জাতীয়

রাজনৈতিক নবায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়ছে

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের চেয়ারম্যান। প্রধান নির্বাহী, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ, ডেনিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, সুইডিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা, টেকসই উন্নয়ন কমিশন, অ্যাকশন এইড, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থার পরামর্শকও ছিলেন।

Advertisement

সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: আগের পর্বে রাজনৈতিক নবায়নের কথা উল্লেখ করেছেন। এই নবায়ন বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: দুই অর্থে আমি নবায়ন বোঝাতে চাইছি। রাজনীতি যে সংস্কৃতি থেকে উন্নয়ন হচ্ছে, সেখানে জোরালো পরিবর্তন দরকার। দুর্নীতি, বাজার পরিস্থিতি সবকিছুর জন্যই এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি দায়ী বলে মনে করি।

Advertisement

আরও পড়ুন>> ‘হাসিনা সরকারের পতন ঘটলেও বিএনপি ক্ষমতায় আসবে না’ 

আরেকটি দিক হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা। ২০১৪ সালে সরকারদলীয় সংগঠন আওয়ামী লীগের ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। এটি একটি বিরল ঘটনা। এ ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে দিয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও একই অবস্থা। মানুষ সেই অর্থে ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচনে ভোটের যে জায়গা তা অনেকটাই অনুপস্থিত হয়ে গেছে। ভোটাধিকারের বিষয়টি নিরপেক্ষ ও নিশ্চিত করতে না পারলে সবকিছুতেই এক ধরনের অনিশ্চিয়তা থেকে যাবে।

 

সুর নানাভাবে ওঠে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সুর ওঠে। সুর ওঠে মানুষের আলোচনার মাধ্যমে। মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও এক ধরনের সুর ওঠে। আমি মনে করি এই সুর ওঠার ক্ষেত্রে প্রবলভাবে ঘাটতি আছে। সুর উঠলেই কার্যকর হবে।

 

মানুষ তো শুধু নির্বাচন দেখতে চায় না। মানুষ ভোট দিতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে নির্বাচন মানেই ক্ষমতায় যাওয়া। তারা ভুলে যায় ক্ষমতায় যাওয়া মানে একটি রাষ্ট্র, সমাজকে পরিচালনা করার জন্য চালকের আসনে বসা মাত্র। জনসাধারণের জীবনমান নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করা।

Advertisement

আরও পড়ুন>> জবাবদিহি থাকায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা 

২০২৩ সালের আগস্ট মাসে বসে আমাদের রাজনৈতিক নবায়ন নিয়ে ভাবতে হচ্ছে, যা আরও আগে ভাবার কথা ছিল। রাজনৈতিক নবায়নের দুটি দিক আছে। প্রথমটি হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, সেই পরিবেশ তৈরি।

জাগো নিউজ: বলা হয়, ২০০৮ সালে আপনারা বিশ্বাসযোগ্য একটি পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। টেকসই হলো না সেই বিশ্বাস। আবারও নবায়নের কথা বলছেন। এবার কারা আসতে পারে?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: কারা আসবে সেটা বলা তো অনেকটাই ভবিষ্যদ্বাণীর মতো। এমন বাণী করতে চাই না। বাংলাদেশ একটি স্বপ্ন নিয়ে জন্ম নিয়েছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা ছিল ন্যায় ও নৈতিকতার ভিত্তিতে আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করা। এজন্যই রাজনৈতিক নবায়ন অতি জরুরি। কারা ক্ষমতায় আসবে সেটা মুখ্য নয়।

জাগো নিউজ: এর জন্য জনচাপ সৃষ্টি করা দরকার। কোনো আওয়াজ বা সুর শুনতে পান?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সুর নানাভাবে ওঠে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সুর ওঠে। সুর ওঠে মানুষের আলোচনার মাধ্যমে। মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও এক ধরনের সুর ওঠে। আমি মনে করি এই সুর ওঠার ক্ষেত্রে প্রবলভাবে ঘাটতি আছে। সুর উঠলেই কার্যকর হবে।

গত এক দশকে ক্ষমতাসীন দল যে রাজনৈতিক উন্নয়ন মডেল দাঁড় করিয়েছে এবং এর ফলে যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে, তা থেকে নিজেরাও ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেন। ভিন্ন একটি আঙ্গিকে নিজেদের উপস্থাপিত করতে পারেন, তাহলে জনগণের সামনে ভালোভাবে যেতে পারে।

জাগো নিউজ: সেই সুযোগ আছে সরকারি দলের সামনে?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এখনো রঙিন চশমার আলোকে সার্বিক বিষয় দেখে আসছে। তারা কোনো সমস্যা দেখতে পান না। সব কিছুই ঠিক আছে। বরং আরও ভালো হচ্ছে।

জাগো নিউজ: রঙিন চশমা খুললে কী দেখতে পাবে?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: চশমা খোলার সৎসাহস আছে কি না সেটা আগে দেখতে হবে। চশমা খুলে ভিন্নতর বাস্তবতা দেখে নিজেদেরও পরিবর্তন করতে পারবে। অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারি দলের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এটি বোঝার জন্যও সৎসাহস থাকতে হবে।

 

আমাদের আরও বহুদূরে যেতে হবে। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনশক্তি নিয়ে ভাবতে হবে। কোনো মতে ভাত আর নুন দিয়ে খেয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে মানুষ নেই। মানুষের চাহিদা বেড়েছে। জীবনমান নিয়ে ভাবতে চায়। আমি আবারও বলছি, রাজনৈতিক নবায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়ছে।

 

জাগো নিউজ: রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য রাজপথেই আহ্বান করছে দলগুলো। কী ঘটবে সামনে?

আরও পড়ুন>> ‘গোষ্ঠীস্বার্থের ভূত চেপে বসার কারণেই বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না’ 

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: আমরা এক ধরনের ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সক্ষমতা অর্জন করেছি। এটি তো অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের আরও বহুদূরে যেতে হবে। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনশক্তি নিয়ে ভাবতে হবে। কোনো মতে ভাত আর নুন দিয়ে খেয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে মানুষ নেই। মানুষের চাহিদা বেড়েছে। জীবনমান নিয়ে ভাবতে চায়। আমি আবারও বলছি, রাজনৈতিক নবায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়ছে।

জাগো নিউজ: যদি নবায়ন না ঘটে?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: এই নবায়নের কথা শুধু আমি উপলব্ধি করছি না। সিংহভাগ মানুষ আমার মতো উপলব্ধি করছে বলে বিশ্বাস করি। জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং যে রাজনৈতিক উন্নয়ন মডেল দাঁড় করিয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে সবাই এই নবায়ন জরুরি মনে করছেন। মানুষের চাহিদার কথা ভাবলে চলমান সংস্কৃতি ভাঙতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

ক্ষমতাসীন দলেরও রাজনৈতিক ইতিহাস আছে, ঐতিহ্য আছে। তাদেরও মানুষের চাহিদার প্রতি সম্মান, উপলব্ধি করার সময় এসেছে। নিজেদেরও চেনার সুযোগ এসেছে।

সম্প্রতি রাজনৈতিক মাঠে প্রতিযোগীও চলে আসছে। একপেশে আর নেই। রাজনীতির জন্য এক ধরনের ধাক্কা তো এসেছে। এখন সবার বুঝতে পারার ব্যাপার।

এএসএস/এএসএ/জিকেএস