খরস্রোতা পদ্মা নদীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে একটি সেতু। বাংলাদেশের গর্ব, চ্যালেঞ্জ, বহুকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সেতুও এটি। নাম তার পদ্মা সেতু। অনেকদিন ধরেই পদ্মা সেতু দেখতে যাওয়ার শখ। সময়ের অভাবে যাওয়া হয়নি।
Advertisement
তাছাড়া মাওয়া ঘাটে ইলিশ ভাজার স্বাদের কথা অনেক শুনেছি। বন্ধু খালেককে আমার ক্ষুদ্র ইচ্ছার কথা বলতেই মাওয়া যেতে রাজি হয়ে গেল। খালেক খুবই ভ্রমণপিপাসু। তাই ঘুরতে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার না নেই।
আরও পড়ুন: একদিনের নোয়াখালী ভ্রমণে কী কী দেখবেন?
ঠিক হলো আমরা মোট ৬ বন্ধু যাবো। নাজিম, সাদ্দাম, জয়, আরিফ, খালেক ও আমি। একরাতের প্ল্যান। রাত ছাড়া মাওয়া ঘাটে মজা নেই। প্রথমে না করলেও পরে ঠিকই বাসা থেকে অনুমতি পেয়ে গেলাম। ক্যাম্পাস থেকে বাসা, টিউশন এমন নিরামিষ জীবনে এ যেন আমিষের আবির্ভাব!
Advertisement
শুক্রবার রাতে যাওয়ার দিন ঠিক হলো। যদিও ঢাকা শহরের জ্যাম ঠেলে কোথাও যেতে তেমন ভালো লাগে না। তবে শুক্রবারের দিনটি স্বস্তির। মিরপুর ১০, ফার্মগেট, শাহাবাগ থেকে স্বাধীন পরিবহনের বাস মাওয়া ঘাটে যায়।
ভাড়া ১০০ টাকার আশপাশে। এছাড়া গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ি থেকে বিআরটিসি, ইলিশ পরিবহনের বাস মাওয়া যায়। ফার্মগেটের বাসিন্দা হওয়ায় আমরা স্বাধীন বাসে উঠলাম। দেড় ঘণ্টা বাস জার্নি শেষে মাওয়া গোল চত্বরে পৌঁছলাম।
আরও পড়ুন: শাপলার রাজ্য সাতলা গ্রামে ঘুরতে যাবেন কীভাবে, খরচ কত?
নেমেই পদ্মা সেতুর এক নম্বর পিলারের কাছে বন্ধুরা মিলে কিছু ছবিও তুললাম। এরপর অটোতে করে মাওয়া ঘাট। ঘড়িতে তখন রাত ১১টা। মাওয়া ঘাটে খাবারের হোটেলগুলোর সামনে দাঁড়ানো কর্মচারীরা আপন গলায় ক্রেতাদের ডাকছেন।
Advertisement
কোনো কর্মচারী বলছেন, ‘আসেন স্যার, পদ্মার ইলিশ’। কেউবা বলছেন, ‘একদম তাজা ইলিশ, স্বাদ পাইবেন স্যার’। মাওয়া ঘাটে আসা যাত্রীদের কেন্দ্র করে ঘাট টার্মিনালে ফলের দোকান থেকে শুরু করে খাবার দোকান সবকিছু আছে। বিক্রেতাদের হাঁকডাকে বিক্রিও বেশ।
খাবারের হোটেলভেদে এক টুকরো ইলিশের দাম ৯০-১২০ টাকা। আর আস্ত ইলিশ ১০০০-১২০০ টাকায় বিক্রি হয়। যেসব হোটেলে কেনাবেচা একটু কম, সেসব হোটেলে ইলিশের দাম একটু কম রাখা হয়।
আরও পড়ুন: ঢাকার কাছেই ঘুরে আসুন গোলাপের রাজ্যে
এছাড়া ইলিশের ডিম ভাজাও পাওয়া যায় এখানে। ইলিশ না কিনে শুধু ডিম খেতে চাইলে সেক্ষেত্রে ডিমের জন্য গুনতে হবে ১৫০-২০০ টাকা। আপাতত একটি হোটেলে কেজি খানেক ওজনের দুইটা ইলিশ অর্ডার দিয়ে টেবিলে বসলাম।
গরম ভাত, ইলিশ মাছ ভাজা আর চাক চাক করে কাটা বেগুন ভাজা। আস্ত ইলিশ ছাড়াও এখানকার হোটেলে পিস হিসেবেও ইলিশ পছন্দ করা যাবে ইচ্ছেমতো। উপরে টিনের চালা আর নিচে রঙিন ত্রিপলের বেড়া দিয়ে ঘেরা হোটেলটা একেবারে পদ্মার তীরে।
তার একটু দূরেই খরস্রোতা পদ্মা! প্রমত্তা এই পদ্মার বুকে রাতভর ঘুরে ইলিশ নিয়ে আসেন জেলেরা। বাংলা সাহিত্যে তাদের অনেক কথাই আমরা শুনেছি।
আরও পড়ুন: নিকলী হাওর ভ্রমণে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?
আমাদের মতো অনেকেই ঢাকা থেকে এসেছেন। পাশের টেবিলে বসা এক লোকের সাথে কথার ছলে পরিচয় । নাম তার নিশাদ। তিন বন্ধুসহ এসেছেন। তারা সবাই তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী।
নিশাদ বলেন, ‘সবার মুখে শুধু মাওয়া ঘাটের ইলিশের প্রশংসা। কখনো আসা হয়নি। আজকে একটু সময় পেয়েছি । তাই নতুন স্বাদ নেওয়ার জন্যই আমাদের আসা।’
এত রাতে কীভাবে এলেন, জবাবে নিশাদ বললেন, গাড়ি ভাড়া করে এখানে এসেছেন। এরই মধ্যে খাবার চলে আসে। গরম ভাতের সঙ্গে ইলিশ ভাজা খেতে বসে চোখ যায় পদ্মায়।
আরও পড়ুন: পাহাড়ি ঝরনায় গিয়ে কেন পথ হারাচ্ছেন পর্যটকরা?
দূর থেকে দেখা যায়, মাঝ পদ্মায় পানির ঢেউ , স্পিডবোট, ট্রলার আর লঞ্চ। মাঝ নদীতে এইসব জলযান দেখে মন কেমন কেমন করে। এই কেমন কেমন যে কেবল আমার তা নয়, টের পেলাম পাশে থাকা বন্ধুদের মধ্যেও। কারো কারো মাঝে জীবন্ত হয়ে ওঠেছে কপিলা আর তার মাঝির।
এদিকে হোটেলের বড় কড়াইয়ে বিরতিহীন ভাজা হচ্ছে ইলিশ। পাশে রাখা গরম বেগুন ভাজা। যার ঘ্রাণে হোটেলে আসা ভোজনরসিকরা মাতোয়ারা! কেউ কেউ দরদাম না করেই বসে পড়ছেন খাবারের গন্ধে! কেউ আবার অর্ডার দিয়ে বসে জিভের জল ফেলছেন।
তবে আমার চোখ তখন ইলিশ ভাজা, ইলিশের ডিম, বেগুন ভাজা, ভাতের প্লেটের দিকে। সব মুগ্ধতা এক পাশে রেখে গোগ্রাসে গেলা শুরু, নিমেষে প্লেট উধাও। পাশে বসা বন্ধুদের মুখেও তৃপ্তির ঢেঁকুর।
আরও পড়ুন: বর্ষায় পাহাড়ে ঘুরতে গেলে যেসব বিষয়ে সতর্ক হবেন
খেয়ে তৃপ্তি পেলেও, দরদাম করতে না জানলে ঠকে আসাটা অবধারিত। আরেকটা বিষয়, ইলিশ চিনতে না জানলে রূপালি, চান্দা ইলিশ পদ্মার ইলিশ বলে চালিয়ে দেন কিছু বিক্রেতারা। তবে আমাদের মতো কম অভিজ্ঞ হলে পদ্মার ইলিশ খেয়েছি ভেবেই তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।
রাতের সময়টুকু আনন্দের মাঝেই দ্রুত শেষ হয়ে গেল। মাথার উপর উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেশের অহংকার পদ্মা সেতু কেমন জানি মায়ার বন্ধনে আবিষ্ট করে ফেলছে আমাদের।
হুটহাট প্রিয়জনদের সঙ্গে একদিন বা একবেলার ভ্রমণের জন্য ঢাকার কাছে মাওয়াঘাটের বিকল্প বোধহয় কিছু নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী
জেএমএস/এএসএম