অর্থনীতি

‘মাফিয়াদের দখলে’ সোনা, বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের

দেশের বাজারে দফায় দফায় বাড়ছে দামি ধাতু সোনার দাম। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সম্প্রতি দেশের বাজরে সোনার দাম উঠেছে নতুন উচ্চতায়। ভালো মানের প্রতি ভরি সোনার দাম এক লাখ এক হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যদিও বিশ্ববাজারের তুলনায় এ দাম প্রতি ভরিতে অন্তত ১৪ হাজার টাকা বেশি।

Advertisement

বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশের বাজারে সোনার দামের এ বিস্তর ফারাকের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে সোনার খনি নেই। দেশে সোনা উৎপাদন হয় না। আবার অতিরিক্ত ট্যাক্সের কারণে এখন আমদানিও হচ্ছে না। রিসাইক্লিং করে যে সোনা পাওয়া যাচ্ছে তাই সরবরাহ করা হচ্ছে বাজারে। এ কারণে বিশ্ববাজার ও দেশের বাজারের মধ্যে সোনার দামে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।

তবে জুয়েলারি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, দেশের বাজারে সোনার দাম বেশি হওয়ার পেছনে বিশেষ একটি চক্র রয়েছে। এই চক্রের মর্জির ওপরই সোনার দাম বাড়া বা কমা নির্ভর করছে। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা বর্তমানে বিপাকে রয়েছেন। সোনার বাড়তি দামের কারণে ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। অনেকে কর্মীদের বেতন পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন।

টানা দুই সপ্তাহ কমার পর বিশ্ববাজারে গত সপ্তাহে সোমার দাম কিছুটা বেড়েছে। এক সপ্তাহে প্রতি আউন্স সোনার দাম বেড়েছে ২৫ ডলারের ওপরে। এর আগে টানা দুই সপ্তাহের পতনে প্রতি আউন্স সোনার দাম কমে প্রায় ৫৩ ডলার। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে দুই সপ্তাহে সোনার দাম যে পরিমাণ কমেছে, গত সপ্তাহে বেড়েছে তার অর্ধেকের কম।

Advertisement

আরও পড়ুন: সোনার রেকর্ড দাম

বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা গেলে গত বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) দেশের বাজারেও সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। অবশ্য স্থানীয় বাজারে তেজাবি সোনার (পাকা সোনা) দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই দাম বাড়ানো হয়েছে বলে জানায় বাজুস।

গত সপ্তাহে বিশ্ববাজারে সোনার দাম কিছুটা বাড়ায় দেশের বাজারেও দামি এ ধাতুর দাম বাড়ে। অথচ তার আগের দুই সপ্তাহে দাম কমার বিষয়টি যেন এড়িয়ে গেছে বাজুস। ফলে বিশ্ববাজার ও দেশের বাজারে সোনার দামের মধ্যে বড় ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে।

এ দফায় সব থেকে ভালো মানের এক ভরি সোনার দাম দুই হাজার টাকার ওপরে বাড়ানো হয়েছে। এতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দেশের বাজারে ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে উঠেছে সোনা।

Advertisement

আরও পড়ুন: বিশ্ববাজারে সোনার দাম আরও কমেছে

গত সপ্তাহে বিশ্ববাজারে সোনার দাম কিছুটা বাড়ায় দেশের বাজারেও দামি এ ধাতুর দাম বাড়ে। অথচ তার আগের দুই সপ্তাহে দাম কমার বিষয়টি যেন এড়িয়ে গেছে বাজুস। ফলে বিশ্ববাজার ও দেশের বাজারে সোনার দামের মধ্যে বড় ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকা ধরলে বর্তমানে বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশের বাজারে প্রতি ভরি সোনা সাড়ে ১৪ হাজার টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

 গত সপ্তাহে বিশ্ববাজারে সোনার দাম কিছুটা বাড়লেও মাসের ব্যবধানে এখনো দাম বেশ কম রয়েছে। এক মাস আগের তুলনায় বর্তমানে বিশ্ববাজারে সোনা বিক্রি হচ্ছে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ কম দামে। 

বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২৫ আগস্ট থেকে সব থেকে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) সোনা এক লাখ এক হাজার ২৪৪ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

এছাড়া ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা ৯৬ হাজার ৬৩৬ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা ৮২ হাজার ৮১৪ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি সোনা বিক্রি হচ্ছে ৬৯ হাজার ৫১ টাকা।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের সোনার বাজার ধরায় প্রধান প্রতিপক্ষ ভারত

শুক্রবার (২৫ আগস্ট) থেকে ২২ ক্যারেটের সোনার দাম ভরিতে ২ হাজার ২২২ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া ২১ ক্যারেটের ২ হাজার ৪১ টাকা, ১৮ ক্যারেটের এক হাজার ৭৪৯ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি সোনার দাম এক হাজার ৫১৬ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

এর আগে ১৮ আগস্ট থেকে ২৪ আগস্ট সব চেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা বিক্রি হয় ৯৯ লাখ ২৭ টাকা। এছাড়া, ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা ৯৪ হাজার ৫৯৫ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা ৮১ হাজার ৬৫ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি সোনা বিক্রি হয় ৬৭ হাজার ৫৩৫ টাকা।

দেশে সোনার বাজার এখন মাফিয়াদের দখলে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এখন ঠিকভাবে ব্যবসা করতে পারছেন না। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মাধ্যমে সোনার বাজার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ওই চক্র যেভাবে চাচ্ছে, অনেকটা সেভাবেই বাজার চলছে।

অবশ্য সোনার গহনা কিনতে বাজুস নির্ধারিত দামের ওপর ভ্যাট দিতে হয় ৫ শতাংশ। আর ভরি প্রতি মজুরি ধরা হয় ন্যূনতম ৩ হাজার ৪৯৯ টাকা। ফলে বর্তমান দাম অনুযায়ী, ভালো মানের এক ভরি সোনার গহনা কিনতে ক্রেতাদের এক লাখ ৯ হাজার ৮০৫ টাকা গুনতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন: কোন দেশের ব্যাংকে কত সোনা

এদিকে, বিশ্ববাজারে গত এক সপ্তাহে প্রতি আউন্স সোনার দাম বেড়েছে ২৫ দশমিক ২০ ডলার বা এক দশমিক ৩৮ শতাংশ। এতে প্রতি আউন্স সোনার দাম দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯১৪ দশমিক ১৬ ডলার।

এর আগে টানা দুই সপ্তাহের পতনে প্রতি আউন্স সোনার দাম কমে ৫২ দশমিক ৭২ ডলার। ফলে গত সপ্তাহে বিশ্ববাজারে সোনার দাম কিছুটা বাড়লেও মাসের ব্যবধানে এখনো দাম বেশ কম রয়েছে। এক মাস আগের তুলনায় বর্তমানে বিশ্ববাজারে সোনা বিক্রি হচ্ছে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ কম দামে।

বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (২৮ দশমিক ৩৫ গ্রাম) সোনা যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তাতে এক ভরির দাম দাঁড়ায় ৮৬ হাজার ৬২৯ টাকা (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে)। এ হিসাবে বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশের বাজারে প্রতি ভরি সোনা বিক্রি হচ্ছে ১৪ হাজার ৬১৫ টাকা বেশি দামে।

আরও পড়ুন: ক্যাডমিয়ামের দাম নিয়ে নিম্নমানের গহনা দিচ্ছে সোনা ব্যবসায়ীরা

বিশ্ববাজার ও দেশের বাজারে সোনার দামের এই ব্যবধানের কারণ জানতে চাইলে বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান এম এ হান্নান আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, সোনা এখন আমদানি হয় না। কেউ সোনা আমদানি করছে না। আমরা রিসাইক্লিং করে যে সোনা পাই, আমাদের যে হোলসেল মার্কেট আছে সেখান থেকে কিনি। এরপর নামমাত্র মুনাফা ধরে দাম নির্ধারণ করা হয়। তাতে আমাদের তেমন কিছুই থাকে না।

তিনি বলেন, কয়েকদিন আগেও একজন লোক সোনার দুইটি টুকরা আনতে পারতেন ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিয়ে। এখন একটা টুকরা মানে ১০ ভরি সোনা আনতে ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। বাজারে সোনার যে চাহিদা সেই অনুযায়ীও আমদানি নেই। এসব কারণেই আন্তর্জাতিক বাজার ও দেশের বাজারে সোনার দামে কিছুটা ব্যবধান রয়েছে।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজুসের সাবেক এক সভাপতি বলেন, দেশে সোনার বাজার এখন মাফিয়াদের দখলে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এখন ঠিকভাবে ব্যবসা করতে পারছেন না। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মাধ্যমে সোনার বাজার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ওই চক্র যেভাবে চাচ্ছে, অনেকটা সেভাবেই বাজার চলছে। সোনার দাম বাড়া বা কমা তাদের ওপরই নির্ভর করছে।

আরও পড়ুন: জুয়েলারি ব্যবসায় প্রতারণার ফাঁদ, ঠকছেন ক্রেতারা

তিনি বলেন, আমরা চাই সোনার দাম বাজারভিত্তিক হোক। কিন্তু সেটা খুব একটা হচ্ছে না। এর জন্য বিশেষ চক্রের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি সরকারের নীতি পলিসিরও দুর্বলতা আছে। প্রকৃত জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা বর্তমানে খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। অনেকেই ব্যবসায় লোকসান করছেন। কেউ কেউ কর্মীদের বেতন, দোকান ভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। সোনার অস্বাভাবিক দাম হওয়ার কারণে অনেকেই এখন সোনার গহনা কিনতে চাচ্ছেন না।

সোনার বাড়তি দামের কারণে জুয়েলারি ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে, ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন প্রাইসিং অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান এম এ হান্নান আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, সোনার দাম বাড়া-কমার কারণে এ খাতের ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই খারাপ। সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, আমাদের ভবিষ্যত কী? এই ব্যবসায় আমরা টিকতে পারবো কি না? এমনো দেখা যায় দুই-চারদিন পর্যন্ত কোনো কোনো দোকানে বিক্রিই হয় না। অনেক দোকান মালিক আছেন, তাদের কর্মচারীদের বেতন দিতে কষ্ট হচ্ছে।

এমএএস/কেএসআর/জেআইএম