> ইলিশের উৎপাদন নির্ভর করে বৃষ্টিপাত, পানির অবস্থা, প্রবাহ, তাপমাত্রা, এমনকি পূর্ণিমা আর অমাবস্যার ওপর। > বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ।> জাটকা নিধন বন্ধ, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার বন্ধে অভিযান, প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা জারি, জেলেদের প্রণোদনা দেওয়ায় বেড়েছে উৎপাদন।> আমরা এখন ৬ লাখ মেট্রিক টন পর্যন্ত মাছ ধরতে পারি।
Advertisement
ভরা মৌসুম। ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসার কথা। কিন্তু কোনো কোনো জেলায় ভরা মৌসুমেও আশানুরূপ ইলিশ মিলছে না। সুস্বাদু এই মাছের উৎপাদন নির্ভর করে বৃষ্টিপাত, পানির অবস্থা, প্রবাহ, তাপমাত্রা, এমনকি পূর্ণিমা ও অমাবস্যার ওপর। এসব উপাদানের ছন্দপতন ঘটলেই বিপত্তি। তবে এবার দেরিতে হলেও আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন গবেষকসহ সংশ্লিষ্টরা।
ভরা মৌসুমে ইলিশ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকটা নিষেধাজ্ঞার সুফল বলা যায়। কিন্তু মিরসরাইয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র। এখানে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ মিলছে না।
অন্যদিকে, পটুয়াখালীতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাচ্ছেন জেলেরা। দীর্ঘদিন পর ইলিশের দেখা পেয়ে খুশি জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
Advertisement
জেলার আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছ বিক্রি করতে আসা মাঝি বেল্লাল বলেন, ১০ দিন আগে সাগরে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। প্রথম চারদিন জাল টেনে কোনো মাছ পাইনি। পরে অল্প অল্প করে মাছ পেতে থাকি। মোটামুটি ভালো মাছ পেয়েছি, যা গত এক বছরেও পাইনি। যে মাছ পেয়েছি সবমিলে দাম হবে ১০ লাখ টাকার ওপরে।
আরও পড়ুন> মাইকিং করে ৫০০ টাকায় এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি
দেশের মৎস্যখাতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে ইলিশ। উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ইলিশ। তাদের নিরলস পরিশ্রমে ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা সরকারের বিশেষ নজরে বেড়েছে ইলিশের উৎপাদন। জাটকা নিধন বন্ধ, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার বন্ধে অভিযান, প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা জারি, জেলেদের প্রণোদনাসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে বেড়েছে উৎপাদন। গত এক যুগে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন লাখ টন। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, বর্তমানে ইলিশের সর্বোচ্চ সহনশীল উৎপাদন ৭ দশমিক শূন্য দুই লাখ মেট্রিক টন। তবে প্রাকৃতিক এই সম্পদের উৎপাদন যেহেতু অনেকগুলো নিয়ামকের ওপর নির্ভরশীল, সে কারণে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা একটি জটিল বিষয়।
Advertisement
মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, দেরিতে ইলিশ পাওয়ার বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টির সময়ও পরিবর্তন হয়েছে। সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়ায়, উপকূলীয় নদ-নদীর পানির লবণাক্ততা কমছে না। ফলে লবণাক্ততা না কমায় দেরিতে প্রবেশ করছে মা-ইলিশ। যেখানে ইলিশ মূলত ডিম ছাড়ার জন্য মোহনা থেকে মিঠা পানির নদ-নদীতে প্রবেশ করে। এছাড়া বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে নদীতে জোয়ারের পানি বাড়তে থাকে। পানি যত বাড়ে নদীতে ইলিশের আধিক্যও দেখা যায়। এবছর বৃষ্টি দেরিতে হওয়ায় ইলিশ দেরিতে নদ-নদীতে প্রবেশ করছে। সম্প্রতি নদীতে যেসব ইলিশ ধরা পড়ছে সেসবের ডিমের পরিপক্বতা এখনো আসেনি। অর্থাৎ ইলিশের ডিমের পরিপক্বতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীতে ইলিশ প্রবেশের হারও বৃদ্ধি পাবে।
মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, সারাবছরই কম বেশি নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়, বিশেষ করে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) সব থেকে বেশি ইলিশ পাওয়া যায়। বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে শীতকালের প্রথম পর্যন্ত নদ-নদীতে ইলিশের আধিক্য থাকে। তবে উপকূলের জেলেরা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এই তিন মাস ইলিশের মৌসুম হিসাব করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, ইলিশের যে প্রাপ্যতা সেটির সঙ্গে বৃষ্টিপাত ও পানিপ্রবাহের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কখনো কখনো বৃষ্টি মৌসুম শুরুর একটু আগে হয়, আবার কখনো পরে হয়। অনেক সময় বৃষ্টি খুব কম হয়, আবার অনেক সময় বেশিও হয়। এ কারণে ইলিশের মৌসুম ক্রমশ একটু আগে পিছে হতে পারে। তবে ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ নানাবিধ দূষণ উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের ক্ষতি করছে। ফলে ইলিশ মাছের ওপর স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে ইলিশের প্রজননে।
আরও পড়ুন> চাঁদপুর ঘাটে আসছে মণে মণে ইলিশ, দাম নিয়ে হতাশ ক্রেতারা
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, জুলাই ইলিশের মূল মৌসুম নয়, মূলত মৌসুম সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। তবে আগস্ট থেকেই সেটি শুরু হয়। কখনো বৃষ্টি আগে হওয়ার কারণে কিছুটা ব্যতিক্রম হতে পারে। আগস্টে কিন্তু কোনো কোনো অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে। সেখানে ২ আগস্ট একটি পূর্ণিমা গেছে এবং ১৬ তারিখ একটি অমাবস্যা গেছে। এর আগে বা পরে কাছাকাছি সময়ে খুব ভালো পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়েছে। আগস্টে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, সেই অবস্থা সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর পর্যন্ত থাকবে। তবে এটি কোনো কোনো সময় নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে যায়। আবার কোনো কোনো সময় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই শীত পড়া শুরু হয়। ফলে নদী শান্ত হয়; ইলিশের দেখা মেলে না।
তিনি বলেন, সর্বশেষ যে প্রজনন সময়টা গেছে তখন রেকর্ড পরিমাণ ৫২ শতাংশ মা-ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছিল। ফলে ৪০ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ইলিশ এবার আগস্ট থেকে পাওয়া গেলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের পরও নভেম্বরের প্রথমদিকে ভালোভাবেই পাওয়া যাবে। এছাড়া নভেম্বরের মাঝামাঝি একটা অমাবস্যা আছে, তখন কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, কিছু কমে ফেব্রুয়ারি থেকে আবার মাছ আসবে। মার্চ-এপ্রিল ইলিশের দ্বিতীয় প্রজনন মৌসুম, যেটি আমরা গবেষণা করে বের করেছিলাম।
আরও পড়ুন> মণে মণে ইলিশ নিয়ে তীরে ফিরছেন জেলেরা
ইলিশ পেতে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক বলেন, উজানের পানির প্রেসার যতো কম হবে, ততো লেট হবে। টেম্পারেচার একটা ফ্যাক্টর। আরেকটা বিষয় থাকে সমুদ্র যখন উত্তাল থাকে ইলিশ এক আচরণ করে, আবার যদি শান্ত হয় তখন আরেক রকম। পানির কোয়ালিটির ওপর নির্ভর করতে পারে। বৃষ্টি কম হলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি থেকে যে পল্যুউশন যায় সেটির চাপ বেশি থাকে। তিনি জানান, সামনে ২২ দিন মা-ইলিশ সংরক্ষণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে, তখন কারিগরি কমিটির সভা হবে। সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আমরা আলোচনা করবো বিষয়গুলো নিয়ে।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে তিনি বলেন, এর আগে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, আমরা ইলিশের যে পরিমাণ জাটকা পেয়েছি, সেটি হিসাব করলে গত বছরের তুলনায় উৎপাদন বাড়বে। আমরা এখন ৬ লাখ মেট্রিক টন পর্যন্ত মাছ ধরতে পারি। গত বছর এটা হয়নি। আমরা এখনো ভালো অবস্থানে আছি। ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে, এটা কমবে না।
আইএইচআর/এসএনআর/জেআইএম