মতামত

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোর দৃঢ় বন্ধনের এক নতুন দৃষ্টান্ত

বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন এক ইতিহাস গড়ে তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এবার এই অঞ্চলে সেই সম্পর্কের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কের এক নতুন দৃষ্টান্ত হতে চলেছে বাংলাদেশ-ভারত-নেপালের মধ্যে শক্তি বন্টন চুক্তি। যুগান্তকারী এই জ্বালানী জোট শিগগিরই বদলে দিতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির প্রেক্ষাপট।

Advertisement

সম্প্রতি ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে সম্পাদিত একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির বদৌলতে নবদিগন্তের হাতছানি দেখা যাচ্ছে এ অঞ্চলের শক্তির বিকাশে। চলতি বছরের জুনে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল ভারত সফরে গেলে স্বাক্ষরিত হয় চুক্তিটি, যা ভারতের শক্তিশালী ট্রান্সমিশন অবকাঠামোর মাধ্যমে নেপাল থেকে বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ প্রবাহের নতুন এক দ্বার উন্মোচিত করেছে।

এতে একদিকে যেমন জ্বালানী সংকটের কারণে বাংলাদেশের ফের ব্ল্যাকআউট হওয়ার শঙ্কা দূর হলো, অন্যদিকে ৯৭ শতাংশ জলবিদ্যুৎ উত্পাদনে সক্ষম নেপালের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ একটি কাঙ্খিত বাজারও খুঁজে পেলো। সেই সঙ্গে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট পরিবেশবান্ধব অজীবাশ্ম জ্বালানি সক্ষমতা অর্জনের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা সে যাত্রায় ভারত সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে।

প্রাথমিক তথ্যানুসারে, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে হাই-ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন লাইন বাংলাদেশের ভেড়ামারাকে সংযুক্ত করবে ভারতের বহরমপুরের সঙ্গে। ত্রিদেশীয় এ চুক্তির মাধ্যমে একটি আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বিনিময়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল। যার ফলে আঞ্চলিক শক্তির নিরাপত্তা আরও জোরদার হবে এই অঞ্চলে। তাই পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং প্রতিবেশী সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা যায় যৌথ এ উদ্যোগকে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং উচ্চতর সমৃদ্ধির জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিরামহীন আন্তঃসীমান্ত শক্তি সঞ্চালনের যুগের ইঙ্গিত দিচ্ছে এ উদ্যোগ।

Advertisement

চুক্তিটি ফলপ্রসূ হয়েছিল যখন নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল শেষবার ভারত সফর করেছিলেন চলতি বছরের জুনে। আর দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে শক্তি সংযোগ বাড়াতে ভারতীয় ট্রান্সমিশন লাইন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার জন্য নেপালের পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

বিশ্ব যখন জ্বালানি সংকটে ধুঁকছে, তার চাপ পড়েছে বাংলাদেশসহ অন্যান্য সকল দেশে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি সরবরাহ ও ডলার সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে গোটা বিশ্বে। গেলো বছর এবং চলতি বছর সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ লোডশেডিং দেখেছে বাংলাদেশ যা বিগত দশকে ভুলে বসেছিলাম আমরা। নেপাল বর্ষা মৌসুমে তার অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ উদ্বৃত্ত জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। তাই বাংলাদেশের কাছে তারা অতিরিক্ত এ বিদ্যুৎ বিক্রি করতে চাইছে। কিন্তু দুপক্ষের এ চাহিদা পূরণে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল দুদেশের মধ্যে গ্রিড সংযোগের অনুপস্থিতি।

উভয় দেশই এ সমস্যা সমাধানে তাই সহায়তা চেয়েছিল মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা ভারতের। আর দুটি দেশেরই ভালো বন্ধু ও প্রতিবেশী হিসেবে ওই প্রস্তাবে সম্মতও হয়েছে ভারত। বহরমপুর-ভেড়ামারা হাই ভোল্টেজ লাইন ব্যবহার করে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আন্তঃসহযোগিতামূলক এক চুক্তি সম্পাদন করেছে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি এবং ভারতের এনটিপিসি বিদ্যুৎ ব্যাপার নিগম (এনভিভিএন)।

ভেড়ামারায় বাংলাদেশের ওয়েস্টার্ণ বৈদ্যুতিক গ্রিডকে বহরমপুরে ভারতের পূর্ব গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করছে উচ্চ ভোল্টেজের এ ট্রান্সমিশন লাইনটি। ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি সম্পাদনের ফলে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে ১৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এ উচ্চ ভোল্টেজ লাইনের মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত হবে। এই লাইন ছাড়াও বাংলাদেশ এবং নেপাল ইতিমধ্যে ভারতের মধ্য দিয়ে আরও একটি ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপনের বিষয় বিবেচনা করছে, যা শুধুমাত্র নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিদ্যুৎ বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হবে।

Advertisement

 

ত্রিপক্ষীয় চুক্তি নিরবচ্ছিন্ন উপায়ে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের নতুন এক যুগের সূচনা করতে চলেছে, যা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করবে। সেই সঙ্গে সবার পারস্পরিক সুবিধার জন্য প্রতিবেশীদের মধ্যে সহযোগিতার প্রমাণ হিসাবে এই যৌথ উদ্যোগ সমগ্র অঞ্চলের জন্যই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

 

অপচয় রোধ করতে কিংবা নিদেনপক্ষে কমাতে নিজেদের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ স্থানান্তর করতে সক্ষম হওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল নেপালের জন্য। ২৬০০ মেগাওয়াটের মোট স্থাপিত ক্ষমতাসহ নেপাল তার ৯৭ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জলবিদ্যুতের মাধ্যমে। বর্তমানে নেপাল তার প্রায় ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারতে রফতানি করছে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নিজেদের জলবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে দেশটি।

এই বর্ধিত আউটপুট আর্দ্র মৌসুমে উদ্বৃত্ত শক্তিতে পরিণত হয় যা নেপালকে রফতানি করতে হবে এবং এর জন্য বাজারের সন্ধানে ছিল দেশটি। ইতিমধ্যে ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তির ফলে নেপাল কিছু অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রফতানি করতে চেয়েছিল। অন্যদিকে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি মেটাতে এবং দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ চাইছে বাংলাদেশও।

এছাড়া একটি নির্বিঘ্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য অদূর ভবিষ্যতে শক্তির প্রচলিত উৎস থেকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে ধাবিত হতে হবে বাংলাদেশকে। এটি কেবল দেশের শক্তি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নয়, দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্বের জন্যও প্রয়োজনীয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার হুমকির মুখে পড়েছে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো। এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ সংকট প্রশমনের নিমিত্তে আন্তঃসীমান্ত জ্বালানি সহযোগিতা এবং একটি পাওয়ার করিডোরের ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য।

এদিকে নেপাল যেহেতু একটি স্থলবেষ্টিত দেশ, তাই বাংলাদেশে তার উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ রফতানি করতে নেপালের পরিকল্পনার জন্য ভারতের সাহায্য ও সমর্থন প্রয়োজন। ছিলো। বাংলাদেশ-ভারত-নেপালের মধ্যকার এই ত্রিদেশীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ চ্যানেল প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষক ড. মাহিপ বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ও নেপাল ভারতের সহায়তায় আন্তঃসীমান্ত পাওয়ার ট্রান্সমিশন লিঙ্ক ব্যবহার করে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ভারতের সেন্ট্রাল ইলেক্ট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন (সিইআরসি) অনুসারে, ভারতের সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে এ আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ভারত নিজেই নবায়ণযোগ্য শক্তি উৎপাদনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একটি সবুজ ভারতে রূপান্তরিত হতে চাইছে। যার লক্ষ্য অজীবাশ্ম উৎস থেকে ৫০০ গিগাওয়াট উৎপাদন করা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করা। তাই ভারতেরও এই আন্তঃসীমান্ত চুক্তিতে দারুণ আগ্রহ আছে। কারণ বাংলাদেশের এ পাওয়ার করিডোর ব্যবহার করে তারাও নিজেদের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমাতে সক্ষম হবে।

আর বাংলাদেশ সরকার নিজেও ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৪০ শতাংশ শক্তি উৎপাদন করতে চাইছে, যেখানে এই মুহূর্তে আমাদের মাত্র তিন শতাংশ বিদ্যুৎ আসছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। আর এ কারণে নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের এই কার্যক্রমকে একেবারেই ভিন্ন এক স্থান থেকে দেখছেন বলে জানান তিনি।

এ ত্রিপক্ষীয় চুক্তি নিরবচ্ছিন্ন উপায়ে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের নতুন এক যুগের সূচনা করতে চলেছে, যা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করবে। সেই সঙ্গে সবার পারস্পরিক সুবিধার জন্য প্রতিবেশীদের মধ্যে সহযোগিতার প্রমাণ হিসাবে এই যৌথ উদ্যোগ সমগ্র অঞ্চলের জন্যই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

পরস্পরের মধ্যে শক্তি বণ্টনের এই কার্যক্রম ইউরোপীয় অঞ্চলে বেশ আগে থেকেই কার্যকর ছিলো। যার ফলশ্রুতিতে ফ্রান্স, নরওয়ে, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে পাওয়ার গ্রিড সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কিনে থাকে যুক্তরাজ্য। ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরাও।

এরই মধ্যে চাহিদা অনুসারে শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক ইন্সটিটিউট বা আইআরআইয়ের জরিপ অনুসারে, গত ৫ বছরে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্যের ৮৪ শতাংশ মানুষ প্রশংসা করেছেন। তারা মনে করেন, বিদ্যুতায়ণে ব্যাপক সাফল্য এনে দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার।

২০০৬ সালে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিলো ৩ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট যা বর্তমানে ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াট। তৎকালীন সময় দেশের ২৮ শতাংশ জনগণ ছিলো বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়, বর্তমানে এই সুবিধা রয়েছে দেশের শতভাগ এলাকায়। এমনকি দেশের বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল, দ্বীপ এবং পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর এই উদ্যোগ সম্প্রতি বছরগুলোতে হোঁচট খেয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে। এই অবস্থা থেকেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের শুরুতে দেশে যেই বিদ্যুৎ ঘাটতি তৈরি হয়েছিলো, সেখান থেকে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে ২০২৪ সাল থেকে বিকল্প উপায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতের জন্যও কাজ করে যাচ্ছি আমরা।

ধারণা করা হচ্ছে আগামী বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ আরও একবার শতভাগ বিদ্যুতায়নের পাশাপাশি শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দেশের কাতারে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের কাছে তাঁর অঙ্গীকার অনুসারে প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস