জাগো জবস

টেক্সটাইলে পড়ে পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডার জিসান

আনিসুল ইসলাম নাঈম

Advertisement

জিসান আহমেদ ৪১তম বিসিএসে পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় অবস্থান করেছেন। অষ্টম শ্রেণি থেকে ঢাকার মালিবাগ ও শান্তিনগর এলাকায় তার শৈশব কাটে। তিনি মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলস (বুটেক্স) থেকে ওয়েট প্রসেসিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক পাস করেন।

সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

জাগো নিউজ: বিসিএসে পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডার পাওয়ার অনুভূতি কেমন?জিসান আহমেদ: যখন প্রথম নিজের রোল নম্বরটা দেখতে পাই; তখন আম্মু বলে জোরে দুটি চিৎকার দিই! ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না! অনুভূতিটি লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন অনূভূতি, যা আমার প্রথম জব প্রাপ্তির পরও আসেনি। আমার সাফল্যের পেছনে বাবা-মা, বড় ভাই, শিক্ষক, পরিচিত অনেক বড় ভাই, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অনেক অবদান আছে।

Advertisement

জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?জিসান আহমেদ: আমি মূলত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলে (বুটেক্স) শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা ছিল। সিজিপিএ সামান্য কম থাকায় শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায়। বাবা সরকারি কর্মকর্তা (বিসিএস-গণপূর্ত) ছিলেন। বড় ভাই সরকারি কর্মকর্তা (বিসিএস নন-ক্যাডার) হিসেবে কর্মরত। তারাই আমাকে সরকারি চাকরিতে আসার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে টেক্সটাইল কোম্পানিতে চাকরি শুরুর পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ছেড়ে দিই। এরপর ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করি।

আরও পড়ুন: প্রথম বিসিএসেই কাস্টমস অ্যান্ড এক্সসাইজে প্রথম সাব্বির

জাগো নিউজ: বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?জিসান আহমেদ: ৪০তম বিসিএসের দেড় মাস আগে ২০১৯ সালের এপ্রিলে বিসিএসের জন্য পড়া শুরু করি। তবে তা প্রিলি পাসের জন্যে যথেষ্ট নয়। মূলত ২০১৯ সালের জুলাই থেকে পড়া শুরু হয়। একটানা নভেম্বর পর্যন্ত পড়তে থাকি। নিজের নাম থেকে বেকার শব্দটি বাদ দেওয়ার জন্য টেক্সটাইলের পথ থেকে সরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন এমবিএতে ভর্তি হই। এরই মাঝে একদিন আমার ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট বয়ের সঙ্গে ভার্সিটিতে দেখা হয়। তার তাচ্ছিল্যভরা চাহনি আমার মধ্যে একটি সরকারি চাকরি পাওয়ার ইচ্ছাশক্তি অনেকগুণ বাড়িয়ে তোলে।

২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে অফিসার পদে পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রিলির প্রস্তুতি নিয়ে প্রথম চাকরির পরীক্ষা দেওয়া শুরু। প্রথম চাকরির পরীক্ষায় প্রিলি উত্তীর্ণ হই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হই। এরপর অনেকগুলো সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরে চাকরির পরীক্ষা দিই। এর মধ্যে তিন-চারটি ভাইভায় অংশগ্রহণ করি। এর মধ্যে একটিতে এখনও জব করছি।

Advertisement

করোনাকালীন যখন সবাই জীবন নিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন; তখন আমি পড়ালেখা চালিয়ে গিয়েছি। পড়ালেখায় আত্মবিশ্বাস আসতে শুরু করে। ওই সময় নিয়মিত বিভিন্ন পড়ালেখা বিষয়ক ফেসবুক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকতাম। তাদের রুটিনের সঙ্গে আমার রুটিন ও সময় মিলিয়ে পড়ালেখা করতাম। ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানে যে দুর্বলতা ছিল, তা কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম। আমি যতটা না পড়তাম ও লিখতাম, তার চেয়ে বেশি পরীক্ষা দিতাম। হোক সেটা চ্যাপ্টার শেষ করে অথবা চ্যাপ্টার শুরুর আগে। পড়া শুনলে বেশি মনে থাকে বলে বিভিন্ন জায়গায় বেশি বেশি ক্লাস করতাম। পরীক্ষার ঠিক ২৫ দিন আগে রিভিশন প্ল্যান তৈরি করি এবং রিভিশন দেওয়া শুরু করি। পরে বিসিএস প্রিলি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পর সম্ভাব্য মার্ক দেখে মোটামুটি নিশ্চিত হই, আমার প্রিলি আসবে এবং প্রিলি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই।

আরও পড়ুন: পরিবার আমাকে সাহস জুগিয়েছে: মীম জাহান তন্বী

প্রিলি পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লিখিত পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। প্রথমেই দুর্বল দিকগুলো বাছাই করে সেগুলোতে বেশি জোর দেওয়া শুরু করি। পড়ালেখায় বেশি সময় দেওয়ার জন্য ঘুম কমিয়ে দিই। বেশি সময় ক্লাস ও পড়ালেখা করার জন্য প্রয়োগ করি। এমন অনেক রাত কেটেছে সারারাত পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছি। প্রিলি উত্তীর্ণ হওয়ার পর মাত্র পাঁচ মাস পড়ালেখা করতে পারি। এরপর অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হয়। অপারেশনের পর এক মাস বেডরেস্টে ছিলাম। এনেসথেসিয়া একটু বেশি হওয়ায় মাথা থেকে অনেক কিছু সরে যেতে থাকে। কিছুদিন পর একটি বেসরকারি ব্যাংকে (ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড) চাকরি হয়। মাথা থেকে পড়ালেখা ভুলে যাওয়ার ভয় এবং বাসা থেকে নীরব চাপের কারণে চাকরিতে যোগদান করি। যোগদানের আগের দিন ৪৩তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। এরপর যখন ৪১তমের লিখিত পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসে, তখন ব্যাংক থেকে পরীক্ষার দিনসহ ১৭ দিনের ছুটি নিই। এই ১৭ দিনের মধ্যে ৯ দিনে আমি আমার সম্পূর্ণ লিখিত পরীক্ষার রিভিশন দিই।

লিখিত পরীক্ষায় অসুস্থতার জন্য বিজ্ঞান বিষয় ভালো না হওয়ায় ৪১তম বিসিএসে ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিল। পরে ৪১তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কামরুল ভাই ভাইভায় পথ দেখান। তার মোটিভেশন ও দেখানো পথ অনুসরণ করে ভাইভা মোটামুটি ভালো দিই। ৪১তমে লিখিত পরীক্ষার পর থেকে ৪৪তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা পর্যন্ত কোনো সময় পড়ালেখা থেকে দূরে সরে যাইনি। এরমধ্যে পারিবারিক কারণে এমবিএ মাঝপথেই ছেড়ে দিতে হয়। তবুও চাকরি ও পড়ালেখা পাশাপাশি রেখেই আমার এতদিনের সরকারি জব পাওয়ার জার্নি চলতে থাকে।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রায় কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?জিসান আহমেদ: হ্যাঁ, আমার মা। তিনি জানতেন, আমি পারবোই। এজন্য তিনি আমার সব কাজে সাহস জুগিয়েছেন। বিভিন্নভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন।

আরও পড়ুন: দারিদ্র্যকে জয় করে বিসিএস ক্যাডার আসাদ

জাগো নিউজ: বিসিএসের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া কেমন সাহায্য করেছে?জিসান আহমেদ: আমি ২০১৯ ও ২০২০ সালে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব অ্যাকটিভ ছিলাম। বিভিন্ন পড়ালেখার গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তাদের রুটিন অনুসরণ করে পড়ালেখা করতাম এবং পরীক্ষা দিতাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক বড় ভাই ছিলেন; যারা পথ দেখিয়েছিলেন কীভাবে পড়ালেখা করতে হবে। সুমন ভাই, রায়হান ভাই, শাওন ভাই, কামরুল ভাই, রাফি, মাহিনদের সঙ্গে পরিচয় আমার সোশ্যাল মিডিয়াতেই। এ ছাড়া যে কোচিং সেন্টারে যুক্ত ছিলাম, তার শিক্ষকরা আমাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কথোপকথন ও পরীক্ষার মাধ্যমে সাহায্য করেছেন।

জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?জিসান আহমেদ: আমি সাদকায়ে জারিয়ায় বিশ্বাসী। কর্মক্ষেত্র কিংবা পড়ালেখা—সব বিষয়েই সবাইকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে চাই। ফলে যে উপকৃত হবে, তার দোয়া থাকবে আমার সঙ্গে। এ ছাড়া চাকরিজীবনে নিজের সততাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে চাই। পরিবারের ছোটখাটো প্রতিটি বিষয়ে সবাইকে নিয়ে পথ চলতে চাই।

এসইউ/এমএস