মতামত

শেখ রাসেলকে কেন এত ভয় খুনিদের?

বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল তারা নানা পরিচয়ের, নানা আদর্শের, নানা উদ্দেশ্যের। এক শ্রেণি ছিল দেশদ্রোহী যারা দেশকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে চেয়েছিল। এক শ্রেণি ছিল পাকিস্তানের বর্ণচোরা দোসর যারা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। আর এক শ্রেণি ছিল ক্ষমতালোভী যারা পেছনের দরজা দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে চেয়েছিল।

Advertisement

তাছাড়া যুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান এবং নীতিতে পরাজিত আমেরিকাও নানাভাবে খুনিদের আশ্রয়, প্রশ্রয়, সহায় ও শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে এই সমন্বিত অপশক্তির অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক, বৈশ্বিক অপরাজনৈতিক সমীকরণ যেমন ছিল ঠিক তেমন ছিল পরাজয়ের প্রতিশোধলিপ্সা।

কিন্তু এগারো বছরের একটি শিশু কীভাবে এ সকল কূট-সমীকরণ ও হত্যালিপ্সার মধ্যে পড়লো? শেখ রাসেলকে কেন সেদিন হত্যা করা হলো? সেই ছোট্ট শিশুটিও কি তাহলে খুনিদের হৃদয়ে পরিণামভীতি সঞ্চার করেছিল? ইংরেজিতে একটি লোকোক্তি আছে—Morning Shows the day; শেখ রাসেলের ক্ষেত্রে কি কথাটি সমূহ প্রযোজ্য? শিশুকালেই কি তার মধ্যে ফুটে উঠেছিল দ্বিতীয় মুজিব হওয়ার সব সম্ভাবনাগুলো? বেঁচে থাকলে আজ শেখ রাসেল কী হতেন, কী করতেন, বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতেন এমন হাজারো হৃদয়কল্প আমাদের মানসপটে তাকে এক পরিপূর্ণ মানুষের রূপ দিয়েছে; একজন সফল মানুষ, একজন সফল নেতা; যিনি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বকে কাঁপাতে পারতেন পিতার মতো করেই।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট শেখ রাসেলকে হত্যা না করার চিন্তা খুনিদের মস্তিষ্কে এক মুহূর্তের জন্যেও আসেনি। কারণ রাসেল বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার। বঙ্গবন্ধুর রক্ত কতটা তেজস্বী তা খুনিরা খুব ভালো করেই জানত। মানুষের জন্য অধিকারসচেতনতা এবং স্বাধীনতাবোধ বঙ্গবন্ধুর মধ্যে কিশোরকাল থেকেই যেমন জাগ্রত হয়েছিল, বাবার মতো রাসেলের মধ্যেও ঠিক তেমনি অবচেতনভাবে জাগ্রত হয়েছে শৈশবকালে। কারাগারের রোজনামচা বইয়ের ২৪৬ পাতায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে, ‘ছয় দফা মানতে হবে—সংগ্রাম, সংগ্রাম—চলবে চলবে—পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ভাঙা ভাঙা করে বলে, কী মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও শিখলো কোথা থেকে?’ রেণু বলল, ‘বাসায় সভা হয়েছে, তখন কর্মীরা বলেছিল তাই শিখেছে'।”

Advertisement

বিষয়টিকে সাদাচোখে শিশুদের অনুকরণপ্রিয়তা বা স্বভাব হিসেবে না দেখে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে এবং মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। কেননা আর দশটা শিশুর মতো শুধু মা-ভাই-বোনের সান্নিধ্য আর খেলাধুলার সামগ্রীর মধ্যে নিমগ্ন ছিল না রাসেলের চৈতন্য; বরং শৈশবেই তার ভালো লাগার তালিকার মধ্যে ছিল আন্দোলন-সংগ্রাম-মিছিল-মিটিং। তাইতো সে কখনো মায়ের কোলে বসে, কখনো নরম তুলতুলে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বারান্দার গ্রিল ধরে গভীর মনোযোগ সহকারে দেখেছে সেইসব দিনের সভাগুলো; আত্মস্থ করেছে মুক্তিপাগল বাঙালির দাবিগুলো।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ভূমিকা অত্যন্ত নেতিবাচক। সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত হয়েও সে বলেছিল, “জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতাই বড় কথা নয়।” নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরেও বঙ্গবন্ধু যাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে না পারে সে জন্য ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে মিলে সকল ধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল এই ভুট্টো।

১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরার একদিন পরেই চলে যান ভুট্টোর বাগানবাড়ি লারকানায়। সেখানে মূলত তারা হাঁস শিকারের আড়ালে পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ে ভয়াবহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; সেটা হলো গণহত্যা; অপারেশন সার্চলাইট! তবে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত পরাজয়ের পরেও থেমে থাকেনি ভুট্টো। কমনওয়েলথে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির বিরোধিতাসহ বহুমাত্রিক ও বহুপাক্ষিক ষড়যন্ত্রের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সে।

‘ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো। বাংলাদেশ স্বাধীন করো-ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’—স্লোগানটি মুক্তিযুদ্ধকালে ছয় বছরের শিশু রাসেলেরও প্রতিবাদের ভাষা ছিল। সেসময় মুক্তিপাগল বাঙালির ভুট্টোবিরোধী এসব স্লোগান এবং বাড়িতে মা-ভাই-বোন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আলোচনা শুনে রাসেল নিজের মনের মধ্যে অদেখা ভুট্টোর একটি অবয়ব চিত্রায়ণ করে নিয়েছিল। একদিন যে বড়ো কালো পিঁপড়াটা তার আঙুল কামড়ে রক্তাক্ত করেছিল, সেই পিঁপড়ার নামকরণ সে করলো—‘ভুট্টো’। একটা ছোট্ট শিশুর মানসে ওলা (বড়ো কালো পিঁপড়া) কীভাবে ‘ভুট্টো’ (জুলফিকার আলী ভুট্টো) হিসেবে অবিহিত হলো তা আসলেই গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এত ছোটো বয়সে এমন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞার উত্তরাধিকার বলেই সম্ভব। বলা যায়, শেখ রাসেলের Sense of Symbolism যেমন অসাধারণ ছিল ঠিক তেমনই অসাধারণ ছিল তার শত্রু চেনার সক্ষমতা। তাই হয়তো শত্রুরাও তাকে চিনে ফেলেছিল; তারা বুঝে গিয়েছিল—রাসেল বেঁচে থাকলে পিতৃহন্তারকদের রেহাই নেই।

Advertisement

 

খুব সন্তর্পণে কান পাতলে শোনা যায় সেই রক্তাক্ত সিঁড়িগুলোর আর্তনাদ, যারা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ভার বহন করতে করতে আজ বড়োই ক্লান্ত। বেগম মুজিবের শুভ্র শাড়ি ও পানের বাটা এই ছায়া সুনিবিড় বাড়িটিকে আজও আগলে রেখেছে পরম মমতায়। ছোট্ট রাসেলের কালো কোট, ছাই রঙের জামা, জুতো জোড়া, খেলার ডিউস বল সবই যেন এখনও তার জন্য রয়েছে অনন্ত অপেক্ষায়। শেখ কামালের পিয়ানো, সেতারা আজও সুর খুঁজে বেড়ায় এই লাল-সবুজের বাংলাদেশে।

 

বিশ্ব কাঁপানো রাজনৈতিক উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যেই শেখ রাসেল বেড়ে উঠেছে; খুব কাছ থেকে রচিত হতে দেখেছে তার বাবা ও পরিবারকে কেন্দ্র করে যূথবদ্ধ এক সংগ্রাম উপ্যাখ্যান; দেখেছে ৩২ নম্বর বাড়িতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী থেকে শুরু করে এদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজারো মানুষের নিত্যনিয়ত পদচারণা। এ সময় সে মুক্তপ্রাণ জনধ্বনি যেমন শুনেছে ঠিক তেমন শুনেছে স্বজনহারা-সর্বহারা প্রান্তজনদের বোবাকান্না।

সর্বোপরি, বাংলার মানুষের নিত্যকার জীবনালেখ্য শেখ রাসেলকে বিনির্মাণ করেছে এক মানবিক জাতিপুত্র হিসেবে। বড়ো বোন শেখ হাসিনার স্মৃতিমন্থন থেকে বহুকৌণিক এক রাসেলকে জানা যায়। রান্নাঘরে বাবুর্চি, দারোয়ান, কাজের বুয়াদের সঙ্গে পিঁড়িতে বসে লাল ফুল আঁকা টিনের থালায় ভাত খাওয়া; স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে নিজের টিফিন ভাগ করে নেওয়া; টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, খেলাধুলা, তাদেরকে আপ্যায়ন করা, জামা-কাপড় উপহার দেওয়া, খেলনা বন্ধুক নিয়ে তাদেরকে প্যারেড করানো এসব কিছুর মধ্যে রাসেলের মানবিকতা, ভ্রাতৃত্ব ও নেতৃত্বের পুষ্পিত সৌরভ পাওয়া যায়। আমরা সবাই জানি শান্তির প্রতীক হচ্ছে শ্বেত কপোত বা পায়রা। কিন্তু আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় পায়রার মধ্যে শান্তির সেই ছায়া দেখতে প্রায়শই অক্ষম; তবে শেখ রাসেল হয়তো দেখতে পেত; তাইতো সে কখনো কবুতরের মাংস খেতে চাইতো না।

প্রান্তজনের প্রতি মমতা ও শ্রদ্ধা, প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি তার এ দরদ যে বার্তা দেয়, তা হলো—শেখ রাসেল ভবিষ্যতের একজন আলোকিত মানুষ; যিনি আলো ছড়াবেন ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি প্রান্তরে, আলো দেখাবেন প্রত্যেক বাঙালিকে; গৌতম বুদ্ধের জীবনকথায় উদ্বুদ্ধ শিশুটি সর্বমঙ্গলের বার্তা নিয়ে আলোকিত করবেন পৃথিবীকে। কিন্তু সব সম্ভাবনা ও স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল দেশদ্রোহীদের বুলেটে। বঙ্গবন্ধুর নীতির উত্তরাধিকারী শেখ রাসেলকে সেদিন ঘৃণ্য ঘাতকরা হত্যা করেছিল মূলত বঙ্গবন্ধুর নীতিকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে।

শেখ রাসেলের ব্যক্তিত্ব ও ব্যবহারের মধ্যে দ্বিতীয় মুজিব হয়ে ওঠার সকল সূচক পাওয়া যায়। বাবার সঙ্গে দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রাচার মেনে চলার ক্ষেত্রে তার আত্মসচেতনতাবোধ নিজের বয়সকে অতিক্রম করে গেছে। বাবার সঙ্গে জাপান সফর, সমুদ্রে বাংলাদেশ নেভির জাহান কমিশন অনুষ্ঠানসহ সবখানে কোনো শিশুতোষ আচরণ নয়; বরং আয়োজিত অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তুর প্রতি নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ এবং বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে সাদৃশ্য বজায় রেখে নিজেকে উপস্থাপনের মাধ্যমে শেখ রাসেল সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো।

তবে সকল শুভদৃষ্টির মাঝে শত্রুদের কুদৃষ্টিও পড়েছিল বাংলার এই দ্বিতীয় মুজিবের ওপর; কারণ ঘাতকরা ছদ্মবেশে বঙ্গবন্ধুর আশেপাশেই ছিল। তারা শিশু রাসেলের মধ্যে ভবিষ্যতের দ্বিতীয় মুজিবকে দেখতে পেয়েছিল; আর সেটাই ছিল তাদের বড়ো ভীতির কারণ। অতঃপর ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কালভোরে ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে বাবা-মা-ভাই-ভাবি ও স্বজনদের সঙ্গে প্রাণ হারাল আমাদের শেখ রাসেল।

আজও ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে গেলে হৃদয় জুড়ে চেপে বসে এক বিষাদের পাহাড়। বঙ্গবন্ধু পরিবারবিহীন বাড়িটিতে জুড়ে থাকা মহাজাগতিক শূন্যতায় শরীরে সবটুকু রক্ত শীতল হয়ে আসে। তবে সেখানে এখনও প্রতীয়মান হয় বঙ্গবন্ধুর সাদামাটা জীবনযাপনের এক চিরকালীন চিত্র। অনাড়ম্বর চেয়ার, স্যান্ডেল, বাসনপত্র সবকিছু একজন রাষ্ট্রপতির নয় বরং একজন দুখী বাঙালির সংগ্রামী নেতার কথা বলে।

খুব সন্তর্পণে কান পাতলে শোনা যায় সেই রক্তাক্ত সিঁড়িগুলোর আর্তনাদ, যারা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ভার বহন করতে করতে আজ বড়োই ক্লান্ত। বেগম মুজিবের শুভ্র শাড়ি ও পানের বাটা এই ছায়া সুনিবিড় বাড়িটিকে আজও আগলে রেখেছে পরম মমতায়। ছোট্ট রাসেলের কালো কোট, ছাই রঙের জামা, জুতো জোড়া, খেলার ডিউস বল সবই যেন এখনও তার জন্য রয়েছে অনন্ত অপেক্ষায়। শেখ কামালের পিয়ানো, সেতারা আজও সুর খুঁজে বেড়ায় এই লাল-সবুজের বাংলাদেশে। আর তাঁর নবপরিণীতা বঁধূ, ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র সুলতানা কামালের হাতের মেহেদির গন্ধ যেন মৌ মৌ করছে শেখ কামালের ঘর জুড়ে। কাচের ভেতরে পরম যতনে গুছিয়ে রাখা শেখ জামালের সেনা পোশাক, সে যেন বিপ্লবী বাংলার বিপ্লবী পতাকা।

কাঁচের আলমারিতে সাজানো পারভীন জামাল রোজীর শাড়ির লাল রং আমাদের হৃদয়ক্ষরিত রক্তের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। আজও সেখানে প্রতিটি ভোর, প্রতিটি দিন, প্রতিটি বিকেলে পাখিরা যে সুরে ডাকে, সে সুরে স্বজন হারানোর বেদনা ফুটে ওঠে।

লেখক : কলামিস্ট, বিশ্লেষক।

এইচআর/জিকেএস