জাতীয়

‘গোষ্ঠীস্বার্থের ভূত চেপে বসার কারণেই বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না’

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের চেয়ারম্যান। প্রধান নির্বাহী, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ, ডেনিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, সুইডিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা, টেকসই উন্নয়ন কমিশন, অ্যাকশন এইড, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থার পরামর্শকও ছিলেন।

Advertisement

সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। ফের নানা আলোচনা। এমন আলোচনায় যুক্ত হচ্ছেন বিদেশিরাও। ১/১১–এর একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে আপনারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালনায় দায়িত্ব নেন। সেই সময়ের সংকটের সঙ্গে তুলনা করে এখন কী বলবেন?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: বর্তমান অর্থনৈতিক যে পরিস্থিতি তা রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। রাজনীতির কারণেই অর্থনৈতিক বিষয়গুলো মানুষের সামনে বিশেষভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। আমরা একটি নির্বাচনী ক্যালেন্ডারের শেষ পর্যায়ে আছি। জাতি একটি রাজনৈতিক দেন-দরবারের মধ্যে আছে। একই সঙ্গে আমরা সংকটময় অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে আছি। তার মানে অর্থনীতি ও রাজনীতি- দুটোরই মোটামুটি সংকটময় চেহারা দেখতে পাচ্ছি। আমি মনে করি আলোচনা দুটোকে মিলিয়েই করা জরুরি।

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনি মিলিয়ে আলোচনা করতে চাইছেন। কিন্তু অর্থনীতি তো বিশ্ব পরিস্থিতি দ্বারাও কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত, যা সাধারণত একটি দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে না।

আরও পড়ুন>> ‘চোখ-কান খোলা রাখলেই গরিবের কান্না দেখতে পাওয়া যায়’

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: ঠিকই বলেছেন। অর্থনীতি বিশ্ব পরিমণ্ডল দ্বারাও কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত। কিন্তু অর্থনীতির অনেক বিষয়ই রাজনীতির মধ্যে জোরালোভাবে চলে আসছে। যেমন দুর্নীতি। দুর্নীতি রাজনৈতিক আলোচনার অন্যতম বিষয় হিসেবে চলে আসছে। দুর্নীতির কিন্তু অর্থনৈতিক পরিণতি আছে। যেমন ব্যাংকের যে বেসামাল অবস্থা, তা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনেকাংশে দায়ী। বন্যার পানিতে কক্সবাজারে রেলপথ বেঁকে যাওয়ার ঘটনাও কিন্তু উন্নয়ন নিয়ে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। দুর্নীতি কেবল রাজনৈতিক বিষয় নয় এবং এর অর্থনৈতিক সুনির্দিষ্ট পরিণতি আছে। অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি বড় ধরনের অন্তরায়।

আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই মুহূর্তে মানুষের বড় কষ্ট দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি অর্থনৈতিক হলেও রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হয়। রাজনৈতিক সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে। গোষ্ঠী স্বার্থগুলোর কাছে জনস্বার্থগুলো নিয়মিতভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

এই মুহূর্তে মানুষের বড় কষ্ট দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি অর্থনৈতিক হলেও রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হয়। রাজনৈতিক সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে। গোষ্ঠী স্বার্থগুলোর কাছে জনস্বার্থগুলো নিয়মিতভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন>> জবাবদিহি থাকায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা

যুদ্ধ বা করোনা মহামারির প্রভাব তো গোটা বিশ্বেই পড়েছে। কিন্তু অনেক দেশেই তো বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। শ্রীলঙ্কায় মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতি ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি আমাদের চেয়ে এখন অনেক কম সেখানে। গোষ্ঠীস্বার্থের ভূত ঘাড়ের ওপর চেপে বসার কারণেই এখানে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

জাগো নিউজ: তাহলে এই গোষ্ঠী কি সরকারের চেয়েও শক্তিশালী?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: শক্তিশালী কি না এ প্রশ্নের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সরকার শক্তি দমনে ইচ্ছুক কি না? প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। আলোচনা ছিল ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলবে না। সরকার কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি। মূলত গোষ্ঠীস্বার্থের কারণেই করেনি। এই গোষ্ঠীদেরই কেউ না কেউ রাজনৈতিক সরকারের মধ্যে প্রবল প্রতাপে বসে আছে।

আরও পড়ুন>> বাজারের আগুন নেভাবে কে?

একইভাবে আপনি জ্বালানি সেক্টরের দিকে তাকান দেখবেন দুর্নীতির অন্যতম জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থের কারণেই জ্বালানিখাতের টেকসই সমাধান করা যাচ্ছে না। এসবে আবার দেশীয় স্বার্থের পাশাপাশি বিদেশি গোষ্ঠীর স্বার্থও জড়িত, যা উন্নয়ন হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে।

ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থের কারণেই জ্বালানিখাতের টেকসই সমাধান করা যাচ্ছে না। এসবে আবার দেশীয় স্বার্থের পাশাপাশি বিদেশি গোষ্ঠীর স্বার্থও জড়িত, যা উন্নয়ন হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ এই মুহূর্তে আরেকটি সংকটময় সময়ে রয়েছে। ১২ বিলিয়ন ডলার দেনা শোধ করতে হবে চার মাসের মধ্যে।

জাগো নিউজ: ঋণ নিলে তো শোধ করতেই হবে।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সামষ্টিক অর্থনীতির বিচারে বাংলাদেশ কিন্তু ভালো ছিল। বিশেষ করে গত ১০ দশকে উচ্ছৃঙ্খল উন্নয়নের সংস্কৃতি দাঁড়িয়েছে। প্রকল্প ব্যয় মাত্রারিক্ত ধরা হচ্ছে। সেখানে আবার মনিটরিংও থাকছে না।

জাগো নিউজ: এমন উন্নয়নের জন্যও তো অর্থের দরকার। কোথা থেকে এলো এই অর্থ, কারা জোগান দিলো?

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সরকার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ নিয়েছে বাইরে থেকে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ছাপানোর যে কারখানা রয়েছে, তাও উচ্ছৃঙ্খলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেই হচ্ছে। রাজনৈতিক যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা ভাঙতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। আমি মনে করি রাজনৈতিক নবায়ন দরকার।

এএসএস/এএসএ/জেআইএম