বিনোদন

এফডিসিতে দিতিকে শেষ শ্রদ্ধা

মেয়ে লামিয়া চৌধুরীর অনেক ক্ষোভ চলচ্চিত্রের মানুষদের প্রতি। ক্ষোভের কারণ, তার মা দিতি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকার দিনগুলোতে তেমন কেউ দেখা করতে আসেননি। তাই গতকাল রোববার রাতে যখন দিতিকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তার মরদেহ এফডিসিতে নেয়ার দাবি উঠল আপত্তি তুললেন লামিয়া। শেষ পর্যন্ত চিত্রপরিচালক গুলজার, এস এ হক অলীক, চিত্রনায়ক রিয়াজ, ওমর সানী, চিত্রনায়িকা ববিতা, মৌসুমী ও অারো কয়েকজনের অনুরোধে লামিয়া রাজি হন। অবশেষে নির্ধারিত সময় সোমবার সকাল ১০টায় শেষবারের মতো এফডিসিতে এসেছিলেন চিত্রনায়িকা দিতি। প্রিয় নায়িকাকে দেখতে সোমবার সকালে এফডিসি প্রাঙণে ছুটে এসেছিলেন তার চলচ্চিত্র সহকর্মী, সাংবাদিক ও ভক্তরা। এসেছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, এফসিডির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বর্তমানে বিটিভির মহাপরিচালক এস এম হারুন-অর-রশীদ, অভিনেতা আলমগীর, ওমর সানি, অভিনেত্রী চম্পা, খালেদা আক্তার কল্পনা, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার, নির্মাতা এস এ হক অলিক, চিত্রনায়ক রুবেল, অভিনেতা মিজু আহমেদ, আহমেদ শরীফ, সঙ্গীতশিল্পী মনির খান, অভিনেতা শিবা আলী খান প্রমুখ। তারা খুব কাছের, খুব প্রিয়, খুব পছন্দের দিতিকে অশ্রুজলে ভেজা ফুলেল শুভেচ্ছায় বিদায় জানালেন। করলেন কতো শতো স্মৃতিচারণ। সেইসব শুনে শুনে এফডিসির জহির রায়হান কালার ল্যাবের চত্বরটি হয়ে উঠেছিলো দিতিময়।দিতিকে নিয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘দিতি একজন আপাদমস্তক অভিনেত্রী ছিলেন। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন, একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন। আমাদের এখানে অনেক অভিনয়শিল্পী আছেন, কিন্তু দিতির মতো দেশ সচেতন অভিনয়শিল্পী খুব বেশি নেই। আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।’দিতিকে নিয়ে চম্পা বলেন, ‘ওর সঙ্গে কতো স্মৃতি। কী করে ভুলব এসব! দিতি আমার কাছে বোনের মত ছিলো। একসাথে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছি আমরা। কেন একটু আগে আগেই চলে যেতে হলো? আর তো দেখা হবে না, কথা হবে না। শুধু দোয়া করি, ভালো থাক দিতি। ওর সন্তানদের জন্যও সমবেদনা জানাচ্ছি। আমরা লামিয়া ও দীপ্তর পরিবার হয়েই ওদের পাশে আছি।’দিতির স্মৃতিচারণ করে চিত্রনায়ক আলমগীর বলেন, ‘আমি সত্যি সৌভাগ্যবান যে আমার বিপরীতে কাজ করেই দিতি প্রথম এবং একমাত্র জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেছিলো। ওকে আমি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতাম। খুব ভালো একটা মেয়ে ছিলো। দায়িত্ববান মা-ও। একা একা কী চমৎকার সে তার ছেলেমেয়ে দুজনকেই মানুষ করে তুলেছে।’চোখের জল মুছে আলমগীর আরো বলেন, ‘দিতি আর আসবে না। গুণী অভিনেত্রী দিতি, ভালো মানুষ দিতি আমরা পাবোও না। বড় অবেলাতেই চিরতরের পথে যাত্রা হলো তার। সে যাত্রা শুভ হোক। আল্লাহ দিতিকে বেহস্তে দান করুন।’সেইসঙ্গে আলমগীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘দিতির মতো সিনিয়র, গুণী একজন অভিনেত্রী আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। কতোজন কতো দূর দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী শোক প্রকাশ করেছেন। সংস্কৃতিমন্ত্রী সব ব্যস্ততা ফেলে ছুটে এসেছেন দিতির জানাজায় অংশ নিতে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম চলচ্চিত্রের অনেক তারকা, বিশেষ করে এই প্রজন্মের তারকারা কেউই দিতিকে বিদায় জানাতে আসেননি। এটা আমাদের জন্য লজ্জার এবং হতাশার। আমরা সেলিব্রেটির জন্ম দিচ্ছি যেখানে সেখানে, কিন্তু মানুষ জন্মাতে পারছি কই?’খালেদা আক্তার কল্পনা বলেন, ‘আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না এমন চমৎকার মেয়েটা মরনব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। খুব কষ্ট হতো ওর জন্য। কাল যখন শুনলাম দিতি আর নেই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মায়ের আগে মেয়ের চলে যাওয়া মেনে নেয়াটা কষ্টের। দিতির আত্মা শান্তি পাক। ওর সন্তানদের শোক সইবার শক্তি দান করুন আল্লাহ।’দিতির স্মৃতিচারণ করে অভিনেতা আহমেদ শরীফ বলেন, ‘দিতির এভাবে নীরব হয়ে যাওয়াটা বেদনাদায়ক। ওর আরো অনেক কিছুই দেয়ার ছিলো। আমি দিতির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।’রুবেল বলেন, ‘আমি শুটিংয়ের জন্য পূবাইলে ছিলাম। যখন ফোন পেলাম যে দিতি নেই আমি হতবাক হয়ে গেছি। দিতি এদেশের চলচ্চিত্রকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমরা তাকে সে তুলনায় কিছুই দিতে পারিনি। তার এই অকাল প্রয়াণ আমাদের দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়ে গেছে। দিতির সন্তানদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে।’পরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘দিতি আমাদের একজনই। তিনি ছিলেন, বেঁচে রইবেন চিরদিন তার হাসিতে, অভিনয়ে, ভালো মানুষিতে। আমরা তাকে হারিয়ে যেতে দেব না।’তিনি আরো বলেন, ‘দিতি খুব বড় মনের মানুষ ছিলেন। সুযোগ পেলেই মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। অনেককেই তিনি সাহায্য করেছেন। তবু যদি কারো কাছ থেকে ধার-দেনা করে থাকেন তবে আপনারা অভিনেতা আলমগীর সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি আপনাদের পাওনা পরিশোধ করে দিবেন। আর যদি কারো কাছে দিতির পাওনা থাকে তবে নিজ দায়িত্বে সেগুলো শোধ করে দিবেন।’দিতির অকাল প্রয়াণে বাকরুদ্ধ ওমর সানী। তিনি বললেন, ‘এটা খুবই বেদনার, দিতিকে বিদায় জানাতে আসা। দুনিয়ার সব ফুল দিয়েও তাকে শুভেচ্ছা জানানোর শেষ হবে না। সে আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবে নন্দিত অভিনেত্রী হয়ে।’সবার উদ্দশ্যে দিতির মেয়ে লামিয়া চৌধুরী বলেন, ‘আমার মা নিজের পরিবারের চাইতে বেশি ভালবাসতেন চলচ্চিত্র এবং অভিনয়। সবসময় তিনি কাজে ডুবে থাকতেন। নিজের প্রতিও খেয়াল করতেন না। ভেতরে ভেতরে এতবড় একটা অসুখ নিয়ে তিনি এমনভাবে কাজ করে গেছেন নিজেও বুঝতে পারেননি তিনি ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছেন। এই কাজ পাগল, অভিনয় পাগল দিতিকে আপনারা মনে রাখবেন। নিজের চাইতেও আপন ভাবতেন চলচ্চিত্রের মানুষদের। আপনারা সবাই আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন।’সবকিছুরই শেষ আছে। দিতিকে চলে যেতে হবে অনেক দূরে। তার শুভ যাত্রা কামনায় ১০টা ১৫ মিনিটে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জানাজা। জানাজা শেষে দিতির মরদেহ নিয়ে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স রওনা দেয় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের দপ্তপাড়া গ্রামের পথে; যেখানে দিতির জন্ম। সেখানেই শেষ শয্যায় সমাহিত হবেন তিনি। তার আগে জোহর নামাজের পর অনুষ্ঠিত হবে দিতির তৃতীয় জানাজা।দিতিকে নিয়ে চলে গেল অ্যাম্বুলেন্স। স্মৃতির হাজার কবিতা বুকে নিয়ে পড়ে রইল দিতির প্রিয় আঙ্গিনা এফডিসি। নির্বাক হয়ে পড়ে রইল তার প্রিয় মানুষেরা। চম্পা, ববিতা, আলমগীর, দিলারা, খালেদা আক্তার কল্পনা, মিজু আহমেদ, আহমেদ শরীফ, রুবেল, ওমর সানীরা দিতির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বুঝি বলছিলেন- বিদায় দিতি। আর কোনোদিন দেখা হবে না, কথা হবে না। অদেখা ভুবনে ভালো থেকো তুমি।দিতির মৃত্যুতে শোকাছন্ন সহকর্মীরা, সব ছবি দেখুন...এলএ

Advertisement