মো. লুৎফুর রহমান ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বনগাঁও-দুই গ্রামে তার জন্ম। বাবা মো. আব্দুর রহমান ছিলেন প্রবাসী, মা রিনা বেগম গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। লংলা আধুনিক কলেজ থেকে এইচএসসি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন।
Advertisement
চাকরিজীবন শুরু হয় পূর্বভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘সহকারী শিক্ষক’ হিসেবে। সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুর আবেদীন শান্ত—
জাগো নিউজ: বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার অনুভূতি কেমন?মো. লুৎফুর রহমান: সারাদিন রেজাল্টের অপেক্ষায় ছিলাম। বিপিএসসির ওয়েবসাইট বার বার চেক করছিলাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় যখন রেজাল্ট পাবলিশ হয়; তখন মায়ের সামনে বসে ছিলাম। রেজাল্ট শিটে রোল খুঁজে পাওয়ার পর কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলাম, ঠিক দেখলাম কি না। চোখ খুলে আবার চেক করলাম; দেখলাম সত্যি আমার রোল। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে রেজাল্ট জানালাম। মা কান্না শুরু করে দিলেন। বললেন, এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে? আমার মা প্যারালাইজড। ২০১৯ সালে স্ট্রোক করার পর থেকে ঠিকঠাক চলাফেরা করতে পারেন না। তার মুখের এ হাসির জন্য হলেও এমন সাফল্য দরকার ছিল। ভীষণ ভীষণ ভালো লাগছে।
আরও পড়ুন: বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে ষষ্ঠ তন্ময়
Advertisement
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল?মো. লুৎফুর রহমান: প্রতিবন্ধকতা ছিল পাহাড় সমান। প্রথমত গ্রামের একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দিই। সে সময়ে দাখিল পরীক্ষায় ইংরেজি এক পেপারে ১০০ নাম্বারের ছিল। যেখানে স্কুলে ছিল ২০০ নাম্বার। আমি তখন স্কুলের ২য় পত্র বই সংগ্রহ করে পড়তাম, যাতে গ্রামার ভালো বুঝতে পারি। দ্বিতীয়ত এইচএসসি পাস করি গ্রামেরই একটি কলেজ থেকে। মাদ্রাসা থেকে পাস করে আসার কারণে কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভালো ফলাফল করা আমার জন্য ছিল চ্যালেঞ্জিং। তাতে ভালোভাবেই উতরে যাই কঠোর অধ্যয়নের মাধ্যমে। তৃতীয়ত অনার্স ফাইনালের ঠিক আগ মুহূর্তে আমার মা স্ট্রোক করেন। প্রায় ১৫ দিন আইসিইউ ও ২ মাস হাসপাতালের বেডে অচেতন ছিলেন। সপ্তাহে দু’একবার সিলেট-চট্টগ্রাম যাওয়া-আসা করতে হতো। সেই প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বিসিএসের প্রিপারেশন শুরু করি। সেখানেও সময়ের সঠিক ব্যবহার আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি রেজাটের পর বিসিএস রিটেনের পূর্বে আমার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়। তারপর থিসিস, ডিফেন্স ইত্যাদিও ছিল। সবগুলো কাজের মধ্যে ব্যালেন্স রাখাটা কঠিন ছিল। আল্লাহর রহমতে মা-বাবার দোয়ায় সবগুলো কাজই সফলভাবে শেষ করি।
জাগো নিউজ: কার অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি ছিল?মো. লুৎফুর রহমান: আমি সব সময়ই মা-বাবাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিই। কারণ সব সময়ই ভাবতাম, সরকারি প্রথম শ্রেণির একটি চাকরি থাকলে মা-বাবাকে সঠিক সেবা-যত্ন করতে পারবো। এ জায়গায় আমার বাবা অনেক বড় ভূমিকা পালন করেন। বাবা ছিলেন প্রবাসী। মায়ের স্ট্রোকের পর বাড়ি চলে আসেন। মায়ের চিকিৎসা ও আমার লেখাপড়ার খরচ জোগাতে জমি বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা করেন। আমার ভাই, চাচারাও তখন আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। তাদের সবার হাসিমুখই আমার সব প্রেরণার উৎস।
আরও পড়ুন: টেক্সটাইলে পড়ে পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডার জিসান
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কবে থেকে?মো. লুৎফুর রহমান: ক্যারিয়ার গঠনের প্রারম্ভিক চিন্তা-ভাবনায় বিসিএস ছিল না। ভাবতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষে একটি ভালো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ঢুকে যাবো। কিন্তু আমার যে বন্ধুরা ছিল তাদের মধ্যে বিসিএসের আগ্রহ দেখে বিসিএস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি। পরে বিসিএসই হয়ে ওঠে ভরসার জায়গা।কারণ কৌশলগতভাবে আগাতে পারলে আর সে অনুযায়ী পরিকল্পনা ও অধ্যয়ন করলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়।
Advertisement
জাগো নিউজ: বিসিএস জয়ের গল্প শুনতে চাই—মো. লুৎফুর রহমান: ৪১তম বিসিএস ছিল আমার প্রথম বিসিএস। ২০১৯ সালের প্রথমদিকে বিসিএসের জন্য প্রিপারেশন শুরু করি। ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা যেদিন হয়, তার আগের দিন আমাদের মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল। ভাগ্যের জোরে সেই পরীক্ষা প্রায় বিশ দিন আগে স্থগিত হয়ে যায়। ফলে বিসিএসের প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করি। রিটেনের প্রতিবন্ধকতা পাশ কাটিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী রিটেনের প্রস্তুতি নিতে থাকি। সে সময় শীতকাল ছিল। আমার পড়ার টেবিল ছিল জানালার সামনে। সকাল ও বিকেলে রোজ দুইবার জানালা দিয়ে দেখতাম পাশের বাসার ছাদে অনেকে রোদ পোহাতো। মনে মনে ভাবতাম এই স্বর্ণালি রোদ গায়ে মাখানো বাদ দিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে টেবিলে বসে আছি; নিশ্চয়ই আল্লাহ নিরাশ করবেন না। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে জয়েন করি। এর ফাঁকে ফাঁকে ব্যাংক, অন্যান্য চাকরির পরীক্ষা ও ভাইভার প্রস্তুতি নিতে থাকি। কাকতালীয়ভাবে ১৯ মে সিলেটে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি ও ২১ মে ৪১তম বিসিএসের ভাইভার তারিখ পড়ে যায়। বিসিএসের দুই পরীক্ষা কাছাকাছি থাকায় দুই পরীক্ষার প্রস্তুতি ছিল চ্যালেঞ্জিং। তবে সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুটোতেই সফল হই।
আরও পড়ুন: প্রথম বিসিএসেই কাস্টমস অ্যান্ড এক্সসাইজে প্রথম সাব্বির
জাগো নিউজ: কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন?মো. লুৎফুর রহমান: আমি মনে করি, বিসিএস ক্যাডার হতে জানার থেকে কৌশলগতভাবে আগানোটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই পরিকল্পনা মাফিক পড়তে হবে। কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পড়তে গিয়ে বেশি সময় নষ্ট করা যাবে না। আমি যখন পড়তাম, একটা কথাই মাথায় সব সময় ঘুরপাক খেতো। তা হলো—আমি যে টপিকের পেছনে সময় ব্যয় করছি তা বিসিএস রিটেনের জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা। বিসিএস রিটেনের সময় পরীক্ষার খাতায় লেখার ক্ষেত্রেও একই জিনিস মাথায় ছিল যে, আমি হয়তো অনেক কিছুই জানি কিন্তু আমাকে খাতায় লিখতে হবে প্রশ্নের আলোকে, যথাযথ ও সংক্ষিপ্তভাবে। ভাইভার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, নিজ বিষয়, নিজ এলাকা, সমসাময়িক বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?মো. লুৎফুর রহমান: প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরির স্বপ্নপূরণ হয়েছে। আল্লাহর প্রতি কোটি কোটি শুকরিয়া। ব্ঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দারিদ্র্যমুক্ত সুখী, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার। বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্ঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের রূপরেখা হিসেবে ভিশন-২০৪১ ঘোষণা করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ সুখী সোনার বাংলা হবে; যেখানে দরিদ্রতা হবে সুদূর অতীতের ঘটনা। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশের যে চারটি পিলার রয়েছে; তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো স্মার্ট সিটিজেন। আর স্মার্ট সিটিজেন গড়তে ও মানুষকে সম্পদে রূপান্তর করতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর সেই সঙ্গে শিক্ষা সেক্টরে কাজ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ায় অবদান রাখতে চাই।
এসইউ/জিকেএস