জাগো জবস

বিসিএসে প্রথম পছন্দের ক্যাডারই পেয়েছেন মনির

মো. মনিরুজ্জামান ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার বাবা মো. নজরুল ইসলাম, মা সৈয়দা পারভীন। তার জন্ম ১৯৯২ সালের ৫ ডিসেম্বর ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার আগে তিনি নন-ক্যাডারে এবং দুটি ব্যাংকে চাকরি করেছেন।

Advertisement

সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মমিন উদ্দিন—

জাগো নিউজ: বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার পাওয়ার অনুভূতি কেমন?মো. মনিরুজ্জামান: আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া, আল্লাহ হতাশ করেননি। ছোট বোন ফোন করে রেজাল্টের কথা বলে, ‘ভাই, আপনি প্রশাসন ক্যাডার পেয়েছেন।’ কথাগুলো হঠাৎ হঠাৎ কানে বেজে ওঠে। ৩ আগস্টের সন্ধ্যা সোয়া ৭টার মুহূর্ত মনে পড়ে। যেটি আমার জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত। যা আমার জীবনের অনেকগুলো ব্যর্থতা মুছে দিয়েছে।

জাগো নিউজ: পড়াশেনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল? মো. মনিরুজ্জামান: আর্থিক কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। বাবা-মা হাজারো কষ্ট করলেও আমাদের সেগুলো বুঝতে দেননি। তবে এই দিকটি বাদে আমার চারপাশে প্রতিবন্ধকতার অভাব ছিল না। বিভিন্ন কারণে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হতাম। যা লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটাতো। আবার এগুলোই ‘ক্যাডার হতে হবে’ জিদটা বাড়িয়ে দিতো। তখন পরিবারের সবাই অবাক হতো যে, এমন মানসিক অবস্থায়ও পড়া যায় এটা ভেবে। এজন্য আমার রেজাল্টে আমার চেয়ে আমার পরিবারের সবাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। ৪১তমের লিখিত পরীক্ষার আগের প্রতিবন্ধকতা ছিল আমার চাকরি। পরীক্ষার আগের দিন ১টা পর্যন্ত অফিস করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা এসে পরদিন সকালে পরীক্ষার হলে যাই। যা হোক চাকরি, সংসার, বাচ্চা সবকিছু সামলে এ সফলতা পেয়েছি। এ সংগ্রামে আমার পরিবারের সবাইকে আমার পাশে পেয়েছি। এজন্য সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

Advertisement

আরও পড়ুন: জাবীরের বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার হওয়ার গল্প

জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে? মো. মনিরুজ্জামান: ৩৪তম বিসিএস জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের ১ম ও ২য় ব্যাচের জন্য প্রথম বিসিএস ছিল। অ্যাডমিন, পুলিশসহ চারজন জেনারেল ক্যাডার পান। সিনিয়রদের এ সাফল্য বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখায়।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই— মো. মনিরুজ্জামান: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে একটাই চিন্তা ছিল, সিএ করবো। সেই চিন্তায় মাত্রা যোগ করে বন্ধু বুলেট বৈরাগী। বুলেট যখন বলল, ওরও ইচ্ছা সিএ করবে; তখন দুই বন্ধু একদিন কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে গিয়ে ঘুরে এলাম। সব সময় আলোচনায় মশগুল থাকতাম সিএ নিয়ে। ২য় বর্ষে আমি বন্ধু শাহিনের সাথে মেসে উঠি। শাহিন বিসিএস নিয়ে মেসের বড়ভাইদের সাথে কথা বলতো। কিছু কিছু পড়ালেখা করতো। ক্যাম্পাসে এবং অন্য সব সময় আমি, বুলেট এবং শাহিন একসাথে চলতাম। আমি আর বুলেট সিএর পক্ষে, শাহিন শুধু বিসিএসের পক্ষে কথা বলতো। ৩৪তম বিসিএসের রেজাল্টে ডিপার্টমেন্টের সিনিয়রদের সাফল্য, বুলেটের রুমমেট বড় ভাইয়ের ক্যাডার হওয়া, আমার কাজিনের (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) পুলিশ ক্যাডার পাওয়া আমাদের দুজনকে শাহিনের সাথে যোগ দিতে উৎসাহিত করে।

সেই থেকে তিন বন্ধু কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে, কখনো ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে, বন্ধের দিন সন্ধায় সদরঘাটে বোগদাদিয়া লঞ্চের ছাদে, বাহাদুরশাহ পার্কে, কোনো কোনো দিন বুলেট আমার আর শাহিনের রুমে আবার কোনো কোনো দিন আমি শাহিন বুলেটের রুমে চলে যেতাম। এভাবে আমারা প্রস্তুতি নিতাম আর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রিডিং রুমের অভাব বোধ করতাম। ৩৬তম বিসিএস অ্যাপেয়ার্ড সার্টিফিকেট দিয়ে আবেদন করি। প্রিলিতে আমরা খুব সহজেই কোয়ালিফাই করি। সমস্যায় পড়ি ৩৪তমের পর বিসিএসের সিলেবাস পরিবর্তন হওয়ায়। নতুন সিলেবাসের বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার কাউকে না পেয়ে। কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে ক্লাস ভালো না লাগায় নিজেদের মতো প্রস্তুতি নিই। ১৪-১৫ ঘণ্টা পড়ে গাইড বই ৪-৫ বার করে শেষ করি। অগোছালো প্রস্তুতি, পরীক্ষার হলে সবই পারি, মনে হচ্ছিল এবারই ক্যাডার হয়ে যাচ্ছি। ৩৬তমের লিখিত শেষ হওয়ার ১৫ দিন পর ৩৭তমের প্রিলি। এবারও খুব ভালোভাবেই কোয়ালিফাই করি। এমবিএ পরীক্ষার খুব কাছাকাছি সময়ে ৩৭তমের লিখিত হয়, কী করবো? এমবিএ নাকি ৩৭তম লিখিত। আমি এমবিএ শেষ করতে মন স্থির করি। ৩৬তমের কৌশল ৩৭তমেও প্রয়োগ। ক্যাডার হয়ে যাচ্ছি এ চিন্তায় অন্য কোনো চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণও করি না। ৩৬তমের ফলাফল নন-ক্যাডার। ১ সপ্তাহ পরে ৩৭তমের লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে আমার রোল নেই। অন্য কোনো চাকরির পরীক্ষায় লিখিত বা ভাইভা কিছুই দেওয়া নেই।

Advertisement

আরও পড়ুন: আব্বা খুশিতে কান্না করে দিয়েছেন: গালিব

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ১ সপ্তাহের মধ্যে আমার সব স্বপ্ন শেষ। বন্ধুরা অনেকে ব্যাংকের চাকরিতে ঢুকে পড়েছে। আমি এখন পিওর বেকার, ৩৭তমের লিখিত দিয়ে, ৩৬তমের ভাইভা দিয়ে বইয়ের সাথে আর দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ক্যাম্পাস শেষ, শাহিন-বুলেটের সাথে আর আগের মতো বসা হয় না। পুরোনো বইগুলোর ধুলা ঝেড়ে নতুন করে নতুন কৌশলে শুরু হলো ৩৮তমের যুদ্ধ। যথারীতি প্রিলি খুব সহজেই পাস। ২টা বিসিএস দেওয়ার পর এ যাত্রায় মনে হচ্ছে আমি প্রথম বিসিএস দিতে যাচ্ছি। পুরোটা সময় কেবল নোট করতে করতেই শেষ হলো। নোটগুলো পড়ে দেখা খুব একটা হলো না। নোট করতে করতে যা শেখা, তা-ই দিয়েই লিখিত দেওয়া। এরই মধ্যে ৩৬তমের নন-ক্যাডার রেজাল্টে ১০ম গ্রেডের একটা চাকরি হলো এবং ঢাকাকে বিদায় জানালাম।

নতুন চাকরি, ভালোই দিন যাচ্ছে। ৪০তমের প্রিলিতে কোয়ালিফাই করলাম। ৩৮তমের লিখিতের রেজাল্ট হলো। ছাদনা তলায়ও চলে গেলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। কৃষি ব্যাংকে চাকরি হলো, জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হলাম, অক্টোবরের শেষের দিকে ৩৮তমের ভাইভা দিলাম। ভাইভা শেষে জীবনের নতুন অধ্যায়ের দিনগুলো ভালোই কাটছে। কিছুদিনের মধ্যে সরকারি হাইস্কুল ছেড়ে ব্যাংকে যাবো, ফুরফুরে মুডে ডিসেম্বরের শীতের সন্ধ্যায় জন্মদিন পালন করছি। এমন সময় বুলেট ফোন করে জানালো আর ২০ দিন পর ৪০তমের লিখিত পরীক্ষায় বসতে হবে। জন্মদিনের আনন্দ পণ্ড হলো। ১ হাজারের ওপর খাতা দেখে স্কুলে জমা দিতে হবে। লিখিত পরীক্ষার দুই দিন আগে ব্যাংকে জয়েনিং ডেট, ফলে ৪০ ও ৩৮তমের মতো পরীক্ষা হলো। ব্যাংকে এসে ৪১তমের প্রিলি, লিখিত দিলাম। ৪০তমের ভাইভা দিলাম। ৩৮তমের নন-ক্যাডারের রেজাল্ট পেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যাডার হতে হলে ব্যাংকের বেশি বেতনের চাকরি ছাড়তে হবে। ব্যাংক ছেড়ে ৪১তমের ভাইভা, ৪৩তমের লিখিত, ৪৪-৪৫তমের প্রিলিও কোয়ালিফাই করলাম। এখন আমার আর কোনো ভাইভা দিতে হবে না। আমার প্রথম পছন্দের ক্যাডারই পেয়েছি।

জাগো নিউজ: কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?মো. মনিরুজ্জামান: আমার জীবনে সব সময় আমি আমার বড় ভাইয়ের উৎসাহ পেয়েছি। বিসিএস দিতে গিয়ে বড় ভাইয়ের উৎসাহ ছাড়াও বাবা, মা, অন্য ভাই-বোন এবং আমার স্ত্রীকেও পাশে পেয়েছি।

আরও পড়ুন: পরিবার আমাকে সাহস জুগিয়েছে: মীম জাহান তন্বী

জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?মো. মনিরুজ্জামান: সম্মান ও সাফল্য দেওয়ার মালিক আল্লাহ। আল্লাহর রহমতে রাষ্ট্রের যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে যাচ্ছি, তা যথাযথভাবে পালন করতে চাই। নিজের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে কর্মজীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে চাই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রায় রাষ্ট্রীয় সম্পদের সদ্ব্যবহারে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিয়ে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ায় নিজের কর্মজীবন উৎসর্গ করতে চাই।

এসইউ/এমএস