শুধু ভৌগোলিক নৈকট্যই নয়, একই আর্থ-সামাজিক পটভূমি, সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং অভিন্ন সংস্কৃতির কারণেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি অনন্য সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে রক্তদানের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে তা ইতিহাসে বিরল। স্বাধীনতার পর থেকে কিছু কিছু বৈরী ইস্যু ছাড়া উভয় দেশ রাজনীতি, সংস্কৃতি, বাণিজ্য এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘ এবং কার্যকর কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
Advertisement
ভারতের ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি কোভিড মহামারিতে টিকা প্রদানে অগ্রাধিকার থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাসহ নরেন্দ্র মোদীর অধীনে দিল্লি সরকার সর্বদা বাংলাদেশের পাশে ছিল। অন্যদিকে কানেক্টিভিটি থেকে শুরু করে সব নিরাপত্তা উদ্বেগের সমাধান করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ভারতের মন জয় করেছে।
ভারতীয় নাগরিকরা বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনায় হাসিনার সরকারের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, উত্তর-পূর্ব ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ২০০৯ এর পর শেখ হাসিনা সরকারের ক্র্যাকডাউন হলো একক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ যা উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে সহিংসতা ৮০ শতাংশ হ্রাস করেছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য আন্তঃসীমান্ত ভারতবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে ধরতে এবং তাদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে ফিরিয়ে দিতে সফল হয়েছেন।
সামুদ্রিক সীমা নির্ধারণ, স্থলসীমান্ত ব্যবস্থা, ছিটমহল, সমুদ্র শিপিং এবং অভ্যন্তরীণ জলপথ সম্পর্কিত বিষয়ে একটি মীমাংসা হওয়ার পর উভয় দেশ এখন তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের একটি বিশ্বাসের জায়গায় পৌঁছেছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২১-২২ সালে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে মোট বাণিজ্য ছিল ১৬.৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে ভারত ১৪.৫৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে এবং ১.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে।
Advertisement
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতিতে বাংলাদেশ এবং ভারত উন্নয়নের জন্য সহযোগিতার একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার অধীনে উভয় পক্ষই বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতাকে সংকুচিত করতে এবং উপ-আঞ্চলিক স্তরে তাদের সহযোগিতা প্রসারিত করতে সম্মত হয়েছে। উভয় দেশ এখন একটি ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সেপা) স্বাক্ষরের জন্য কাজ করছে, যা তিনটি নির্দিষ্ট মাত্রার ওপর জোর দেয়: পণ্য বাণিজ্য, পরিসেবা এবং বিনিয়োগ।
উভয় সরকারই সম্প্রতি কানেক্টিভিটি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের ‘সংযোগ পরিকাঠামো’ উন্নয়নের মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ড এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মধ্যে মাল্টি-মডাল ট্রানজিট ক্রমবর্ধমানভাবে বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে বিনিয়োগকারী ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এখন ত্রিপুরায় তাদের উৎপাদন সম্প্রসারণ করতে চাইছেন, যা উত্তর-পূর্বে শিল্পায়নের জন্য নতুন দিগন্ত খুলেছে। বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থার সাথে সংযোগের কারণে আগরতলা এখন ভারতের তৃতীয় ইন্টারনেট গেটওয়ে হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা উত্তর-পূর্বে আইটি শিল্প বৃদ্ধির জন্য একটি বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
গত আট বছরে ভারত সড়কপথ, নৌপরিবহন, বন্দর এবং রেলপথসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশকে ৮ বিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট লাইন প্রদানের অঙ্গীকার করেছে। এটি বিশ্বের কোনো একক দেশের জন্য ভারতের বৃহত্তম ছাড়ের ক্রেডিট লাইন। বাংলাদেশে বর্তমানে ভারতের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪০০ মিলিয়ন ডলারে আশুগঞ্জ নদী বন্দর এবং আখাউড়া স্থলবন্দর সড়ক উন্নীতকরণ। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের সাথে সংযোগকারী একটি সড়ক প্রকল্পের কাজও করা হচ্ছে ৮০ মিলিয়ন ডলারে।
শুধু বাণিজ্য ও অর্থনীতিই নয়, পারস্পরিক আস্থা, সম্মান এবং সহযোগিতার মাধ্যমেই দুই দেশের সম্পর্ক বিশ্বের জন্য একটি রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক সদিচ্ছার ফলে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পরে প্রধানমন্ত্রী মোদী তার প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশ এসেছিলেন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অংশ নিতে।
Advertisement
বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকছে তা কেবলই অপপ্রচার। পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার বিপরীতে বাংলাদেশ চীনের অতিরিক্ত নির্ভরতা এড়াতে বিচক্ষণ সামষ্টিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেছে। বাংলাদেশ এটি ভালো করেই জানে, দেশ যদি চীনের খপ্পরে পড়ে তা ভারতের জন্য বিরাট ক্ষতি হবে। কারণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাংলাদেশ ভারতের নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। তাই কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা চাপে থাকলেও ঢাকা চীনের ব্লকে চলে যায়নি।
দুই সরকারের মধ্যে এ ধরনের নিবিড় বোঝাপড়া থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো মহল বাংলাদেশের সমালোচনা করছে এবং কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ না করেই বাংলাদেশকে ‘চীন-ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করছে।
অনেকের মধ্যে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, বাংলাদেশ চীনের ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে, যা ভিত্তিহীন। বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সংস্থার সাথে কাজ করে ঋণ পরিচালনার কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ তার অধিকাংশ ঋণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে। দেশ হিসেবে জাপান সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতা (১৯%)।
স্পষ্টতই বাংলাদেশের বাহ্যিক ঋণের পোর্টফোলিওতে বিশ্বব্যাংক (৩৬%) এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (২৩%) আধিপত্যে রয়েছে। তথ্য স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, চীন থেকে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ দেশটির জিডিপির (৪১৬ বিলিয়ন) তুলনায় খুবই নগণ্য। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তাদের ফেব্রুয়ারি রিপোর্টে বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বেশি ঋণ নেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের বাহ্যিক ও সামগ্রিক ঋণ সংকটের ঝুঁকি কম।
আবার চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তিতে। বাংলাদেশে চীনের প্রকল্পগুলো মূলত অবকাঠামো নির্মাণ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং পৌর-সেবার অন্তর্ভুক্ত, কৌশলগত নয়। তাছাড়া বাংলাদেশও চীনের প্রকল্পগুলোর ভূ-রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা সম্পর্কে সচেতন এবং এমন প্রকল্প গ্রহণ করে যার অর্থনৈতিক কার্যকারিতা রয়েছে।
ইতিপূর্বে বাংলাদেশ চীন-প্রস্তাবিত বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাতিল করেছিল অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার বিচার করে। উদাহরণস্বরূপ সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরে বাংলাদেশ ১৪ বিলিয়ন ডলার চীনা বিনিয়োগের অনুমতি দেয়নি কারণ জাপানের প্রস্তাবিত মাতারবাড়ি আরও লাভজনক ছিল। এছাড়া ৩.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের দুটি রেল প্রকল্পও তাদের নিম্ন আর্থিক সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ বাতিল করেছে।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ চীন থেকে ২.৬ বিলিয়ন ডলার এফডিআই পেয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্যান্য বড় উন্নয়ন সহযোগীদের তুলনায় বাংলাদেশে চীনা এফডিআই লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পরে চীন হলো বাংলাদেশের ৫ম বৃহত্তম এফডিআই উৎস।
উপরে উল্লিখিত তথ্যগুলো ইঙ্গিত করে যে অনেক পন্ডিত যে অভিযোগ করে বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকছে তা কেবলই অপপ্রচার। পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার বিপরীতে বাংলাদেশ চীনের অতিরিক্ত নির্ভরতা এড়াতে বিচক্ষণ সামষ্টিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেছে। বাংলাদেশ এটি ভালো করেই জানে, দেশ যদি চীনের খপ্পরে পড়ে তা ভারতের জন্য বিরাট ক্ষতি হবে। কারণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাংলাদেশ ভারতের নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। তাই কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা চাপে থাকলেও ঢাকা চীনের ব্লকে চলে যায়নি।
অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক অংশীদারত্বের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি প্রমাণ করে যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ভালো প্রতিবেশী কূটনীতির একটি রোল মডেল শেখ হাসিনার কেবল একটি অগভীর বক্তব্য নয়। বরং এটি সহযোগিতার একটি শক্তিশালী উচ্চারণ, যা বৈশ্বিক ফোরামে উভয় দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থানকে উন্নীত করার সাথে সাথে পারস্পরিকভাবে ফলপ্রসূ সম্পর্কের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম