাত্রীরা প্রতিদিনই ঝামেলা করে। আমরাও কর্তৃপক্ষকে জানাই। কিন্তু তারা মেরামত করে না দিলে আমাদের কিছু করার নেই।’

তিনি বলেন, ‘বাস সার্ভিস শুরুর পর প্রথমদিকে অনেক সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। এখন যাত্রী কমে গেছে। ফলে বাসমালিকরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।’

আরও পড়ুন: অটোরিকশায় আটকা টাউন সার্ভিস

হেতিমগঞ্জ যাওয়ার জন্য নগরের উপশহর থেকে নগর পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন তাহমিনা আক্তার নামের এক নারী। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বাসে নারীদের জন্য বরাদ্দ আসনেও পুরুষরা বসে থাকেন। নারীদের দেখেও তারা আসন ছাড়তে চান না। বাসগুলোর জন্য কোনো স্ট্যান্ড বা ছাউনিও নেই। ফলে সড়কের ওপরই যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ।’

সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আবদুল করিম কিম জাগো নিউজকে বলেন, গণপরিবহন না থাকা সিলেটের একটি বড় সমস্যা। সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে গণপরিবহন চালু করা খুবই ভালো উদ্যোগ ছিল। কিন্তু চালুর পর ব্যবস্থাপনা ও সেবার মানের দিকে তারা লক্ষ্য দেননি। চালুর সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোও পূরণ করেননি। একটি ভালো উদ্যোগ অবহেলার কারণে এখন বন্ধের পথে।

সার্বিক বিষয়ে সিটি বাস মালিক গ্রুপের পরিচালক খন্দকার কাউসার আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের মেয়র আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন বাস রাখার জন্য টার্মিনাল বা শেড তৈরি করে দেবেন। এছাড়া যেসব রোডে গাড়িগুলো থামবে সেসব জায়গায় যাত্রীছাউনি নির্মাণ ও বাস থামার জায়গা চিহিৃত করে দেওয়া হবে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। বাসগুলো খোলা আকাশের নিচে থাকতে থাকতে বৃষ্টিতে ভিজে আর রোধে পুড়ে অল্পদিনেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে আমাদের ইচ্ছা থাকলেও যাত্রীদের উন্নত সেবা দিতে পারছি না।’

তিনি বলেন, আমরা প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা লোকসান দিচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না। এরই মধ্যে নগর এক্সপ্রেস সার্ভিস আমরা রাখবো, না কি বন্ধ করে দেবো তা নিয়ে মালিকদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কারণ আমরা সব রোডে বাস চালাতে পারছি না অটোরিকশা ও লেগুনা শ্রমিকদের কারণে।

আরও পড়ুন: ঢাকার বাইরে প্রথম ফেনীতে চালু হচ্ছে মহিলা বাস সার্ভিস

সিটি বাস মালিক গ্রুপের আহ্বায়ক ও সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মখলিছুর রহমান কামরান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাস পরিচালনায় কিছু বিশৃঙ্খলা রয়েছে। পুলিশ, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও লেগুনা শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। এসব সমস্যার কারণে সব রোডে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমরা বাস চালাতে পারছি না।’

নগর এক্সপ্রেসের নাজুক অবস্থার বিষয়ে জানতে রোববার দুপুরে ও সন্ধ্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নগর এক্সপ্রেস পরিষেবা সিটি করপোরেশনের নয়। নগরবাসীকে ভোগান্তিবিহীন পরিবহনসেবা দিতে সিটি করপোরেশন একটি সিটি বাস মালিক গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয় করে এ সেবা চালু করেছে। মেয়র শুধু এটার প্রধান পৃষ্ঠপোষক।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাদের (বাসমালিক) বাস রাখার জন্য জায়গা করে দেওয়া জরুরি। তবে আমরা জায়গা পাচ্ছি না। এটা একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। বাস সার্ভিসটাও চালু রাখা দরকার। এখন তারা যে জায়গায় (সুরমা নদীর পাড়) বাসগুলো রাখেন সে জায়গায়ও সমস্যা হচ্ছে। এখানে সার্কিট হাউজ আছে। ভিআইপি রোড, এখানে বাস রাখাও সমস্যা।

এসআর/জেআইএম