মতামত

কাদের ভয় দেখালেন ওবায়দুল কাদের?

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন একদম পয়েন্ট অব নো রিটার্নে দাঁড়িয়ে আছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলই নিজ নিজ দাবিতে অনড়। বিএনপি আন্দোলন করছে, সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। আর আওয়ামী লীগের এক দফা হলো বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোয় বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন। আওয়ামী লীগ-বিএনপির এই দুই মেরুতে অবস্থান নতুন কিছু নয়।

Advertisement

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো। সেই তুলনায় বিএনপি নবীন। বয়সে ২৯ বছরের ছোট হলেও বিএনপিই এখন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ। কাগজে-কলমে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম হলেও বিএনপি আদর্শিক জন্ম আসলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ৭ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুনিরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি। শিশুপুত্রসহ তার পরিবারের সব সদস্য, এমনকি আত্মীয়দেরও হত্যা করা হয়।

এ হত্যাকাণ্ড শুধু ক্ষমতাবদলের জন্য নয়। এ হত্যাকাণ্ড ছিল বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা। ৩ নভেম্বর কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা ছিল সেই চেষ্টারই অংশ। সেই চেষ্টায় সামনে এগিয়ে আসেন সুযোগসন্ধানী জিয়াউর রহমান। ক্যু-পাল্টা ক্যু’র ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর সামনে আসেন তিনি। ১৫ আগস্টের মূল সুবিধাভোগী আসলে জিয়াউর রহমানই।

এখনকার বিএনপি সমর্থকরা দাবি করেন, ১৫ আগস্টের ঘটনায় জিয়াউর রহমানের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করে, খুনিদের বিচার বন্ধ করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় নিজের কাঁধে টেনে নেন।

Advertisement

মানলাম ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর উপপ্রধানের কিছু করার ছিল না। কিন্তু জিয়াউর রহমান যদি সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতেন, তাহলে আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। তা না করে জিয়াউর রহমান খুনিদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে মাঠে নামেন।

বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টার নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। বিএনপি রাজনীতিতে আবির্ভূত হয় আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার মিশন নিয়ে। তারপরও স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ৮ দল ও ৭ দলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাশাপাশি মাঠে ছিল। তখন শত বিভেদ সত্ত্বেও দুই দলের মধ্যে একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু অভিন্ন শত্রু এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগ-বিএনপি রাজনীতির মাঠে আবার মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়।

বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে আন্দোলনে নামে আওয়ামী লীগ। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামে বিএনপি। তবে সেই বিরোধিতাও সীমাবদ্ধ ছিল রাজনীতির মাঠেই। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেই সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে দেয়। তবে দুই দলের সম্পর্কটা রাজনীতির বাইরে চলে যায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট।

গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার চেষ্টা আবার দুই দলকে দুই মেরুতে দাঁড় করিয়ে দেয়। তদন্তে যখন বেরিয়ে আসে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান, তখন আর দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক, পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাসের কোনো সুযোগই আর রইলো না।

Advertisement

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগও বিএনপিকে দমন করার কৌশল নিয়ে মাঠে নামে। তবে বিএনপি যেভাবে গ্রেনেড মেরে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, আওয়ামী লীগ ততটা নয়। আওয়ামী লীগ বরং বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার কৌশল নেয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতকে রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা করে ফেলে। মামলা-হামলা, গুম-খুনে নাস্তানাবুদ করে বিএনপিকেও।

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এক রাতেই আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে, নিজেদের এত দুর্বল কেন মনে করছেন ওবায়দুল কাদের। তৃণমূলে যাদের সংগঠনের বিস্তৃতি, এক রাতেই যদি বিএনপি তাদের শেষ করে দিতে পারে; তাহলে আওয়ামী লীগ এতদিন কী করলো?

১৪ বছর ধরেই সরকারের দমন-পীড়ন মোকাবিলা করেই মাঠে টিকে আছে বিএনপি। তবে যত দমন-পীড়নই হোক, তারেক রহমান ছাড়া বিএনপির আর কোনো শীর্ষ নেতাকে দেশ ছাড়তে হয়নি। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান ছাড়া বিএনপি-জামায়াত সরকারের মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য বা বিএনপির কোনো কেন্দ্রীয় নেতা কারাগারে নেই। সরকার নানাভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বটে, তারপরও বিএনপি রাজপথে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সে আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণও বাড়ছে।

তবে সরকার পতন হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে; গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ যা করেছে, তার পাল্টাটা করার চেষ্টা করবে; এই শঙ্কা অমূলক নয়। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এক দফার আন্দোলনে বিএনপি এখন অনেক চাঙা। দেশি-বিদেশি নানা চাপের কারণে সরকারও আগের মতো চড়াও হতে পারছে না। ফলে তাদের নেতাকর্মীরা এখন অনেক উজ্জীবিত।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা অনেক সক্রিয়। তাদের কথাবার্তাও এখন অনেক আক্রমণাত্মক। ভিন্নমতের মানুষদের তারা হুমকি দিচ্ছে, আর মাত্র কটা দিন। তারপরই তারা দেখে নেবে। তবে বিএনপির সিনিয়র নেতারা বারবার বলছেন, ক্ষমতায় গেলে তারা কোনো প্রতিশোধ নেবেন না। তবে তাদের এ আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারছে না আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বিএনপির মুখে মধু, অন্তরে বিষ। তারা বলে, ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের লোকজনের কোনো ক্ষতি হবে না। কী সুন্দর কথা! আওয়ামী লীগকে তারা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। তারা আবার ক্ষমতায় আসলে এক রাতের মধ্যে বাকিটা শেষ করে দেবে। এটা তাদের ভেতরের কথা।’

ওবায়দুল কাদেরের এ আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বিএনপির রাজনীতির যে নিষ্ঠুর অতীত, আর গত ১৪ বছরে তারা যে নির্যাতনের শিকার হয়েছে; ক্ষমতায় গেলে তারা ভালো হয়ে যাবে, কোনো প্রতিশোধ নেবে না; এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

তবে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এক রাতেই আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে, নিজেদের এত দুর্বল কেন মনে করছেন ওবায়দুল কাদের। তৃণমূলে যাদের সংগঠনের বিস্তৃতি, এক রাতেই যদি বিএনপি তাদের শেষ করে দিতে পারে; তাহলে আওয়ামী লীগ এতদিন কী করলো? এখন যে দেশের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ, একরাতেই কি তারা হাওয়া হয়ে যাবে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও যে দেশে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা যায়নি, সেই আওয়াম লীগকে কি এক রাতেই শেষ করে দেওয়া সম্ভব? প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগকে বারবার ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে।

বারবার ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। ’৭৫এর পর ২১ বছর লেগেছে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরতে। কিন্তু তৃণমূলে ভর করে আওয়ামী লীগ মাটি কামড়ে পড়েছিল। আজ সেই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আত্মবিশ্বাস এত কম কেন? তিনি আসলে এ কথায় কাদের ভয় দেখালেন?

আসলে রাজনীতিকে যদি রাজনীতির মাঠে রাখা না যায়, এই শঙ্কা থাকবেই। গণতন্ত্রে এক দল ক্ষমতায় থাকবে, আরেক দল ক্ষমতার বাইরে থাকবে; আবার বাইরে থাকা দল ক্ষমতায় যাবে, ক্ষমতায় থাকা দল বিরোধী দলে যাবে। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা দল যদি বাইরে থাকা দলকে শেষ করে দিতে চায়; তাহলে একসময় রাজনীতি, গণতন্ত্র সব শেষ হয়ে যাবে।

তাই রাজনীতির স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থেই আমাদের প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনীতিতে মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে, আদর্শিক লড়াই থাকবে। একদল আরেক দলকে আদর্শিক লড়াইয়ে শেষ করতে চাইবে। কিন্তু বুলেট বা গ্রেনেড দিয়ে শেষ করতে চাইলে একসময় শুধু লাশ থাকবে, হাড় থাকবে, রাজনীতি থাকবে না। রাজনীতিও খেলার মতো। প্রতিপক্ষকে হারাবো, তবে খেলার নিয়ম মেনে, ফাউল করে নয়। ২৭ আগস্ট, ২০২৩

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম