ফিচার

চাঁদের বুকে ভারত: আক্ষেপ ও প্রত্যাশা

 

মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ

Advertisement

স্যাটেলাইট পরিষেবা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান ও এই জাতীয় অন্যান্য কিছু সেবা, পরিষেবা ব্যতীত মহাকাশ গবেষণা মানুষের একটি উচ্চবিলাসী পরিকল্পনা। উন্নত রাষ্ট্রগুলোর জন্য এই ধরনের প্রকল্প দুধ ভাত হলেও দরিদ্র ও স্বল্প উন্নত দেশগুলোর জন্য এই খাতে অর্থ ব্যয় হচ্ছে ‘বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানো’র মতোই দুঃসাধ্য পরিকল্পনা ও অসাধ্য একটি কাজ। সম্প্রতি এই অসাধ্য কাজটি করেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। গতকাল তারা পৃথিবীর চতুর্থতম দেশ হিসেবে চাঁদের মাটিতে নিজেদের পতাকা উড়িয়েছে। এই নিয়ে আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ নিজ দেশের নানান অসংগতি ও অক্ষমতা নিয়ে বিপ্রতীপ মন্তব্য, ক্ষোভ ও হতাশার কথা প্রকাশ করছে প্রকাশ্যে বা সোশ্যাল মিডিয়ায়। কেউ কেউ অবশ্য প্রবল আশা নিয়ে ভবিষ্যতে চাঁদের বুকে একদিন লাল সবুজের পতাকাও উড়বে-এমন স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কথাও বলেছেন।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম-বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণার অক্ষমতা নিয়ে যারা অসন্তোষ প্রকাশ করছেন তাদের অনেককেই বিগত সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প যেমন: রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এবং কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সময় নানান ভাবে এগুলোর বিরোধিতা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করেছেন। এমনকি দেশে নির্মাণাধীন বড় বড় রাস্তা, ফ্লাইওভার এবং নানান ভবন নির্মাণ নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বা সরাসরি বিরোধিতার কথা নিজেদের ফেসবুক পোস্টসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংবাদমাধ্যম মাধ্যমের পোস্টের নিচেও তীর্যক মন্তব্য হর হামেশাই ঝুলিয়ে রেখেছেন।

আরও পড়ুন: বিতর্কচর্চা কর্মজীবনে এগিয়ে রাখবে 

Advertisement

চাঁদের বুকে পানি আছে কি না, সেখানে বসতি স্থাপন করা যাবে কি না- এই গবেষণা প্রকল্প আমাদের প্রত্যক্ষভাবে কোনো কাজে না লাগলেও প্রত্যক্ষভাবে যেসব প্রকল্প মানুষের উপকারে আসবে সেসব নিয়ে যারা বিরোধিতা করেছেন তারা এখন বড় গলায় বলছেন-কেন বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণার সক্ষমতা নাই। তাদের এই দ্বিচারিতার স্বভাবকে কি বলে বিচার করা যায় ভেবে পাই না। মেগা প্রকল্প মানে মেগা দুর্নীতি-বলে যারা তির্যক মন্তব্য করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাই, বাংলাদেশ যদি এই মহাকাশ মিশন পরিচালনা করতেন বা মহাকাশ গবেষণায় বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেই কেন বলে যারা এখন সমালোচনা করছেন তারা বাংলাদেশের চন্দ্রজয়ে এই বলে সমালোচনা করতেন যে এই প্রকল্পটি একটি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প যার কোনো দরকার ছিল না অথবা চন্দ্র অভিযানে বাংলাদেশ কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে বলে অভিযোগ তুলতেন। খুব বেশি দিনের কথা নয় ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ নিয়ে আপনাদের বিরোধিতা ও তীর্যক মন্তব্যগুলো এই কথাটির প্রমাণ বহন করে। দুর্নীতি হয় বলে উন্নয়ন করা যাবে না এই ভাবনার মানুষ সম্ভবত বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশে নাই। এটি ব্যথায় ওষুধ না খেয়ে মাথা কেটে ফেলার মতো একটি ভাবনা।

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান তথা বাংলা ভূখণ্ড একইসঙ্গে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কূটচালে পাকিস্তানের শোষণ নীতির কারণে বাংলাদেশ ভারত থেকে চব্বিশ বছর পিছিয়ে গেছে। আবার স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পরেও একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার অপ্রতুল ও কল্যাণমুখী, জনবান্ধব পরিকল্পনা এবং কর্মকাণ্ডের অভাবে বাংলাদেশ বিশ্ব থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। আমাদের অনেক পরে স্বাধীনতা অর্জন করেও পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র এখন উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আমাদের দেশের অতীত অনিয়ম, অন্যায়, দুর্নীতি ও দুর্ঘটনাগুলো না ঘটলে আমরা হয়তো এতদিনে আরও ভালো অবস্থানে থাকতাম। এত সমস্যার পরেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের এই মেগা প্রকল্পগুলো সফল বাস্তবায়ন ভারতের চাঁদে যাওয়ার থেকেও আমাদের কোনো অংশে কম বড় অর্জন নয়। এসব অর্জন নিয়ে যারা নিত্যই সমালোচনা করে বেড়ান, তাদের ভারতের চন্দ্র অভিযানের সফলতায় নিয়ে বাংলাদেশকে দোষারোপ করার কোনো অধিকার নেই। আমরা কি ভুলে গেছি বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সময় আপনারা কি ধরনের বিরোধিতা করেছিলেন বা এখনো ইনিয়ে বিনিয়ে বিরোধিতা করেন।

অনিয়ম, দুর্নীতি কম বা বেশি পৃথিবীর সব দেশে হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অসচেতনতা এবং একদল মানুষের বিরোধিতা সব দেশেই থাকে। এসবের মধ্যেই প্রত্যেকটি দেশ বৃহৎ স্বার্থের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। আমাদের দেশ হয়েছে উলটো স্বভাবের। এখানে কাজ না করলে এক ধরনের সমালোচনা আর কাজ করলে আরেক ধরনের সমালোচনা হয়। সংগত কারণেই আমাদের দেশের মানুষ হয়ত নতুন কিছু বা বড় কিছু করতে ভয় পায়।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ভালো বা মন্দ দুটোই আমাদের অজানা নয়। বহু জাতি, ধর্ম, বর্ণের মতপার্থক্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিহীনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকারি-কর্মচারীদের অন্যায়-অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘনবসতি ও অসচেতন এক বিরাট জনগোষ্ঠী নিয়ে ভারত একের পর এক মহাকাশ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী পাকিস্তান ও চীনের মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের সঙ্গে চরম বৈরিতা পূর্ণ সম্পর্ক ও অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উপস্থিতির মধ্যে সর্ব অবস্থায় যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভারত, বিজ্ঞানে যে অগ্রতে সাধন করেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। তারা এই কাজটি করতে পেরেছে এই জন্য যে, সেখানে দেশের জন্য চিন্তা সেখানে চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা রয়েছে। অর্থাৎ সেই দেশের যে মানুষটি যেই ধরনের চিন্তা বা কাজ করতে চায়, সে সেই রকম পরিবেশ ও সহযোগিতা পায়। কিন্তু আমাদের দেশ হচ্ছে উলটো। আমরা নিজেরা তো কাজ করবোই না, অন্যকেও নতুন কিছু, ব্যতিক্রম কিছু করতে উৎসাহ প্রদান করি না। কেউ একটু এগিয়ে গেলে আমাদের সহ্য হয় না। তাকে কীভাবে দমিয়ে রাখা যায়, থামিয়ে দেয়া যায়, সেই চেষ্টায় আমরা নিজেদের ঘুম হারাম করে ফেলি।

Advertisement

এছাড়াও ভারতীয় শিক্ষার্থীরা বিদ্যা অর্জনকে নিজেদের সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে নিলেও আমাদের শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা কেবল অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে নিয়েছে। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য এখানে কোনো প্রতিষ্ঠানে ভালো একটি চাকরি নিয়ে ভালো বেতনে আরাম-আয়েশের জীবন যাপন করা। দেশ সমাজ মানুষ ও মানবতার কল্যাণে আমাদের শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনা ও কর্মপরিকল্পনা নেই। দেশের এত এত নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিন্তু সেই তুলনায় আমাদের বিভিন্ন সেক্টরে গবেষক ও উদ্যমই ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা নিতান্তই কমই বা নাই বললেই চলে। আমাদের ছেলেমেয়েদের বিরাট একটি অংশ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। আমি রাজনীতির বিরোধী নই, তবে গণহারে দেশের সবাইকে রাজনৈতিক সচেতন না হয়ে, রাজনীতিবিদ হতে হবে কি না এই বিষয়টি অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি তথা টিকটক বা ইউটিউবের জন্য আনপ্রটেকটিভ কনটেন্ট নির্মাতাদের ভিড়ে জ্ঞানবিজ্ঞান বা শিল্প-সাহিত্যচর্চা করা ছেলেমেয়েদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। বিজ্ঞান গবেষণায় দেশ পিছিয়ে থাকার এটাও একটি বড় কারণ হতে পারে।

আরও পড়ুন: খাড়া পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত দোকান, ক্রেতা কারা? 

আরেকদল ছেলে মেয়ে আছে যারা ধর্মের মোড়কে নিজেদেরকে এমনভাবে আবদ্ধ করে রেখেছে যে, তাদের আর ওই খোলস থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। পৃথিবীর আর সকল কাজকর্ম তাদের কাছে অপার্থিব ও অপ্রয়োজনীয়। জীবনের শুরুতেই এই ক্ষণস্থায়ী জগতের সব মায়া ত্যাগ করে তারা এখন ইহকালমুখী। এদের কেউ কেউ আবার যথেষ্ট উগ্র স্বভাবের। ব্যক্তি জীবনে তারা কতটা ধর্মভীরু তা জানি না। তবে ফেসবুকে তাদের করা বিভিন্ন পোস্ট এবং তারা যে সমস্ত ধর্মীয় ব্যক্তির বিভিন্ন আলোচনা শেয়ার করে তা থেকে অনুমান করা যায় যে, তাদের ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতা খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। তাদের ধর্মচর্চা মূলত এক অন্ধ মোহ থেকে সৃষ্টি হয়। যাকে ধর্মান্ধতা বলা চলে। আমি মনে করি পৃথিবীর কোনো ধর্ম ইহজাগতিক বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে না বা বিজ্ঞান চর্চার পথকে বন্ধ করে না। এই বিষয়টি যারা না বোঝে না, তারা আর যাই হোক ধর্মের প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করেছেন বলে স্বীকার করা যায় না। মূলত যে ধর্ম বা যাদের ধর্মচর্চা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সফলতা বয়ে আনে তারাই প্রকৃত ধার্মিক। এই ধার্মিক জনগোষ্ঠী একটা রাষ্ট্রে জন্য যতটা কল্যাণকর এবং অত্যাবশ্যকীয়। একজন অধার্মিক এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কোনো রাষ্ট্রের জন্য ততটাই ক্ষতিকর এবং অনাকাক্সিক্ষত।

কোনো রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারতার পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধের যতটা জরুরি শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাটাও ঠিক ততটাই জরুরি। কেননা একজন লেখক বা শিল্পীর শিল্পকর্মের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা শক্তির উন্মেষ ঘটায়, বিবেকের দুয়ার খুলে দেয়। লেখালেখি বা যে কোনো শিল্পের শিল্পীদের শিল্পীত কর্মকাণ্ডই মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলে, মানুষের মাঝে দেশাত্মবোধ জায়গায়, মানবতা বোধ সৃষ্টি করে এবং সেইসঙ্গে মানুষকে একটি উন্নত জীবন প্রদানের জন্য বিজ্ঞান চার্চর প্রতি উৎসাহ তৈরি করে। কিন্তু বর্তমানে প্রজন্ম ও সমাজ শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাকে একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয় বলে মনে করে। আবার যারা শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করে তারাও এই শিল্পী কাজগুলোকে জনসাধারণের উপকারের মানসিকতা না নিয়ে নিজেদের আখের গোছানো বা জীবিকার মাধ্যমে হিসেবে নিয়েছে। ফলে এখনকার সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা ও মানুষের খুব বেশি উপকারে আসছে না।

সুতরাং একথা দীপ্ত কণ্ঠে বলা যায় যে, মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে নানান ধরনের সমস্যা আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও হয়ত থাকবে। এই সব সমস্যার মধ্যেই মানুষকে মানুষের জন্য নতুন করে ভাবতে হবে, কাজ করতে হবে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হলে কর্মমুখী শিক্ষা, সহনশীল ধর্মীয় মূল্যবোধ, জনবান্ধব সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, মানবকল্যাণমুখী জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে যদি আমরা এই মডেল এ তৈরি করে না যেতে পারি তাহলে আগামী ১০০ বছরে চাঁদে যাওয়া তো দূরের কথা, বাংলাদেশের মাটির বুকেও গর্ব করার মতো আমাদের কোনো কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। পরিশেষে চাঁদের বুক একদিন বাংলাদেশের পতাকায় শোভিত হবে এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।

লেখক: পরিচালক-ঝিলমিল একাডেমি, সম্পাদক-কিচিরমিচির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কেএসকে/জিকেএস