প্রায় ৮০ কোটি টাকার বিমা দাবি বকেয়া পড়েছে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সে। গ্রাহকের এই দাবি পরিশোধে উদ্যোগ নিয়েছেন হোমল্যান্ড লাইফের সিইও ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল। এখন তাকেই অপসারণ করতে চায় বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে মনগড়া অভিযোগ তুলে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডলকে অপসারণ করার উদ্যোগ নিয়েছে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
Advertisement
জানা গেছে, হোমল্যান্ড লাইফের ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অনিষ্পন্ন বিমা দাবি, ব্যবস্থাপনা ব্যয়, কমিশন প্রদান, বিমা সংক্রান্ত সব লেনদেন, কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা যাচাই করতে বিশেষ নিরীক্ষার জন্য গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুসেইন ফরহাদ অ্যান্ড কোং-কে নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। এরপর ১৪ নভেম্বর বিমা আইন ২০১০ এর ২৯ (২) ধারার ক্ষমতাবলে নিরীক্ষা দলকে সব তথ্য অভিগম্যতাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হোমল্যান্ড লাইফকে নির্দেশ দেয় আইডিআরএ।
তবে আইডিআরএ অভিযোগ তুলেছে, হুসাইন ফরহাদ অ্যান্ড কোং চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি আইডিআরএকে চিঠি দিয়ে জানায়, বিশেষ নিরীক্ষা কর্যক্রম পরিচালনার জন্য হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছে বার বার তাগাদা দেওয়া হলেও অধিযাচিত তথ্য, রেকর্ডপত্র, প্রমাণক না পাওয়ায় তাদের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না।
একই সঙ্গে আইডিআরএ অভিযোগ তুলেছে, চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশেষ নিরীক্ষার এক্সিট সভায় কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন এবং ওই সভায় গুরুত্বপূর্ণ নিরীক্ষা পর্ববেক্ষণের বিষয়ে তথ্য প্রদান না করায় তা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এছাড়া নিরীক্ষা কাজে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ অসহযোগিতা এবং প্রয়োজনীয় লেনদেন, বিল-ভাউচার, দলিলাদি কোম্পানি থেকে সরবরাহ না করায় নিরীক্ষা কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন রতে পারেনি অডিট ফার্ম।
Advertisement
আইডিআরএ আরও অভিযোগ তুলেছে, চলতি মাসের ১০ তারিখ বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, হোমল্যান্ড লাইফ এবং নিরীক্ষা ফার্ম হুসেইন ফরহাদ অ্যান্ড কোং-এর মধ্যে ত্রিপক্ষীয় শুনানি হয়। শুনানিতে হোমল্যান্ড লাইফের বিরুদ্ধে কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে অনিয়ম, লাইসেন্সবিহীন এজেন্টকে কমিশন দেওয়া, অনিষ্পন্ন বিমা দাবি অর্থ ও বিমা দাবির সংখ্যায় গড়মিল, হিসাববিহীন নবায়ন প্রিমিয়াম আয়, ব্যবসায় সমাপনী তথ্য ও প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের তথ্য প্রদান না করা, প্রশাসনিক ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়ে অনিয়ম এবং ভাউচার ও নথি প্রদানে অসহযোগিতার বিষয় প্রমাণিত হয়।
এসব অভিযোগ তুলে গত ১৪ আগস্ট আইডিআরএ থেকে হোমল্যান্ড লাইফের সিইওকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল হোমল্যান্ড লাইফের সিইও পদে থাকায় বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন বিঘ্নিত হয়েছে। এ কারণে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল বিমা আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং নিরীক্ষা কাজে তার অসহযোগিতা বিমা গ্রহীতা ও বিমাকারীর স্বার্থের পরিপন্থি কার্যক্রম হিসেবে কর্তৃপক্ষের নিকট গণ্য হয়েছে।
আরও পড়ুন: তহবিল সংকট, বিপাকে হোমল্যান্ড লাইফের বিমা গ্রাহকরা
এজন্য বিমা আইন ২০১০ এর ৫০ ধারার ১(খ) উপধারায় দেওয়া ক্ষমতাবলে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডলকে কেন হোমল্যান্ড লাইফের সিইও পদ থেকে অপসারণ করা হবে না তিন দিনের মধ্যে তার ব্যাখা চাওয়া হয় চিঠিতে। সেই সঙ্গে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডলকে হোমল্যান্ড লাইফের সিইও’র দায়িত্ব পালনে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।
Advertisement
এর আগে চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি আইডিআরএ থেকে হোমল্যান্ড লাইফের সিইওকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে বিমা আইন ২০১০ এর ১৩৪ ধারা অনুযায়ী কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার কারণ জানতে চেয়ে নিরীক্ষা কর্যক্রম সম্পন্ন করে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। কিন্তু কোম্পানি নিরীক্ষা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নথি সময় মতো সরবরাহ না করায় নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বিলম্ব হচ্ছে বলে নিরীক্ষা ফার্ম জানিয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি ড. বিশ্বজিৎ চিঠি দিয়ে আডিআরএ চেয়ারম্যানকে জানান, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিন বছরের বিশেষ নিরীক্ষার জন্য ২০২২ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর নিরীক্ষা ফার্ম নিয়োগ দেওয়া হয়। তিন বছরের নিরীক্ষা কাজ হাতে নিয়ে এক মাস পরে ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর নিরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। নিরীক্ষা ফার্মের পাঁচজন আর্টিকেল্ড স্টুডেন্ট কাজ করার কথা থাকলেও কোনো দিন তাদের পাঁচজন ছাত্র একত্রে কাজ করেননি। নিয়মিতভাবে সর্বোচ্চ তিনজন কাজ করেছেন।
এতে বলা হয়েছে, আর্টিকেল্ড স্টুডেন্টরা মূল কাজ শুরু করেন ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে। ১০ নভেম্বর থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত তারা পরীক্ষার জন্য ছুটিতে ছিলেন এবং কেউ কাজে আসেননি। এসব প্রতিকূলতাই নিরীক্ষা কাজ সম্পন্ন করতে দেরি হওয়ার মূল কারণ।
এতে আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তারা মোট ৫১টি আইটেমের চাহিদা দিয়েছেন। আমরা ২০২৩ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের চাহিদার শতভাগ কাগজপত্র জোগান দিয়েছি। পরবর্তীসময়ে চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩০টি আইটেমের চাহিদা পাই এবং ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিরীক্ষকদের সরবরাহ করা হয়। সর্বশেষ ২৪ ফেব্রুয়ারি তারা কাজ শেষ করে চলে যান।
আরও পড়ুন: হোমল্যান্ড লাইফে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ খোদ পরিচালকদের
বিশ্বজিৎ চিঠিতে বলেছেন, নিরীক্ষকরা নিয়োগ পাওয়ার এক মাস পরে কাজে যোগ দেওয়া, পাঁচজন স্টুডেন্টের পরিবর্তে তিনজন নিয়মিতভাবে কাজ করা, এরমধ্যে আবার ১৫-১৬ দিন কাজ বন্ধ রাখার পরও আমাদের কাগজপত্র সরবরাহ করতে বিলম্বের কারণে কাজ ব্যাহত হওয়াকে একমাত্র কারণ উল্লেখ করে আমাদের ওপর একতরফা দোষ চাপিয়ে তাদের দায়-দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পাওয়ার অজুহাত খোঁজার বিষয়টি অত্যান্ত দুঃখজনক। এ বিষয়ে আমরা মর্মাহত।
শুধু কাগজপত্র সরবরাহের কারণেই যে নিরীক্ষা কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে, তা একতরফাভাবে বলা ঠিক হবে না। যাইহোক কাগজপত্র সরবরাহের জন্য আমাদের তরফ থেকে খুব কম সময় দেরি করা হলেও আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। এমন তথ্য উল্লেখ করে চিঠিতে নিরীক্ষা কাজে অসহযোগিতার যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।
আরও পড়ুন: সুষ্ঠু তদন্তের জ্ঞান নেই তদন্ত কমিটির!
এরপর গত ১৫ মে আইডিআরএ থেকে আবারও হোমল্যান্ডের সিইওকে চিঠি দিয়ে নিরীক্ষা কাজে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠুভাবে নিরীক্ষা কর্যক্রম পরিচালনায় অসহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়। সেই সঙ্গে বিমা আইন ২০১০ এর ২৯ ধারার ক্ষমতাবলে কাজে অসহযোগিতার জন্য কোম্পানির সিইও এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিমা আইন ২০১০ এর ১৩৪ ধারা অনুযায়ী কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার জবাব চাওয়া হয়।
আইডিআরএ’র এই চিঠির জবাব ২৫ মে দেন বিশ্বজিৎ। এ সংক্রান্ত চিঠিতেও নিরীক্ষকদের চাহিদা মতো বিভিন্ন ভাউচার, দলিলাদি সরবরাহ করা হয়েছে উল্লেখ করা হয়। নিরীক্ষকদের কীভাবে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, তার বিস্তারিতও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
এরপর গত ৭ জুন বিশ্বজিৎ আইডিআরএ চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধের জন্য পর্ষদকে তহবিল বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কোম্পানির তহবিলে কোনো অর্থ না থাকায় এবং পরিচালনা পর্ষদ তহবিল ভেঙে বিমা দাবি পরিশোধ আগ্রহী না হওয়ায় এই নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
আরও পড়ুন: গ্রাহকের ১০৪ কোটি টাকা লোপাটে তদন্ত-ব্যবস্থার নির্দেশনা চেয়ে রিট
বিশ্বজিৎ বিমা গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধের লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এমন চিঠি দেওয়ার পরই তাকে কেন বিমা আইন ২০১০ এর ৫০ ধারার ১(খ) উপ-ধারায় দেওয়া ক্ষমতাবলে হোমল্যান্ড লাইফের সিইও পদ থেকে অপসারণ করা হবে না তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শনানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
১৪ আগস্ট আইডিআরএ থেকে দেওয়া এ কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব ২১ আগস্ট দেন বিশ্বজিৎ। এ সংক্রান্ত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিমা আইন ২০১০ এর ১৩৪ ধারার কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এবং ২৫ মে আমরা অবহিত করেছি, যা আপনার পাঠানো কারণ দর্শানোর নোটিশে উল্লেখিত হয়নি।
চিঠিতে বলা হয়েছে, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তথ্য দেওয়ার জন্য কোম্পানির দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তা আশিষ মালাকার গত ২ জুলাই চাকরি ছেড়ে চলে যান। ব্যক্তিগত কারণে তাৎক্ষণিকভাবে তার পক্ষে সব কাগজপত্র কোম্পানিকে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপরও শুনানি সভায় সব কাগজপত্রসহ উপস্থিত হওয়ার জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকার বাইরে থাকায় আমরা শুনানির দিন সব কাগজপত্রসহ উপস্থিত হতে পারিনি। ১০ আগস্ট শুনানির দিন পরিচিতি পর্বের সময় আমি বিষয়টি মৌখিকভাবে আপনাদের অবহিত করেছিলাম। শুনানির পরবর্তীসময়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সব তথ্য (ই-মেইলসহ) সংগ্রহ করা হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হোমল্যান্ড লাইফকে বার বার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও অধিযাচিত তথ্য, রেকর্ডপত্র, প্রমাণক না পাওয়ায় তাদের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না মর্মে নিরীক্ষকরা যে অভিযোগ করেছেন তা সঠিক নয়। আসলে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তথ্য সরবরাহ না করার বিষয়টি আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ হাসিল বা অসৎ উদ্দেশ্যে নয়। গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণই আমার মূল উদ্দেশ্য। আমি আগেও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি এবং কখনোই গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করার কোনো অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়নি।
কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে অনিয়ম নিয়ে তোলা অভিযোগের বিষয়ে বিশ্বজিৎ জানিয়েছেন, নিরীক্ষা কার্যকাল ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল। আমাদের প্রধান কার্যালয়ে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় কাগজপত্র শ্যামলী ও দৈনিক বাংলায় কোম্পানির স্টোর রুমে রাখা হয়। তৎকালীন যারা স্টোরের দায়িত্বে ছিলেন তারাও অনেকেই এখন কোম্পানিতে নেই। তাই নিরীক্ষকদের ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর, ২৫ অক্টোবর, ২৭ নভেম্বর ও ৫ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কাগজপত্র স্টোর থেকে খুঁজে বের করে মেইলে সরবরাহ করা হয়। চিঠিতে ই-মেইল ঠিকানা এবং কোন তারিখে কোন তথ্য দেওয়া হয়েছে তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
এক্সিট সভা নিয়ে তোলা অভিযোগের বিষয়ে বিশ্বজিৎ জানিয়েছেন, এক্সিট সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। সভায় বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রমের পরিকল্পনা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কথা হয়। কীভাবে নিরীক্ষকরা কাজ করেছেন তা নিয়েই কথা হয়েছে। তবে তথ্য সরবরাহ না করার কারণে নিরীক্ষা কার্যক্রম অমীমাংসিত রয়ে গেছে এমন কোনো বিষয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়নি। ওই সময়ে কি কি বিষয়ে অমীমাংসিত রয়ে গেছে তা আমাদের জানানো হয়নি। এক্সিট মিটিংয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনার বিষয়বস্তু আপনাদের কাছে নিরীক্ষকরা দাখিল করে ২৭ জুলাই, যা মিটিং শেষ হওয়ার পাঁচ মাস পর। কোনো বিষয় অমীমাংসিত থাকলে ওই বিষয়টি আমাদের কোনো পত্র দিয়ে জানানো প্রয়োজন ছিল। তাহলে আমরা তাৎক্ষণিক বিষয়টি নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা করতে পারতাম।
অনিষ্পন্ন বিমা দাবির অর্থ ও বিমা দাবির সংখ্যার গড়মিল নিয়ে করা অভিযোগের বিষয়ে বিশ্বজিৎ বলেছেন, অনিষ্পন্ন দাবির মধ্যে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকার যে পার্থক্যের কথা বলা হয়েছে, তা আমার দায়িত্ব পালনের সময়ে নয়। বিশেষ নিরীক্ষক তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, বিমা দাবি অনিষ্পন্ন রয়েছে ১২ কোটি ৬ লাখ টাকা, যার মধ্যে ২ কোটি ৭ লাখ টাকার প্রভিশন করা হয়েছে। নিয়ম অনুসারে ৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকার প্রভিশন করা হয়নি। এটি ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের ভুল। সে কারণে বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে আমি বলেছি কোম্পানি অনিষ্পন্ন বিমা দাবি হিসাব ভুক্তকরণে সে সময় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ভুল করেছে। কিন্তু পরবর্তীসময়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাওয়া সাপেক্ষে বিমা দাবির অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: কারামুক্ত ৭ পরিচালকের বিরুদ্ধে জোর করে বোর্ডসভা করার অভিযোগ
এ বিষয়ে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে কোম্পানির অনিষ্পন্ন বিমা দাবির পরিমাণ ৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা কর্তৃপক্ষের চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন সময়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে। যে কারণে অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ বর্তমানে বেশি বলে আমি উল্লেখ করেছি। তাই বিমা দাবির বিষয়ে সঠিক তথ্য আমি দেইনি বলে ৫০(১) (খ) ধারায় যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সঠিক নয়।
অনিষ্পন্ন দাবির বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করা হয়নি বলে বিশ্বজিৎ’র বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা থেকে অব্যাহতি দেওয়ারও অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।
যোগাযোগ করা হলে একাধিক বিমা কোম্পানির সিইও বলেন, প্রথমে দু-দফায় হোমল্যান্ড লাইফের সিইওকে বিমা আইনের ১৩৪ ধারা অনুযায়ী কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে শোকজ করা হয়। যাকে শোকজ করা হয় তিনি তার উত্তরও দিয়েছেন। কিন্তু তার উত্তর গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না? তার সমাধান না করেই হঠাৎ ৫০ ধারার ১(খ) উপ-ধারা অনুযায়ী তাকে অপসারণ করার বিষয়ে শোকজ করা যুক্তিসংগত হয়নি।
তারা বলেন, বিশেষ নিরীক্ষার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। সে সময় বিশ্বজিৎ হোমল্যান্ড লাইফে ছিলেন না। সুতরাং সেই সময়ের অনিয়মের জন্য তিনি দায়ী নন। তাহলে ওই সময়ের তথ্য দিতে তার আপত্তি থাকার কথা নয়। এখানে মনে হচ্ছে অন্য কোনো কারণ আছে। বিশ্বজিৎ’র বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে মনগড়া অভিযোগ তোলা হচ্ছে কি না বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।
তারা আরও বলেন, এর আগেও আইডিআরএ শীর্ষ কর্মকর্তারা নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন। একজন তো ঘুস দাবির অভিযোগ মাথায় নিয়েই আইডিআরএ চেয়ারম্যানের পদ ছেড়েছেন। আবার বর্তমানে দায়িত্বে থাকা লাইফ মেম্বারের বিরুদ্ধে একটি কোম্পানির কর্মকর্তা ঘুস চাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিরুদ্ধে বারবার এ ধরনের অভিযোগ ওঠা ভালো লক্ষণ নয়। এটি সার্বিক বিমা খাতের জন্য ক্ষতিকর। এমনিতেই বিমা খাতের ওপর মানুষের আস্থার সংকট রয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্বজিৎ’র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, নিরীক্ষক এবং আইডিআরএ যখন যে তথ্য চেয়েছে আমরা তা সরবরাহ করেছি। আমি কোম্পানির এফডিআর ভেঙে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধের ব্যবস্থা করার জন্য আইডিআরএকে অনুরোধ জানিয়েছি। এখন আমার বিরুদ্ধে বিমা গ্রাহক ও বিমাকারীর স্বার্থের পরিপন্থি কাজ করার অভিযোগ তোলা খুবই দুঃখজনক। আইডিআরএ কেন এমনটি করছে আমি বলতে পারবো না।
বিশ্বজিৎকে অপসারণ করা সংক্রান্ত কারণ দর্শানো চিঠিতে সই করেছেন আইডিআরএ’র পরিচালক (লাইফ) এস এম মাসুদুল হক। এই কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, হোমল্যান্ড লাইফ নিয়ে শুনানি হয়েছে। শুনানিতে বিশ্বজিৎ গ্রহণযোগ্য জবাব দিতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য তাকে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে।
উনি (বিশ্বজিৎ) বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী সব তথ্য দেওয়া হয়েছে। মেইলে পাঠানো তথ্যের প্রমাণও দিয়েছেন। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হলে আইডিআএ’র এই কর্মকর্তা বলেন, তার বলায় তো কিছু আসে যায় না। এটা আইডিআরএ’র কর্তৃপক্ষের ব্যাপার।
প্রথমে ১৩৪ ধারা অনুযায়ী কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেন, সেটার সমাধান না করে কেন হঠাৎ ৫০ ধারার ১(খ) উপ-ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেন? তাছাড়া নিরীক্ষা যে সময়ের জন্য করা হচ্ছে, সে সময়ে তিনি কোম্পানিতে ছিলেন না। তাহলে তাকে কেন অপসারণ করতে চাচ্ছেন, এমন প্রশ্ন করা হলে এস এম মাসুদুল হক বলেন, এ বিষয়ে আমি কথা বলতে চাচ্ছি না। আপনাকে তো আমি কৈফিয়ত দেবো না। এই বলে তিনি মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এমএএস/এমএইচআর/জিকেএস