শিশু নির্যাতনও এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধির শুরু আমাদের পরিবার থেকেই। নিজের পরিবারেই একটি শিশু সবচেয়ে বেশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েও তাদের বিভিন্ন শাস্তির পাশাপাশি অনেক সময় বুলিংয়ের শিকার হতে হয়। পরিপত্র জারি করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর থামছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতন। আর শিশুশ্রমে যারা নিযুক্ত কিংবা যারা পথশিশু তাদের কাছে নির্যাতন, লাঞ্ছনা, যৌন নিপীড়ন নিত্য ঘটনা। এমনকি সময়ের প্রয়োজনে ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করেও হয়রানির শিকার হচ্ছে শিশুরা। নির্যাতনের কারণে শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে।
Advertisement
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনোভাবেই শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানি করা ঠিক নয়। এতে তাদের সুষ্ঠু বিকাশে ব্যাঘাত ঘটবে। শিশুদের অবহেলা করা যাবে না। তাদের অবহেলা করাও এক ধরনের নির্যাতনের প্রক্রিয়া। শিশুদের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দিতে হবে। বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। শিশুদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে।
বিভিন্ন জরিপে শিশু নির্যাতনের চিত্রমানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) শিশু পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২২ এর তথ্য অনুসারে, এক বছরে ১২টি ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। সেগুলো হলো যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, সড়ক দুর্ঘটনা, অন্য দুর্ঘটনা, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, আত্মহত্যা, অপরাধে সংশ্লিষ্ট শিশু, নিখোঁজ ও পানিতে ডুবে মৃত্যু। এসব ক্ষেত্রে ২০২১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৪২৬ জন। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৯৪, অর্থাৎ এক বছরে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর হার বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইউনিসেফের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচ কোটি ৭০ লাখের কাছাকাছি শিশু রয়েছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। এর মধ্যে ১৪ বছরের নিচে প্রায় সাড়ে চার কোটি শিশু বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে ৯ জন বা ৯০ শতাংশ শিশু নির্যাতিত এবং সপ্তাহে মারা যাচ্ছে ২০ জন শিশু।
Advertisement
আরও পড়ুন>> শিশু নির্যাতন বন্ধে জারিকৃত পরিপত্র স্কুলে টাঙিয়ে রাখার নির্দেশ
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সারাদেশে পাশবিক নির্যাতন ও নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে ১৩ হাজার ১২ শিশু। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে এক হাজার ৫২৬ জন। নিপীড়নের শিকার এক হাজার ৪৭৫ শিশু। ২০১৭ সালে শিশুহত্যা ৩৩৯ জন। ২০১৮ সালে সে সংখ্যা ছিল ৪১৮। ২০১৯ সালে ৪৪৮ শিশুকে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিল ৭৭৬ শিশু। ২০২১ সালে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয় ৯০১ শিশু।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) ‘শিশু অধিকার পরিস্থিতি-২০১৯’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে শিশুধর্ষণ ও শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে শিশুধর্ষণ বেড়েছে ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ। যৌন নির্যাতন বেড়েছে ৭০ দশমিক ৩২ শতাংশ। হত্যা বেড়েছে ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। বিগত বছরে ৪ হাজার ৩৮১ শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ২ হাজার ৮৮ শিশুর অপমৃত্যু ও খুন হয়েছে ৪৪৮ শিশু। এক হাজার ৩৮৩ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যা বিগত বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
শ্রমের সঙ্গে নিযুক্ত সব শিশুই নির্যাতনের শিকারপুরান ঢাকার একটি হোটেলে কাজ করে শিশু শাহিন শেখ (ছদ্মনাম)। বেতন দিনে একশ টাকা। সঙ্গে থাকা-খাওয়া ফ্রি। কাস্টমারদের পানি দেওয়ার সময় তার হাত থেকে পড়ে একটি গ্লাস ভেঙে যায়। গ্লাস ভাঙার শব্দ শুনে হোটেলের ম্যানেজার রহিম দৌড়ে তার কাছে আসেন। শাহিনের মুখে একটা চড় মেরে বলেন, দেখে কাজ করতে পারিস না। এরপর এমন হলে মেরে হাত-পা ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেবো।
Advertisement
ছবি: বিপ্লব দিক্ষীৎ
শাহিন শেখ বলে, অভাবের পরিবার আমাদের। বাবা অনেক আগে মারা গেছেন। মা ও দুই বোন আছে পরিবারে। তাদের মুখে দুই মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য হোটেলে কাজ করি। এখানে সামান্য ব্যতিক্রম হলে হোটেল ম্যানেজার মারধর করেন। মার খেয়েও পেটের দায়ে কাজ করতে হয়।
আরও পড়ুন>> শিশুর নিরাপত্তা খুব জরুরি
শাহিনের মতো শ্রমের সঙ্গে নিযুক্ত সব শিশুই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার। ২০২৩ সালের ২৫ জানুয়ারি এমন তথ্য প্রকাশ করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। এসময় গৃহশ্রমকে শিশুশ্রমের তালিকাভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন সংস্থার নেতারা। কারণ, গৃহশ্রমে নিযুক্ত বেশিরভাগই শিশু এবং তারা শতভাগ নির্যাতনের শিকার।
শান্তি ও নিয়মানুবর্তিতার অজুহাতে বাড়িতে চলে শিশু নির্যাতনঢাকা ন্যাশনাল হাসপাতালের গেটে ডান হাতে ব্যান্ডেজ করা সামিউল (৮) দাঁড়িয়ে কান্না করছিল তার মাকে ধরে। কান্নার কারণ জানতে চাইলে তার মা সালেহা বেগম বলেন, সকালে খুব দুষ্টামি করছিল সামিউল। শোকেস ও বাসার সব জিনিস এলোমেলো করছিল। বারবার নিষেধ করার পরও মানছিল না। তার বাবাও কয়েকবার নিষেধ করেন। নিষেধ না মানায় এক পর্যায়ে তার বাবা চুলায় থাকা গরম পানি তার দিকে ছুড়ে মারেন। এতে তার ডান হাতের চামড়া একটু পুড়ে যায়। হাসপাতালে এনে তার ব্যান্ডেজ করেছি। ব্যথায় সে কান্না করছে।
রাজধানীর ভাটারার বাসিন্দা ইশরাত জাহানকে (৬) তার মা এলিনা বেগম বাসায় পড়াচ্ছিলেন। দুইয়ের নামতা ইশরাতকে তার মা লিখতে বললেন। ইশরাত কিছুতেই নামতা লিখতে পারছিল না। এতে তার মা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হাঁটু গেঁড়ে কিছু সময় বসিয়ে রাখেন। ইশরাতের মা এলিনা বেগম বলেন, বাচ্চাদের শাস্তি না দিলে তারা পড়া মুখস্ত করতে চায় না। তাদের ভয়ের মধ্যে রাখলে পড়ায় মনোযোগী হয়। ছোট থাকতে পড়া না পারলে আমাকেও আমার বাবা-মা এমন শাস্তি দিতো। তাই আজ আমি এতদূর এসেছি।
বাংলাদেশে সামিউল-ইশরাতের মতো শতকরা ৯৫ দশমিক ৮ জন শিশু নানাভাবে ঘরেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় বাবা-মা ও অভিভাবকদের দ্বারা। আর এসব নিপীড়ন চালানো হয় শান্তি ও নিয়মানুবর্তিতার অজুহাতে।
২০২২ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতি’ শীর্ষক জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। শিশুকে শারীরিকভাবে অত্যাচার করার মধ্যে পড়ে হাত, জুতা, বেল্ট, বোতল দিয়ে মারা, লাথি মারা, টানাহ্যাঁচড়া করা, চুল টানা, দাঁড় করিয়ে রাখা, হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা, শরীর পুড়িয়ে দেওয়া এবং ঝাঁকি দেওয়া, ছুড়ে ফেলা, চিমটি দেখানো।
ছবি: বিপ্লব দিক্ষীৎ
পারিবারিক অস্থিরতা ও দাম্পত্য কলহের বলি শিশুছয় বছরের শিশু সাখাওয়াতের চাচাতো বোন শারমিনের সঙ্গে দুই বছর আগে তাহারুল মিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে তারা গাজীপুর মহানগরের ভোগড়া পেয়ারা বাগান এলাকায় সাখাওয়াতের পরিবারের সঙ্গে একই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। বিয়ের পর থেকে শারমিন ও তাহারুলের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চলছিল। গত ১৩ মার্চ বিকেলে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়। এসময় সাখাওয়াতের মা তাহারুলকে শাসন ও বকাঝকা করেন। এতে তাহারুল ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। এসময় সাখাওয়াতকে বাড়ির সামনে পেয়ে তাকে সঙ্গে নেন তাহারুল। দোকান থেকে খাবার কিনে দেওয়ার কথা বলে কৌশলে মহানগরের ইসলামপুর এলাকার ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের পশ্চিমে সদ্য মাটি ভরাট করা একটি ফাঁকা জমিতে নিয়ে যান। পরে সেখানে সাখাওয়াতকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর লাশ মাটিচাপা দেন তাহারুল। রংপুরের পীরগঞ্জ থানার জামালপুর গ্রামের ইয়াসিন আলীর ছেলে তাহারুল পেশায় রাজমিন্ত্রি। এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়েরের পর তাহারুলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের কাছে তাহারুল হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেন।
গত ৭ জুলাই রহিমা খাতুন সিজারের মাধ্যমে পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। শিশুটির নাম রাখা হয় রিয়াদ। গত ১৫ জুলাই দাম্পত্য কলহের জেরে হানিফ উত্তেজিত হয়ে তার ৯ দিন বয়সের শিশুসন্তান রিয়াদের মুখমণ্ডলে একাধিক কামড় দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে। এতে শিশুটি মারা যায়। এ ঘটনায় মামলার পর হানিফকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
আরও পড়ুন>> জানুয়ারিতে নারী নির্যাতন ও শিশু অপহরণ বেড়েছে
শিশুর প্রতি সহিংসতার প্রধান কারণ পারিবারিক অস্থিরতা ও দাম্পত্য কলহ। শিশু সাখাওয়াত ও রিয়াদ অনেক শিশু দাম্পত্য কলহের বলি হচ্ছে। পারিবারিক কলহ, শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের পরিবেশ বিঘ্নিত করা, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া, সুস্থ বিনোদনের অভাব, পশ্চিমা সংস্কৃতির করাল থাবা ইত্যাদি কারণে শিশু হত্যা ও সহিংসতার হার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পারিবারিক কলহের একপর্যায়ে শিশুর প্রতি সহিংসতা এমনকি হত্যা অবধি পৌঁছায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতনরাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা এলাকার কাশেমিয়া হাফেজিয়া বায়তুল মামুর জামে মসজিদ ও এতিখানার ছাত্র ইয়াসিন (৯)। গত ৪ মে সকালে ইয়াসিনকে বাসায় রেখে তার মা জেসমিন বেগম কাজে যান। দুপুরে বাসায় এসে জেসমিন শোনেন ইমাম আরিফ বিল্লাহ খান তার ছেলেকে মারতে মারতে বাসা থেকে জোর করে মাদরাসায় নিয়ে গেছে। পরে বোনজামাই পাপ্পুকে নিয়ে এতিমখানায় গিয়ে দেখেন ইমাম আরিফ বিল্লাজ ছেলেকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। ইয়াসিনের পিঠ, কান, গাল ফোলা রক্ত জমাটসহ জখম অবস্থায় দেখতে পান।
চিল্লাচিল্লি করলে মাদরাসার অন্য হুজুররা হাজির হয়ে শিকল খুলে দেন। এঘটনায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় ইমামের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭০ ধারায় ইয়াসিনের মা জেসমিন বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলার পর ইমাম আরিফকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
শিশুদের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দেওয়া হয় না। অনেক সময় বাবা-মা বাচ্চাদের শাসন করলেও সেটা নির্যাতন মনে করে না। কারণ বাবা-মাও ছোটবেলায় এ শিক্ষা পেয়েছে। তাই এটা যে নির্যাতন বাবা-মাকে শিক্ষা দেওয়া উচিত।
২০১১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কারিগরি শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে একটি পরিপত্র জারি করে। পরিপত্র জারি হওয়ার পরও থামছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতন। ইয়াসিনের মতো অনেক অবুঝ শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধেও করা হচ্ছে মামলা। তারপরও থামছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশু নির্যাতন।
পৃথিবীর ৬৫টি দেশ সব জায়গায় (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান) শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন করেছে। বাংলাদেশে সবক্ষেত্রে শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটি শক্তপোক্ত আইনের পক্ষে জোর আওয়াজ উঠেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যসাত বছর বয়সী আফিয়া এখন তার বাবা জামাল ও মা দিলবানুর সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলে না। বাসায় দুষ্টামির কারণে আফিয়ার বাবা-মা তাকে প্রচুর শাসন করতেন। মাঝে মধ্যে দুষ্টামির জন্য আফিয়াকে মারধরও করতেন তার বাবা-মা। প্রচুর শাসন ও মারধরের কারণে অফিয়া এখন চুপচাপ ঘরের কোণে বসে থাকে। ঠিকভাবে এখন খেতেও চায় না। এ অবস্থায় আফিয়ার বাবা-মা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ডাক্তার দেখান। ডাক্তার আফিয়ার কোনো রোগ খুঁজে না পেয়ে তাকে কোনো ভয় বা মারধর করা হতো কি না জিজ্ঞাস করেন। বেশি দুষ্টামির কারণে আফিয়াকে শাসন ও মারধর করা হতো বলে তার বাবা-মা জানান। ডাক্তার তখন তাদের পরামর্শ দিলেন শিশুকে অতিরিক্ত শাসন বা মারধর করবেন না। এতে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। আফিয়ার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। এ বিষয়ে অফিয়ার বাবা জামাল বলেন, আমার মেয়েকে অতিরিক্ত শাসন ও মারধরের কারণে সে মানসিকভাবে এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমাদের ভুলের কারণে আজ আমার শিশু অসুস্থ।
আফিয়ার মতো অনেক শিশুকে দুষ্টামির কারণে অনেক পরিবারে প্রচুর শাসন বা মারধর করে। এতে শিশুদের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। অনেক সময় মানসিক নির্যাতনের ফলে শিশুদের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। মানসিক নির্যাতনের ফলে শিশুটির ভবিষ্যৎ জীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই শিশুদের ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর করতে হলে তাদের মানসিক জীবনকে সুন্দর করা জরুরি।
কোনো শিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করা ঠিক নয়। এতে তাদের সুষ্ঠু বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়। মানসিক আঘাত করলে সুষ্ঠু নাগরিক হতে পারে না। শিশু নানা অপরাধ-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। তাই নিজের সন্তানই হোক বা পরের সন্তান, শিশুদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা ঠিক নয়।
ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করে সহিংসতার শিকার শিশুরা ঢাকার পল্টনের একটি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী মাইমুনা জাহান (ছদ্মনাম)। পরিবারের যোগাযোগ সুবিধার জন্য স্মার্টফোন কিনে দেন তার বাবা খায়রুল হাসান। এরপর মাইমুনা নিজের ছবি দিয়ে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোল। অ্যাকাউন্ট খুলতেই পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই তার বন্ধুর তালিকায় যুক্ত হওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট দিতে থাকে। মাইমুনাও সরল মনে বন্ধুর তালিকায় তাদের যুক্ত করতে থাকে। এর মধ্যে এলাকার বড় ভাই মাইমুনাকে মেসেঞ্জারে প্রেমের প্রস্তাব দেন। মাইমুনা এতে রাজি না হলে তাকে ভয়ভীতি দেখাতে থাকেন। বিষয়টি নিয়ে মাইমুনার বাবা আইনজীবীর শরণাপন্ন হন। আইনজীবী থানায় বা আদালতে অভিযোগ দিতে বলেন। মাইমুনা বলে, খারাপ কনটেন্টগুলো আমাকে অনেক মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। আমি আমার বাবা-মাকে বিষয়টি জানাই। বিষয়টির সমাধানের জন্য আমার বাবা-মা আইনজীবীর শরাণাপন্ন হয়েছেন।
এভাবে মাইমুনার মতো ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইন সহিংসতা, অনলাইনে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ডিজিটাল উৎপীড়নের শিকার হচ্ছে। ইউনিসেফ বাংলাদেশের সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইন সহিংসতা, অনলাইনে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ডিজিটাল উৎপীড়নের শিকার হওয়ার মতো বিপদের মুখে রয়েছে। প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু ১১ বছর বয়সের আগেই ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করে নিয়মিত অনলাইন চ্যাটিং (বার্তা আদান-প্রদান) ও ভিডিও দেখে। ৭০ শতাংশ ছেলে ও ৪৪ শতাংশ মেয়ে অনলাইনে অপরিচিত মানুষের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে এবং সেখান থেকেই শুরু হয় সমস্যা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন থাকলেও তা থামছে না। আইন থাকলেও কিছুতেই শিশুশ্রম থামছে না। এতে শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যারা এ ধরনের কাজ করছেন তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরাজাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডা. কামাল উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, পারিবারিক সহিংসতার শিক্ষা হচ্ছে শিশুর গায়ে হাত তোলা বা শিশুর মনটা ছোট করে দেওয়া। এতে মানসিকভাবে শিশুরা বিপর্যস্ত হয়। অনেক সময় তারা জায়গামতো কথা বলতে পারে না, তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ঘটে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান জাগো নিউজকে বলেন, শিশুদের প্রতি নির্যাতন শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়। এছাড়া শিশুদের নানা কথা আমরা শুনি না। শিশু বলে অবহেলা করি। এটাও এক ধরনের নির্যাতনের প্রক্রিয়া। এটা শিশুদের বাবা-মায়েরাও ছোট থাকা অবস্থায় শিকার হয়েছে। এটা চলমান সামাজিক প্রক্রিয়া। আমরা আমাদের নানান রাগ শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেই। টিভি দেখার সময় শিশুদের প্রাধান্য না দিয়ে বাবা-মা যা দেখে তাই তাদের দেখাতে চান।
তিনি আরও বলেন, শিশুদের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দেওয়া হয় না। অনেক সময় বাবা-মা বাচ্চাদের শাসন করলেও সেটা নির্যাতন মনে করে না। কারণ বাবা-মাও ছোটবেলায় এ শিক্ষা পেয়েছে। তাই এটা যে নির্যাতন বাবা-মাকে শিক্ষা দেওয়া উচিত।
এ নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। শিশুদের মতামত প্রাধান্য দিতে হবে। অভাব-অনটন থাকলেও শিশুদের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দিতে হবে।
ছবি: বিপ্লব দিক্ষীৎ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. ইফফাত আরা শামসাদ জাগো নিউজকে বাসাবাড়িতে নির্যাতনের শিকারের বিষয়ে বলেন, কোনো শিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করা ঠিক নয়। এতে তাদের সুষ্ঠু বিকাশ ব্যাঘাত ঘটায়। মানসিক আঘাত করলে সুষ্ঠু নাগরিক হতে পারে না। শিশু নানা অপরাধ-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। তাই নিজের সন্তানই হোক বা পরের সন্তান হোক, শিশুদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা ঠিক না।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার রিংকি জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন থাকলেও তা থামছে না। আইন থাকলেও কিছুতেই শিশুশ্রম থামছে না। এতে শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যারা এ ধরনের কাজ করছেন তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আল মামুন রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, মেয়ে শিশুরা অনলাইনে অপরিচিত মানুষের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে এবং এদের একটি অংশ তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে সেই অনলাইন বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করে এবং অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়, যা পরবর্তীসময়ে স্ক্রিন ভিডিও করে মেয়েকে ব্লাকমেইল করে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। তাই আমাদের শিশুদেরও অনলাইনে প্রাইভেসি সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। সম্ভব হলে তাদের অনলাইন কার্যক্রম মনিটর করা দরকার।
‘আমরা কখনো আমাদের শিশুকে সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে অভিহিত করি না। সব সময় মনে করি ছোটমানুষ সে আর সাইবার ক্রাইমের কী বুঝবে। কিন্তু সাইবার ক্রাইমের শাস্তির অন্তর্ভুক্ত হলে বিচারক কখনো বয়স বিবেচনা করবেন না। তাহলে কেন আমরা আমাদের কোমলমতি শিশুদের সাইবার ক্রাইমের বিষয়গুলো সম্পর্কে অভিহিত করছি না। শিশুদের সাইবার ক্রাইমের সব বিষয় না জানিয়ে তার বয়সের ধাপ অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে সাইবার ক্রাইমের মতো স্পর্শকাতর অপরাধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকুন। এতে আপনার শিশুটি থাকবে সবচেয়ে নিরাপদে।’
জেএ/এএসএ/জেআইএম