ভ্রমণ

মুক্তাগাছার মণ্ডা ও উত্তরবঙ্গের অভিজ্ঞতা

ঢাকায় যখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, তখন বাসায় ইলেকট্রিসিটি নেই আর ফোনেও ডেটা নেই। অলস সময় কাটাতেই ফোনের গ্যালারি ঘুরেফিরে দেখছিলাম। হুট করেই সামনে আসতে থাকে গতবছর আমাদের টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া রাইডের ছবিগুলো।

Advertisement

দারুণ সব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই নক দেই আমার সব সময়ের রাইড পার্টনার তহুরুজ্জামান খান অনিককে। দুই বন্ধুই স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আবারও প্ল্যান করে ফেলি উত্তরের দিনগুলোতে ফিরে যাবো আবারও।

আরও পড়ুন: ইলিশ খেতে মাওয়া ঘাটে কীভাবে যাবেন, খরচ কত?

প্ল্যান করে বেশিদিন জমিয়ে রাখতে নেই। তাই বৃষ্টি কমার অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে পড়ি আমাদের উত্তরবঙ্গ ভ্রমণে। বাংলাদেশে উত্তর অঞ্চলে পর্যটনকেন্দ্র খুব একটা নেই, তবে উত্তরের ভ্রমণে আপনি পাবেন প্রকৃত বাংলাদেশের অনুভূতি।

Advertisement

গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মেঠোপথ, সবই আপনাকে বারবার আমন্ত্রণ জানাবে তার সান্নিধ্যে। আমাদের সাধ্য নেই সেই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়ার। তাই আমরাও শুরু করলাম আমাদের উত্তরের যাত্রা। এই যাত্রায় আমরা বেশ কয়েকটি জেলা ভ্রমণ করবো ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করবো।

ডেমরা থেকে যাত্রা শুরু করে এয়ারপোর্ট অতিক্রম করার আগেই তীব্র জ্যামের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের। গাজীপুর পর্যন্ত আমাদের ট্রাফিক জ্যাম, অসতর্ক পথচারী ও ধুলাবালির সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। গাজীপুর অতিক্রম করেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক আমাদের মুক্তি দেয় যান্ত্রিক কোলাহল থেকে।

আরও পড়ুন: সহস্রধারা ঝরনায় একদিন

কিছু দূর অতিক্রম করেই হাইওয়ের পাশে একটি হোটেলে সকালের নাস্তাটা সেড়ে নিলাম। ট্রাক ড্রাইভারদের হোটেলে মূলত বেশ ভিন্ন এক পরিবেশ থাকে সব সময়। টিভিতে বা রেকর্ডারে ৮০ কিংবা ৯০ দশকের ক্ল্যাসিক কোনো গান আর মুসাফির মানুষদের আনোগনা চলতে থাকে অনবরত।

Advertisement

দুপুর নাগাদ পৌঁছে যাই ময়মনসিংহ সদরে। ময়মনসিংহ সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমের মুক্তাগাছায়। উদ্দেশ্য মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি দর্শন। মুক্তাগাছায় গিয়ে মণ্ডা না খেলে কি চলে! গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকানের জন্য মুক্তাগাছা সুপ্রসিদ্ধ।

মুক্তাগাছার মণ্ডার আবিষ্কারক গোপাল পাল। তিনি ১৮২৪ সালে দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর সময়। এরপর কেটে গেছে প্রায় ২০০ বছর। মণ্ডা তৈরির ব্যবসা চলছে বংশানুক্রমে। এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে। সে হিসাবে এখন পঞ্চম পুরুষের ব্যবসা চলছে।

আরও পড়ুন: ঢাকার কাছেই ঘুরে আসুন গোলাপের রাজ্যে

বর্তমানে মণ্ডার ব্যবসা সামলাচ্ছেন পঞ্চম পুরুষ রবীন্দ্রনাথ পাল। কথিত আছে, গোপালচন্দ্র পাল স্বপ্ন দেখেন, এক সন্ন্যাসী তাকে মণ্ডা তৈরি করার আদেশ দিচ্ছেন। টানা কয়েক রাতে স্বপ্নযোগে সন্ন্যাসী তাকে মণ্ডা বানানোর পদ্ধতি শিখিয়ে দেন।

এরপর গোপাল তার বানানো নতুন মিষ্টি পরিবেশন করেন মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরীকে। মন্ডার অতুলনীয় স্বাদে জমিদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। এখবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গোপাল পালের মণ্ডা।

দোকানে ঢুকে চোখে পড়ল চেয়ারগুলো ‘এল’ আকৃতি করে সাজিয়ে রাখা। সামনে ছোট ছোট টেবিল। কাউন্টারের পাশেই গোপালচন্দ্র পাল এর একটি কাঠের মূর্তি কাঁচের বাক্সে রাখা আছে ও পেছনের দেওয়ালে ঝুলছে পাঁচ পুরুষের ছবি। ক্রেতারা বসে অর্ডার দিলে পরিবেশন করা হয় মণ্ডা।

আরও পড়ুন: ঢাকার কাছেই ঘুরে আসুন গোলাপের রাজ্যে

মণ্ডার স্বাদ আপনাকে যতোটা বিমোহিত করবে, তারচেয়ে বেশি বিমোহিত হবেন এর শত বছরের ইতিহাস। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নে পাওয়া সেই মণ্ডার দোকান।

জেএমএস/এমএস